যাচ্ছেতাইভাবে বাংলা ভাষার ব্যবহার পীড়াদায়ক

ভাষাসৈনিক আ ফ ম শামসুল হুদা বলেছেন, বর্তমানে নিয়ম না মেনে যাচ্ছেতাইভাবে বাংলা ভাষার ব্যবহার হচ্ছে। এটা অত্যন্ত পীড়াদায়ক।
ভাষার অপব্যবহার নিয়ে গতকাল সোমবার এনটিভি অনলাইনের কাছে এমন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শামসুল হুদা।
৮৫ বছর বয়সী এ ভাষাসৈনিকের মতে, কয়েকটি এফএম রেডিও, টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষার ভুল ও বিকৃত উচ্চারণের অপচর্চা বেশি দেখা যায়। তিনি বলেন, স্বাধীনতার ৪৪ বছর পরও আইন-আদালতসহ সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে ইংরেজি ভাষার ব্যবহার অত্যন্ত দুঃখজনক। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা করা এমন একটি ভাষার এই দুরবস্থা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলার সময় ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামী দিনগুলোর কথা স্মরণ করেন কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল সরকারি কলেজের সাবেক এই অধ্যক্ষ। কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি।
ভাষা আন্দোলনের দিনগুলি
১৯৫২ সালে গুরুদয়াল সরকারি কলেজের বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন শামসুল হুদা। ওই সময় তিনি কলেজের নির্বাচিত ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) ছিলেন।
১৯৪৮ সালে করিমগঞ্জ থানার নানশ্রী হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা পাস করার পর গুরুদয়াল কলেজে ভর্তি হন শামসুল হুদা। একজন দেশপ্রেমিক ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি ভাষা আন্দোলনের শুরুতেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
সে সময়ের কথা স্মরণ করে শামসুল হুদা বলেন, ‘যখন জানতে পারলাম ঘোষণা হয়েছে উর্দুই হবে এ দেশের রাষ্ট্রভাষা, তখন আমাদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণার জন্ম নেয়। আমরা স্টুডেন্ট ইউনিয়নের মাধ্যমে গোপনে গোপনে মিটিং করে সংগঠিত হই এবং আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি। নিরাপত্তাজনিত কারণে গোপনে আমাদের প্রথম সভাটি হয় শহর থেকে দূরে যশোদল ইউনিয়নের জাইল্লা বাজারে।’
‘আশরাফ উদ্দিন মাস্টার সাহেবের সভাপতিত্বে সেই সভায় স্টুডেন্ট ইউনিয়নের ভিপি (সহসভাপতি) আবদুল হক, জিএস ছিলেন গোলাম মহিউদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক আবু তাহের খান পাঠানসহ অন্যান্য ছাত্রনেতাসহ রেশন ডিলার সুন্দর আলী, পুস্তক ব্যবসায়ী মালিক আমিনুল হকদের মতো সাধারণ মানুষও উপস্থিত থেকে সহযোগিতা করেছেন। তাঁদের মধ্যে স্টুডেন্ট ইউনিয়নের জিএস ছিলেন গোলাম মহিউদ্দিন। তাঁকে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনী রাতের আধারে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে’, যোগ করেন শামসুল হুদা।
‘পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরও নিয়মিত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় আমরা ছাত্র-জনতা মধুর ক্যান্টিনের পাশে আমতলায় মিটিং করতাম। আর মিটিং করার সময় প্রায়ই সেখানে পুলিশি হামলার ঘটনা ঘটত। কয়েকবার পুলিশের লাঠিচার্জে আঘাতও পেয়েছি। একবার প্রায় ৪০ জন ছাত্রকে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করে লালবাগ থানায় নিয়ে আসা হয়। পরে শেরেবাংলা ফজলুল হকের মধ্যস্থতায় তাদের ছাড়িয়ে আনা হয়। এ ছাড়া বিশিষ্ট লেখক ও কলামিস্ট বদরুদ্দীন উমরের পিতা ভাষা আন্দোলনের একজন সংগঠক আবুল হাসেমের বাসায় আমরা প্রায়ই গোপনে সভা করতাম’, বলেন ওই ভাষাসৈনিক।
শিক্ষকতার সময়
ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার পর আ ফ ম শামসুল হুদা ১৯৫৫ সালে প্রথমে শ্রীকাইল কলেজে দর্শনশাস্ত্রের প্রভাষক হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করেন। তারপর ১৯৫৬ সালে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজে যোগদান করেন। টানা ৩৪ বছর অধ্যাপনা শেষে অধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। গুরুদয়াল কলেজের ছাত্র হিসেবে তিনিই প্রথম ওই কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনের গৌরব অর্জন করেন।
ভাষা আন্দোলনে সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান
ভাষা আন্দোলনে কতটা সফল হয়েছেন, সে বিষয়ে জানতে চাইলে শামসুল হুদা বলেন, ‘অবশ্যই ভাষা আন্দোলন সফল হয়েছে। আমরা এখনো বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারছি। এটা তো ভাষা আন্দোলনেরই ফসল। তবে এটাও ঠিক যে, যতটুকু উচ্চতায় আমাদের ভাষাকে নিয়ে যাওয়ার দরকার ছিল, সেখানে আমরা যেতে পারিনি। এ ব্যাপারটি এখনো আমাকে পীড়া দেয়।’
ভাষাসৈনিকদের যথাযথ সম্মান না দেওয়া নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে শামসুল হুদার মনে। তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি এলে কেন্দ্রীয়ভাবে আন্দোলন যাঁরা করেছেন, তাঁদের কয়েকজনকে নিয়ে বরাবরই আলোচনা হয়। কিন্তু মফস্বলে তৃণমূল পর্যায়ে যাঁরা আন্দোলন করেছেন, তাঁরা বরাবরই আড়ালে থেকে যান। তা ছাড়া ২১ ফেব্রুয়ারির পর আমাদের কথা আর কেউ মনেও করেন না।’
‘গত সাত-আট বছর যাবৎ আমাদেরকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সম্মাননা প্রদান করা হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই অনুষ্ঠানেও ভাষাসৈনিকদের যথাযথ সম্মানটুকু দেওয়া হয় না। গত বছর ২১ ফেব্রুয়ারিতে আমাদের সম্মাননার জন্য ডাকা হলেও মঞ্চে ওঠানো হয়নি এবং কোনো কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। যাদের জন্ম ভাষা আন্দোলনের অনেক পরে, তারাই আজ বাংলা ভাষা নিয়ে বড় বড় কথা বলছে। জীবনের শেষ সময়ে এসে এটা আশা করি না’, যোগ করেন শামসুল হুদা।
নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে আ ফ ম শামসুল হুদা বলেন, ‘আমি চাই নতুন প্রজন্ম জানুক যে আজ তারা যে ভাষায় কথা বলছে সে ভাষার জন্য কারা যুদ্ধ করেছিল। কাদের প্রচেষ্টার ফলে বাংলা রাষ্ট্রভাষা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস- তা তাদেরকে জানতে হবে। নতুন প্রজন্মকে সঠিক তথ্য জানাতে আমাদেরকে সুযোগ করে দিতে হবে।’
জেলা শহরের খড়মপট্টি এলাকায় ‘ইমাম বাড়া’ নামের নিজ বাড়িতে শামসুল হুদার অবসর কাটে বই পড়ে ও ইবাদত-বন্দেগির মধ্য দিয়ে। বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত হলেও স্ত্রী, চার ছেলে, এক মেয়ে ও নাতি-নাতনিদের নিয়ে মধুর সুখেই আছেন বলে সৃষ্টিকর্তার প্রতি শুকরিয়া জানান তিনি।