পরিবর্তন অথবা প্রত্যাবর্তনের ভোট চলছে

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটপর্ব আজ রোববার সকাল ৮টায় একযোগে শুরু হয়েছে। বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোট গ্রহণ চলবে। ৩০০ আসনের মধ্যে একজন প্রার্থীর মৃত্যুজনিত কারণে ২৯৯ আসনে ভোট গ্রহণ করা হবে। স্থগিত হওয়া গাইবান্ধা-৩ আসনে ভোট গ্রহণ করা হবে ২৭ জানুয়ারি।
২০০৮ ও ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা দুবার জিতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল ও মহাজোট। এবার টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসার জন্য লড়ছে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে এক দশক পর জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ধারণা করা হচ্ছে, ভোটারদের আগ্রহের শীর্ষে রয়েছে এ দুই জোটের প্রার্থীরা।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটই পুনরায় ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করবে, নাকি পরিবর্তন ঘটিয়ে বিএনপি হারানো ক্ষমতায় ফিরে আসবে—সেই প্রশ্নেরই মীমাংসা করে দেবেন ভোটাররা। যে দল বা জোটই জিতুক, তারা আগামী পাঁচ বছর দেশ শাসন করবে।
নির্বাচন উৎসবমুখর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা। তিনি ভোটারদের নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
এবার ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৭ জন ভোটারের জন্য মোট ৪০ হাজার ১৮৩টি নির্বাচনী কেন্দ্র, দুই লাখ ছয় হাজার ৭৭৭টি বুথ নির্ধারণ করা হয়েছে। এবারই প্রথমবারের মতো ছয়টি আসনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করা হবে। ভোটকেন্দ্র ও নির্বাচনসামগ্রী, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, পোলিং এজেন্টসহ সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে। নির্বাচনী এলাকায় তদন্ত কমিটি, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্মরত রয়েছেন।
এ নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। উচ্চ আদালতের আদেশের পর বেশ কয়েকজনের প্রার্থিতা বাতিলের পর এখন মোট প্রার্থী এক হাজার ৮৬১ জন। এর মধ্যে ১২৮ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী, বাকিরা দল মনোনীত।
দেশে ৩৯টি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব প্রতীক থাকলেও এ নির্বাচনে জোটের মেরুকরণে অর্ধেক সংখ্যক দলই দুই মেরুতে ভিড়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের জোটসঙ্গী বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, বিকল্পধারা ও তরীকত ফেডারেশনের ১৪ জনকে নৌকা প্রতীক বরাদ্দ দিয়েছে। আওয়ামী লীগ তাদের মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির জন্য ২৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছে। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি ১৪৮টি আসনে মুক্তভাবে দলীয় লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছে।
আর বিএনপি ধানের শীষ প্রতীক দিয়েছে গণফোরাম, জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, এলডিপি, খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বিজেপি, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, এনপিপি ও পিপিবির ৪৩ প্রার্থীকে। এর বাইরে জোটে থাকা অন্য দলগুলো নিজ নিজ প্রতীকে তাদের প্রার্থী দিয়েছে।
২৯৯ আসনে ভোট ও একটি আসনে স্থগিত
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেছেন, ৩০০ আসনের মধ্যে গাইবান্ধা-৩ আসনের একজন প্রার্থীর মৃত্যুজনিত কারণে সেখানকার ভোট স্থগিত করা হয়েছে। তার মানে ২৯৯ আসনে ভোট গ্রহণ করা হবে। গাইবান্ধা-৩ আসনে ভোট গ্রহণ করা হবে ২৭ জানুয়ারি।
ভোটকেন্দ্র ও ভোটার
সব মিলিয়ে এবার ৪০ হাজার ১৮৩টি ভোটকেন্দ্র আছে। কেন্দ্রগুলোতে দুই লাখ সাত হাজার ৩১২টি ভোটকক্ষ আছে। মোট ভোটার ১০ কোটি ৪২ লাখ ৩৮ হাজার ৬৭৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার পাঁচ কোটি ২৫ লাখ ৭২ হাজার ৩৬৫ জন এবং নারী ভোটার পাঁচ কোটি ১৬ লাখ ৬৬ হাজার ৩১২ জন।
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন
বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম ইসির নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এর আগে কখনো সংসদ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। ২৯৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সংখ্যা এক হাজার ৮৬১ জন। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর সংখ্যা এক হাজার ৭৩৩ জন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রয়েছেন ১২৮ জন প্রার্থী।
পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
নির্বাচনী পরিস্থিতি ঠিক রাখতে মাঠে পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন রয়েছে। ভোটকেন্দ্র ও নির্বাচনী এলাকায় সশস্ত্র বাহিনী ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় ছয় লাখ আট হাজার সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে পুলিশ প্রায় এক লাখ ২১ হাজার জন, আনসার প্রায় চার লাখ ৪৬ হাজার ও গ্রাম পুলিশ প্রায় ৪১ হাজার।
৩৮৯টি উপজেলায় সেনাবাহিনীর ৪১৪ প্লাটুন (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন) সদস্য রয়েছেন। ১৮টি উপজেলায় নৌবাহিনীর ৪৮ প্লাটুন (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন) সদস্য, ১২টি উপজেলায় কোস্টগার্ডের ৪২ প্লাটুন (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন) ও বিজিবির ৯৮৩ প্লাটুন (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন) সদস্য রয়েছেন। ৬০০ প্লাটুন (প্রতি প্লাটুনে ৩০ জন) র্যাব সদস্য ভোটের মাঠে নিয়োজিত আছেন। এ ছাড়া মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্সের সংখ্যা (র্যাবসহ) প্রায় দুই হাজার প্লাটুন (প্রায় ৬৫ হাজার)। তা ছাড়া সারা দেশে জেলা ও মহানগর পুলিশের টহল দল নিয়োজিত আছে।
পোলিং অফিসার নিয়োগ
প্রার্থীদের পোলিং অফিসাররা সকাল ৮টার আগেই প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে নিয়োগপত্র দেখাবেন। অবশ্যই ওই পোলিং অফিসার দল বা প্রার্থীর মনোনীত হতে হবে। এসব বিষয়ে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে ইসি ব্যবস্থা নেবে।
ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে ৬৬ জন দায়িত্ব পালন করছেন। এর মধ্যে দুজন বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪ জন জেলা প্রশাসক।
ভোটের দায়িত্বে জুডিশিয়াল ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট
ভোটের মাঠে এক হাজার ৩২৮ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করবেন। এর মধ্যে আচরণবিধি প্রতিপালনের জন্য ৬৫২ জন, অবশিষ্ট ৬৭৬ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মোবাইল/স্ট্রাইকিং ফোর্সের সঙ্গে নিয়োজিত রয়েছেন। এ ছাড়া বিচারিক কার্য সম্পাদন করার জন্য জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন ৬৪০ জন। নির্বাচনী অপরাধ দমনের জন্য সারা দেশে ১২২টি ইলেক্টোরাল ইনকোয়ারি কমিটিতে আছে ২৪৪ জন। প্রিসাইডিং অফিসার ৪০ হাজার ১৮৩ জন। সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার দুই লাখ সাত হাজার ৩১২ জন এবং পোলিং অফিসার চার লাখ ১৪ হাজার ৬২৪ জন।
দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক
সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশি-বিদেশি সংস্থা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করবে। এতে দেশি ৮১টি পর্যবেক্ষক সংস্থার ২৫ হাজার ৯০০ জন মাঠে কাজ করবেন। ফেম্বোসা, এএইএ, ওআইসি ও কমনওয়েলথ থেকে আমন্ত্রিত ও অন্যান্য বিদেশি পর্যবেক্ষক ৩৮ জন। কূটনৈতিক/বিদেশি মিশনের কর্মকর্তা ৬৪ জন এবং বাংলাদেশ দূতাবাস/হাইকমিশন বা বিদেশি সংস্থায় কর্মরত বাংলাদেশি ৬১ জন।
ছয়টি আসনে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ
এবারই প্রথম ছয়টি আসনের সব ভোটার ইভিএমের মাধ্যমে ভোট দেবেন। এই ছয়টি আসন হলো ঢাকা-৬, ঢাকা-১৩, রংপুর-৩, খুলনা-২, সাতক্ষীরা-২ ও চট্টগ্রাম-৯।
ফল ঘোষণা
প্রতিটি ভোটকেন্দ্র থেকেই ফল ঘোষণা করা হবে। প্রিসাইডিং অফিসার ভোট গ্রহণ শেষে সংশ্লিষ্টদের উপস্থিতিতে কেন্দ্রেই ভোট গণনা করবেন। এ সময় সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও প্রার্থীর এজেন্টরা উপস্থিত থাকতে পারবেন। ভোট গ্রণনা শেষে প্রিসাইডিং অফিসার লিখিত ফল সংশ্লিষ্টদের সরবরাহ করবেন। পরে এ ফল রিটার্নিং অফিসারের কাছে পাঠাবেন। রিটার্নিং অফিসাররা তা নির্বাচন কমিশনে পাঠাবেন। নির্বাচন কমিশনের ফোয়ারা প্রাঙ্গণে স্থাপিত মঞ্চ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফল ঘোষণা করা হবে। এ চত্বরে নির্বাচন কমিশন ১০টি মনিটরের মাধ্যমে ফল প্রদর্শন করবে।
নির্বাচনের পরিবেশ, ভোটারদের শঙ্কা, কারচুপির আশঙ্কাসহ নির্বাচনের আরো অনেক বিষয় নিয়ে দুজন নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁদের ভেতরে নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘প্রচারণার সময় বেশ কিছু সহিংসতার খবর আমরা পেয়েছি। অভিযোগ পেলেই আমরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়েছি। ভোটের দিন যাতে কোনো ধরনের সহিংসতার ঘটনা না ঘটে, সে জন্য আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোরভাবে নির্দেশনা দিয়েছি। এবং কেউ যদি ভোটে কারচুপি করার চেষ্টা করে, তবে তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমরা চাই, ভোটের দিন সবাই সমান সুযোগ পাক। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আমরা দেখতে চাই।’
নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ভোটের দিন পরিবেশ ঠিক থাকবে বলে আমরা মনে করছি। ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যাবেন, পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবেন এবং যাতে করে ভালোভাবে ভোট দিয়ে ঘরে ফিরে যেতে পারেন, সে জন্য সেনাবাহিনী, র্যাব, বিজিবি, পুলিশসহ সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ভোটারদের সহযোগিতা করবে। ভোটারদের প্রতি কমিশনের পরামর্শ হলো, সবাই ভোটকেন্দ্রে যাক, দেশের মালিক হিসেবে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করুক।’