সালিশ নিয়ে বিরোধে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা, দেশজুড়ে আলোচনায় মুরাদনগর

কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার বাহেরচর পাঁচকিত্তায় প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণ ও বেধড়ক পিটুনির ঘটনায় দেশজুড়ে চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। তার রেশ কাটতে না কাটতেই একই উপজেলার কড়ইবাড়ি এলাকায় গণপিটুনিতে একই পরিবারের তিনজন নিহত। এ ঘটনায় আবারও দেশজুড়ে আলোচনায় মুরাদনগর।
মাদক ও ছিনতাই নিয়ে সালিশের বিরোধ থেকে স্থানীয় চেয়ারম্যান ও মেম্বারের গায়ে হাত তোলা নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) সকালে একই পরিবারের তিনজনকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনার পর আজ বিকেল থেকে পুরুষশূন্য ওই এলাকা। থমথমে পরিবেশ গ্রামজুড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক টিম ঘটনাস্থলে।
নিহতরা হলেন কড়ইবাড়ি গ্রামের হাবিবুর রহমানের স্ত্রী রোকসানা বেগম রুবি (৪৭), রুবির মেয়ে তাসপিয়া আক্তার হ্যাপি ওরফে জোনাকি (২৯) ও রুবির ছেলে মো. রাসেল মিয়া (৪০)। এ সময় রুবির আরেক মেয়ে রুমা আক্তারকে (২৭) গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়েছে। নিহত জোনাকির স্বামী হায়দারাবাদ গ্রামের আবদুল হামিদের ছেলে মনির হোসেন। মনির হোসেন, নিহত তিনজন ও হাবিবুর রহমানের আরেক মেয়েসহ তাদের পরিবারের পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে ৪৩টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে নিহত তিনজনের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ৩০টি।
আজ বিকেলে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সাততলা ভবনের বেশির ভাগ জানালার কাচ ভাঙা। তিনটি স্থানে ছোপছোপ রক্তের দাগ। বাড়ির আঙিনায় একটি মোটরসাইকেল ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে। বাইরে অসংখ্য মানুষের জটলা। তবে উৎসুক মানুষ বেশির ভাগই অন্য গ্রাম থেকে এসেছে।
স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি জানায়, তারা দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছে এ পরিবার মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কমপক্ষে ৪০ বছর ধরে তারা মাদক ব্যবসা করছে।
স্থানীয়রা আরও জানায়, তারা অনেকবার শুনেছে তাদের ক্রসফায়ার দেওয়া হবে। কিন্তু তারা বারবার বেঁচে যায়। তারা সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না হলেও আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা ব্যক্তিদের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল। সম্প্রতি এক স্কুল শিক্ষকের মোবাইলফোন ছিনতাই হয়। ওই ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত রুবিদের পরিবার। তারা ছিনতাইকারীকে তাদের বাড়িতে আশ্রয় দেয়। গত মঙ্গলবার কড়ইবাড়ি গ্রামে বিষয় নিয়ে সালিশ হয়। সেখানে তাদের অপকর্মের বিষয়ে মানুষজন অভিযোগ তোলে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এই পরিবারের মাদকের কারণে গ্রামের আটজন মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে আছে।
আজ সকালে হায়দারাবাদ-কড়ইবাড়ি সড়কের কাজ পরিদর্শনে আসেন আকুবপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাল। এ সময় তিনিসহ স্থানীয় বাচ্চু মেম্বারের গায়ে সালিশের ঘটনা নিয়ে আচমকা হাত তোলেন রোকসানা বেগম রুবি। স্থানীয়রা প্রতিবাদ করলে, রুবি নিজের হাত কেটে মামলার ভয় দেখান। এরপর পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যায়।
নিহত রাসেলের স্ত্রী মীম আক্তার জানান, ননদের দোকানে চাকরি করা এক যুবক মোবাইল চুরির অভিযোগে ধরা পড়ে। তার বাবা এ ঘটনায় আমাদের বাড়িতে এসে বলেন, আমি একলাখ টাকা জরিমানা দেব। আমার স্বামী রাসেল যাতে বিষয়টি মীমাংসা করে দেন। গত পরশু বিষয়টি সুরাহার জন্য সবাই বসে। আমার শাশুড়ি বিষয়টি নিয়ে কথা বললে, স্থানীয় বাছিরের সঙ্গে ঝামেলা হয়। বাছির আমার শাশুড়ি ও ননদকে মারধর করে। এ সময় তর্কাতর্কির একপর্যায়ে আমার এক বছরেরও কম বয়সী মেয়ের হাত ভেঙে দেয় তারা। আমার স্বামী তখন বাইরে ছিল। তিনি এটি জানতে পারার পর খুবই উত্তেজিত হয়ে যান। এ নিয়ে খুব ঝামেলা হয়। তবে ওই দিন রাতের মধ্যে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে যায়। কিন্তু আজ সকালে এক-দেড়শ লোক বাঁশ ও ছুরি নিয়ে হাজির হয়। তারা প্রথমে ঘরের ভেতর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এরপর ঘরে ঢুকে আমার শাশুড়িকে হত্যা করে। ঘরের বাইরে নাশতা আনতে যাওয়া ননদকেও হত্যা করা হয়। এরপর আলমারিতে লুকিয়ে থাকা আমার স্বামীকেও হত্যা করে তারা। আমার স্বামী ছোট সন্তানের জন্য বারবার প্রাণভিক্ষা চাইলেও লাভ হয়নি। এখন পর্যন্ত আমার শ্বশুর নিখোঁজ। আমি এ ঘটনায় মামলা করব।
তবে একাধিক সূত্র জানায়, পাশের কসবা উপজেলা থেকে বেশ কিছু লোকজন এসে এর সঙ্গে জড়িত হয়। তারা এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত হয়।
এ বিষয়ে পুলিশ সুপার নাজির আহমেদ খান বলেন, নিহতদের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে যতই অভিযোগ থাকুক, এভাবে কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না। যারা হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।