নদী শুকিয়ে মাঠ, কৃষকের চোখে পানি

কিশোরগঞ্জের মিঠামইনের এককালের খরস্রোতা নদী হাটুরিয়া। এককালে পানসি নৌকা ভেসে চলা নদীটিকে এখন দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠ বলেই মনে হওয়া স্বাভাবিক। শুধু শুকনো তলদেশের ওপর ফসলের মতো পড়ে থাকা জরাজীর্ণ নৌকাগুলো জানান দিচ্ছে একসময়ের বহমান একটি নদীর কথা।
চলতি বোরো মৌসুমে মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া ও কেওয়ারজোড় ইউনিয়নের হাটুরিয়া নদীটিতে কোনো পানি নেই। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় পানির অভাবে চাষ শুরু করতে পারছেন না কৃষকরা। এ কারণে সেখানে ১০ হাজার হেক্টর জমি অনাবাদি থাকার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ঘাগড়া ইউনিয়নের খলাপাড়া গ্রামের আশি-ঊর্ধ্ব হুমায়ুন কবীর স্মৃতিচারণা করে বলেন, একসময় এই নদীতে যাত্রী ও পণ্য নিয়ে বড় বড় পানসি নৌকা আসত। প্রতিবছর নৌকাবাইচের আয়োজন হতো খলাপাড়ায়। কিন্তু খননের অভাবে নদী এখন শুকিয়ে মাঠ হয়ে গেছে। নদীর কথা বলতে বলতে এই কৃষক প্রতিবেদকের কাছে কেঁদে ফেলেন। তিনি বলেন, মাঠে সেচের কোনো ব্যবস্থা নেই। এভাবে চলতে থাকলে খাব কি!
সরেজমিন দেখা গেছে, কিশোরগঞ্জের ঘাগড়া ইউনিয়নের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলা একসময়ের খরস্রোতা হাটুরিয়া নদীর গতিপথের দিকে তাকালে এখানে বয়ে যাওয়া নদীর অস্তিত্ব নিয়ে কল্পনা করা দুঃসাধ্য। নদী শুকিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। এ কারণে কৃষিজমিতে পানি সেচ নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের কৃষকরা।
অথচ বছরের ছয় মাস পানির নিচে তলিয়ে থাকায় একমাত্র বোরো ধান আবাদ করেই সারা বছরের জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন এখানকার কৃষক। দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করা হাওর এলাকার কৃষকরা ব্যাংক কিংবা মহাজনের কাছ থেকে চড়াসুদে ঋণ নিয়ে ধারদেনা করে বছরের একমাত্র ফসলের আবাদ করে থাকেন। এখন সেচের পানির অভাবে সম্ভাব্য ফসলহানির আশঙ্কা মাথায় রেখে পরিবারের ভরণ-পোষণ ও ঋণ পরিশোধ নিয়ে চরম উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে কৃষকদের।
জেলার হাওরাঞ্চলে এখন বোরো আবাদের ধূম। কৃষকরা তাঁদের জমিতে বোরো ধানের চারা রোপণে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছেন। কিন্তু জেলার অন্যতম বোরো ধান উৎপাদনকারী উপজেলা মিঠামইনের কৃষকরা হাটুরিয়া নদী শুকিয়ে যাওয়ায় পানির অভাবে এখনো তাদের জমিতে বোরো ধানের চারা রোপণ করতে পারছেন না।
পানির অভাবে চলতি মৌসুমে ঘাগড়া ইউনিয়নে আবাদযোগ্য ১০ হাজার একর জমির মাঝে চার হাজার একর জমিতে বোরো আবাদ করা সম্ভব হয়নি। প্রতি একর জমিতে হাইব্রিড জাতের ৮০ থেকে ৯০ মণ এবং দেশি জাতের ৫০ থেকে ৬০ মণ ধান উৎপন্ন হয়ে থাকে। এর মাঝে যেটুকু আবাদ হয়েছে পানির অভাবে তার বেশির ভাগই নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
ঘাগড়া গ্রামের কৃষক রতন কর পরিত্যক্ত বিশাল মাঠ দেখিয়ে বলেন, গত বছরও এসব জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। কিন্তু এবার পানির অভাবে ধান আবাদ করা যায়নি। আরেক কৃষক নারায়ণ দেবনাথ বলেন, পানির অভাবে সেচ দেওয়া যাচ্ছে না। যেটুকু লাগানো হয়েছিল, পানির অভাবে তাও মরে যাচ্ছে।
কৃষকরা জানান, কিছুদিনের মধ্যেই ধানের শিষ বের হবে। এই সময়টাতে সেচের পানির খুব প্রয়োজন হলেও তা মিলছে না। নদী শুকিয়ে যাওয়ায় বহু আগেই বন্ধ হয়ে গেছে এর তীরবর্তী বিএডিসি কিংবা ব্যক্তি মালিকানাধীন সেচ পাম্পগুলো।
পাম্পচালক জগদীশ দেবনাথ বলেন, তাঁর তিনটি পাম্প দিয়ে সাড়ে পাঁচ হাজার একর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হতো। কিন্তু এখন পানির অভাবে দেওয়া যাচ্ছে না। নদীতে যেমন পানি নেই, তেমনি মাটির নিচেও পানি নেই। এর ফলে এলাকায় হাহাকার পড়ে গেছে।
এ অবস্থায় প্রকৃতিও যেন কৃষকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। একদিকে নদীতে পানি নেই, প্রকৃতিতে তখন চলছে অনাবৃষ্টিজনিত টানা খরা, সেই সাথে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নেমে গেছে। গভীর নলকূপের সাহায্যেও সহজে পানি উঠছে না। খরায় পুড়ে তাই অনেক স্থানে মরে যাচ্ছে জমির ফসল।
মালিউন গ্রামের কৃষক মতিন মীর হতাশা প্রকাশ করে বলেন, পানির অভাবে এলাকার সিকিভাগ ধানও পাওয়া যাবে না।
এলাকার জনপ্রতিনিধিও শোনালেন হতাশার কথা। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান বোরহান উদ্দিন চৌধুরী বুলবুল সমস্যার গভীরতার কথা স্বীকার করে বলেন, কৃষকদের মতোই তিনিও একই রকম হতাশ। কারণ সমস্যা সমাধানে তিনি সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও এ পর্যন্ত যেমন কোনো সুফল আসেনি, ভবিষ্যতেও কতটুকু সুফল আসবে, সে ব্যাপারে তিনি সন্দিহান।
সমস্যার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিএডিসি, কিশোরগঞ্জ নির্বাহী প্রকৌশলী (ক্ষুদ্র সেচ) প্রকৌশলী শিবেন্দ্র নারায়ণ গোপের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সেচের পানির সমস্যার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘এ বছর সমস্যাটি খুবই প্রকট। এ সমস্যা সমাধানে নদীর দুটি পয়েন্টে ছয় কিলোমিটার এলাকা খনন করা প্রয়োজন।’
শিবেন্দ্র নারায়ণ জানান, মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের শ্রীগাং নদীর সিংজুড়ি পয়েন্ট থেকে হাটুরিয়া নদীর উৎপত্তি হয়ে ঘাগড়া হয়ে ধোবাজোড়া এবং সিহারা এলাকা পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটির অবস্থান। নদীটির সামনের দেড় কিলোটিারের প্রস্থ ১০০ ফুট, গভীরতা গড়ে ৩০ ফুট।
নদীর পাথারকান্দি পয়েন্ট থেকে সিংজুড়ি পর্যন্ত এক কিলোমিটার এবং সিংজুড়ি থেকে ধোবাউড়া পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত নদী খনন করা প্রয়োজন। শ্রীগাং নদীর সিংজুড়ি পয়েন্ট দিয়েই মূলত হাটুরিয়া নদীতে পানি প্রবাহিত হয়। তবে সিংজুড়ি পয়েন্টে শ্রীগাং নদীর বালি আর পলি জমে পানির লেভেল থেকে উঁচু হয়ে যাওয়ায় হাটুরিয়া নদীর পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে সিংজুড়ি থেকে সিহারা পর্যন্ত কিছু গভীর গর্ত ছাড়া পুরো নদীই এখন প্রায় শুকিয়ে গেছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিএডিসির সাড়ে ১২ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন দুটি পাম্প, ১০ কিউসেক ক্ষমতার দুটি ভাসমান পাম্প ও পাঁচ কিউসেক ক্ষমতার ১০টি লেলিফট সেচপাম্প বন্ধ রয়েছে। সমস্যা সমাধানে কেওয়ারজুড় থেকে ফুলপুর পর্যন্ত সিংজুড়ি খাল পুনরায় খননের কথাও বলেন তিনি।
শিবেন্দ্র নারায়ণ গোপ আরো জানান, গত মৌসুমে ২৫ কিউসেক ক্ষমতার একটি ও সাড়ে ১২ কিউসেক ক্ষমতার দুটি ডাবল লিফটিংয়ের মাধ্যমে ভাসমান সেচপাম্প প্রস্তুত রাখা হয়েছিল, যাতে শ্রীগাং নদী থেকে হাটুরিয়া নদীতে পানি সরবরাহ করা যায়। কিন্তু সেচযন্ত্রের ভাড়া, জ্বালানি খরচ ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বহন করতে কৃষকরা আগ্রহী নন। কৃষকরা খরচ বহন করলে ডাবল লিফটিংয়ের মাধ্যমে নদীর সেচকাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে তিনি জানান।
এ অবস্থায় শুধু হতাশা প্রকাশ আর পরিকল্পনা নয়, হাওর এলাকার মরে যাওয়া নদ-নদী ও খাল-বিলসহ পানির অন্যান্য উৎসগুলো জরুরি ভিত্তিতে খননের উদ্যাগ গ্রহণ করবে সরকার, অবসান ঘটবে কৃষকসহ সাধারণ মানুষের দীর্ঘদিনের ভোগান্তির-এমনটাই আশা করছেন স্থানীয় জনগণ।