ঈদযাত্রায় ঢাকার বাস টার্মিনালগুলোতে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য

রাজধানীর বাসিন্দারা বুধবার বিকেল থেকেই কোরবানির ঈদ উদযাপন করতে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেন। ট্রেন আর লঞ্চে তেমন সংকট না হলেও সড়কপথে নানা ধরনের দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন যাত্রীরা। বেশি ভাড়া দিয়ে বাড়ির পথে রওনা হয়েও মহাসড়কে কোথাও কোথাও পড়তে হয়েছে যানজটে। মহাসড়কের পাশে গরুর হাটের কারণে যানজট তীব্র হতে থাকে। যানজট আর ফিরতি ট্রিপে যাত্রী না পাওয়ার অজুহাতে বাস ভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারা শুরু হয় বুধবার থেকেই। সেই দৃশ্য প্রচার করতে গিয়ে ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনালে একটি দৈনিকের ডিজিটাল বিভাগের একজন সাংবাদিক হামলার শিকার হন। তারপর মহাখালী বাস টার্মিনালে পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীও মোতায়েন করা হয়। কিন্তু টিকিটের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান হয়নি। অপেক্ষা করতে করতে কেউ কেউ অসুস্থও হয়ে পড়েন।
সাংবাদিকের ওপর হামলা
দৈনিক কালের কণ্ঠের ডিজিটাল বিভাগের সাংবাদিক মো. রায়হান হোসেন রনি বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে ঈদ যাত্রা নিয়ে লাইভ করছিলেন। তিনি যাত্রীদের ভোগান্তিসহ নানা অব্যবস্থাপনার কথা তুলে ধরেন। লাইভ শেষ করার পর তিনি দেখতে পান কিছু লোক লাইনে দাঁড়ানো যাত্রীদের মারধর করছে। সেই দৃশ্য ভিডিওতে ধারণ করতে গেলে তার ওপরও হামলা চালানো হয়। রনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, “আমি সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর তারা আমার ওপর হামলা আরো বাড়িয়ে দেয়। লোহার পাইপ দিয়ে আমার হাত, মাথা, পা ও পিঠে আঘাত করে তারা। আমার পোশাক ছিড়ে ফেলে। পুলিশ সেখানে নিরবে দাঁড়িয়ে থাকে।”
“যারা আমার ওপর হামলা করেছে, তারা টার্মিনালের শ্রমিক। তারা বেশি ভাড়া আদায় করছিল। যাত্রীরা তার প্রতিবাদ করলে তারা যাত্রীদের মারধর করে। আমি সেই ভিডিও ধারণ করায় আমার মোবাইল ফোনটিও কেড়ে নেওয়া হয়। তারা এতই শক্তিশালী যে, পরে অতিরিক্ত পুলিশ এলেও তাদের আটক করেনি। পুলিশের কথা- ওটা শ্রমিক নেতারা দেখবে,” বলেন তিনি।
রনি আরও বলেন, “আমি যখন বৃহস্পতিবার মহাখালী বাস টার্মিনালে যাই, তখন অনেক যাত্রী তাদের কাছ থেকে জোর করে বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেন। যাত্রীরা টিকিটও পাচ্ছিলেন না। টিকেটের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে তারা বেশি ভাড়ায় টিকেট বিক্রি করছিল।”
সাংবাদিক রনি হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছেন। থানায় অভিযোগ করেছেন তিনি। কিন্তু হামলাকারীদের কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
শুক্রবার ডয়চে ভেলে সংবাদ সংগ্রহ এবং লাইভ করতে মহাখালী বাস টার্মিনালে যায় দুপুর ১২টার দিকে। সেখানে অনেক বাস থাকলেও টিকিটের জন্য অনেক লম্বা লাইন ছিল তখন। টিকিটের জন্য অনেকেই ভোরে এসেছেন, কিন্তু টিকিট জোটেনি। তখন অবশ্য টার্মিনালে পুলিশ ও সেনা সদস্যদের টহল ছিল। যাত্রীরা জানান, অভিযানের কারণে বাড়তি ভাড়া আর না নেওয়া হলেও টিকিটের তীব্র সংকট চলছে। টিকিট কাটতে পারলেও বাস কখন ছাড়বে তা তখনো অনিশ্চিত৷
তীব্র গরমে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা চরম দুর্ভোগের শিকার হন। যাত্রীদের অনেকে ‘‘বাস থাকলেও ছাড়া হচ্ছে না”- এমন অভিযোগও করেন৷ তাদের আশঙ্কা- সাংবাদিক আর পুলিশ চলে গেলে বেশি দামে টিকিট ছাড়া হবে৷
অনন্যা পরিবহনের ম্যানেজার রফিকুল ইসলাম অবশ্য দাবি করেন, “মহাসড়কে প্রচণ্ড যানজট থাকায় আগের রাতে যেসব বাস টাঙ্গাইল গেছে, সেগুলো ফিরে আসেনি। ফলে শতাধিক যাত্রীকে টিকিট দিলেও তাদের বাস কখন দিতে পারবে বলা যাচ্ছে না।”তার মতে, “ঢাকা-ঙ্গাইল মহাসড়কে যানজটের কারণে এই পরিস্থিতি হয়েছে।”
ঢকা থেকে টাঙ্গাইলের যাত্রী মোশারফ হোসেন বলেন, “আমি সকাল ১১টায় টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে দুপুর দুইটার দিকে টিকিট পাই। তার আরো আধাঘণ্টা পরে বাস পাই। একই অভিজ্ঞতা প্রায় সবার। দুই-তিন ঘণ্টার কমে কেউ টিকিট পাননি।”
আরেক যাত্রী জাকির হোসেন চার ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট পান। তিনি বলেন, “লাইনে অনেকে অসুস্থও হয়ে পড়েন। তবে আমার মনে হয়েছে টিকিটের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছে। আমার কাছ থেকে ঢাকা-টঙ্গাইলের এসি বাসের জন্য সাড়ে চারশ টাকা নেওয়া হলেও আমার পরিচিত দুই-একজন উচ্চ মূল্যে কালো বাজার থেকে টিকিট কিনেছেন। আর্মি, পুলিশের কারণে কাউন্টারে ঠিক দামে কিছু টিকিট দেওয়া হলেও বাকিটা কালো বাজারে চলে গেছে বলে আমরা মনে হচ্ছে।”
বৃহস্পতিবার মহাখালী বাস টার্মিনালসহ আরও কয়েকটি বাস টার্মিনালে বাড়তি ভাড়া আদায়ে অভিযান চালায় পুলিশ। সকালে মহাখালী বাস টার্মিনাল পরিদর্শন করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তার সঙ্গে ছিলেন ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ। পরিদর্শন শেষে প্রশাসক বলেন, ভোর থেকেই যাত্রী ভোগান্তি কমাতে ডিএনসিসির ভ্রাম্যমাণ আদালত মহাখালী বাস টার্মিনালে অভিযান পরিচালনা করছে। এ সময় এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো. শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগে কয়েকটি বাস কাউন্টারে অভিযান পরিচালনা করে ভ্রাম্যমাণ আদালত। বেশি ভাড়া আদায়ের জন্য লাবিবা ক্লাসিক লি. পরিবহণ কাউন্টারে অভিযান পরিচালনা করে সড়ক পরিবহণ আইনে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি রহিম বক্স দুদু ডয়চে ভেলেকে বলেন, সায়েদাবাস ও গাবতলীতেও কয়েকটি পরিবহণ কোম্পানিকে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগে জরিমানা করা হয়েছে। তিনি বলেন, “আমরা গত বৃহস্পতিবারও সব বাস টার্মিনালে গিয়ে বৈঠক করেছি, যাতে কেউ বাড়তি ভাড়া আদায় না করে। তারপরও করছে। আমরা পুলিশকে ব্যস্থা নিতে বলেছি।”
৬০০ টাকার ভাড়া ২৫০০ টাকা!
রাজধানী পরিবহণ বড় কোনো বাস কোম্পানি নয়। তারপরও তারা ঢাকা ও সাভার থেকে এই ঈদে দেশের উত্তরাঞ্চলে, বিশেষ করে রংপুরে যাত্রী বহন করছে। ওই পরিবহণের ম্যানেজার এমদাদ হোসেন বলেন, “এই ঈদে বেশি ভাড়া না নিলে আমরা পোষাতে পারি না। আমাদের বিভিন্ন জায়গায় চাঁদা দিতে হয়। তাই রংপুরে ৬০০ টাকার ভাড়া আমরা ১২০০ টাকা করেছি।”
“চান্দুরা, এলেঙ্গা, যমুনা সেতু সবখানে আমাদের টাকা পয়সা দিতে হয়। পুলিশকে দিতে হয়। তারপর রাস্তায় জ্যামে বসে থাকতে হয়, সাত ঘণ্টার পথে ১২ ঘণ্টা লাগে। খরচ আছে। আবার ঢাকায় ফেরার সময় যাত্রী পাওয়া যায় না। ফলে ভাড়া আমরা বেশি নিচ্ছি। অন্যরাও নেয়। ঈদে তো ভাড়া বাড়বেই। রাস্তায় কত মানুষকে টাকা-পয়সা দিতে হয়,” বলেন তিনি।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “সব রুটেই ভাড়া বেশি নেওয়া হচ্ছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-কক্সবাজার সব রুটেই। কত শতাংশ বেড়েছে তা এখন হিসাবেরও বাইরে। ৬০০ টাকার ভাড়া যদি ২৫০০ টাকা হয় তাহলে সেটা তো হিসাবের বাইরে চলে গেল।”
মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরও জানান, “এই সময়ে অনেক ফিটনেসবিহীন যানবাহন নামানো হয়েছে। ফলে, দুর্ঘটনার আশঙ্কাও বেড়ে গেছে। আর যানবাহনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। যখন অভিযান চলে, তখন ঠিক ভাড়া নেওয়া হয়। কিন্তু তখন টিকিট থাকে না বলে আরেকটা সংকট তৈরি করা হয়।”
যানবাহনের ধীরগতি ও যানজট
এবার সড়ক মহাসড়কে যানজটের সাথে আছে ধীর গতি। বাংলাদেশ রোড সেফটি ফউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, “সড়ক পথে যানজটের মূল কারণ মহাসড়কের পাশে গরুর হাট। সেখানে বৈধ হাটের চেয়ে অবৈধ হাটই বেশি। মহাসড়কে গরুর ট্রাক থামছে, গরু নামানো হচ্ছে । ফলে যানজট তৈরি হচ্ছে। আমরা এটা নিয়ে অনেক দিন ধরে কথা বলছি, কিন্তু কোনো কাজে আসছে না। এইসব হাটের সাথে স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক লোকজন জড়িত।”
যানজট প্রসঙ্গে মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “এবার বৃষ্টি থাকায় সড়কে যানবাহনের ধীর গতি হচ্ছে। রাস্তা পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত থাকায় ধীরে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। তবে আগের চেয়ে সড়ক এখন অনেক ত্রুটিমুক্ত। দেশের সড়ক ও সেতু ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। এক দিনে ঈদের ছুটি শুরু হয়েছে। ফলে সবাই একযোগে ঢাকা ছাড়ছেন। তাই যানবাহনের ওপর একসাথে চাপ পড়েছে। আমাদের দাবি- ছুটি বিন্যাস করে কয়েক ধাপে দেওয়ার। সেটা করলে আর এই সংকট হবে না।”
পুলিশের নজরদারি
এবার ট্রেনে বড় ধরনের কোনো শিডিউল বিপর্যয় হয়নি। অনলাইনে আগাম টিকিট কাটার ব্যবস্থা থাকায় ট্রেন যাত্রা বেশ স্বস্তির হয়েছে। দক্ষিণাঞ্চলে জলপথেও ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। যাত্রীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চ ও ট্রেনের ছাদেও ভ্রমণ করছেন। তবে আকাশ পথে উড়োজাহাজে চাপ নেই বলে জানান ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ পরিচালক কামরুল ইসলাম। তিনি বলেন, “আসলে এবার যাত্রীর চাপ স্বাভাবিক সময়ের মতোই। ভাড়াও বাড়েনি।” প্রাইভেট কোম্পানির হেলিকপ্টারে ঈদযাত্রাও গতবারের মতোই আছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি ইনামুল হক সাগর বলেন, “আমরা সড়ক মহাসড়কে নজরদারি বাড়িয়েছি। যানজট আছে। কোথাও কোথাও আছে যানবাহনের ধীরগতি। হাইওয়ে পুলিশসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা এটা নিয়ে কাজ করছে। আর বেশি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ যেখানেই পাচ্ছি সেখানেই ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা সবাইকে আহ্বান জানাই তারাও যেন আমাদের তথ্য দেন।”
প্রসঙ্গত, ঈদে ঢাকা, গাজীপুর , নারায়ণগঞ্জ-এইসব এলাকা থেকে দেড় কোটির মতো মানুষ ঢাকা ছাড়েন। শুধু ঢাকা শহর থেকে ঢাকার বাইরে যান এক কোটি মানুষ।