আহারে জীবন…

ছোট ছোট ঝুপড়ি। পলিথিন ও ছেড়া কাপড় দিয়ে ছাউনি দেওয়া। ঝুপড়ির নিচ দিয়ে নোংরা পানি। সেখানেই থাকছে ২০টি পরিবার। যমুনার ভাঙনে দুই বছর আগেই বিলীন হয়েছে তাঁদের বসতবাড়ি। সবকিছু হারিয়ে চলে আসেন রাজধানীতে। কিন্তু ভাড়া বাসায় থাকার সামর্থ্য নেই। তাই ঠাঁই নেন বেড়িবাঁধে।
রাজধানীর তুরাগ থানাধীন ধউর বেড়িবাঁধের পাশের একটি ঝুপড়িতে থাকেন মো. সুরুজ আলী। জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার চর সিশুঁয়া গ্রাম থেকে দুই বছর আগে চলে আসেন এখানে। তাঁর মতো অনেককেই ঘরবাড়ি হারিয়ে চলে আসতে হয়। এখন সেখানেই কাটছে তাঁদের কষ্টের জীবন।
সুরুজ আলী বলেন, ‘ছেলে-মেয়েরা স্কুলে পড়তে যাইত, আমরা কৃষি কাজ করতাম, জমিতে চাষাবাদ করতাম। তখন সুখের জীবন ছিল। কিন্তু যমুনা নদীর ভাঙন কাইড়া নিল ঘরবাড়ি। নিজের বাপের ভিটা ছাড়া করল, এলাকায় মানুষের বাড়িতে কিছুদিন ছিলাম। কিন্তু মানুষ কয়দিন থাকতে দিব। তাই পোলাপাইন লইয়া ঢাকায় আইছি। পাশেই একটা বিল্ডিংয়ে (বেড়িবাঁধ এলাকায়) শ্রমিকের কাজ করি। এখানে একটা খালি জায়গা দেইখা আমরা ঘর তুলছিলাম। কিন্তু এখন পানি আইস্যা ঘরের মধ্যে ঢুকে গেছে, মাচার ওপরে কোনো মতে ঘুমাই। ছোট ছোট বাচ্চা লইয়া থাকি। তাই ঘুমাইতে পারি না, কখন পানিতে পইড়া যায়।’
সুরুজ জানান, তাঁদের মতো ২০টিরও বেশি পরিবার জামালপুরের ইসলামপুর থেকে গ্রাম ছাড়া হয়। শেষে তাঁরা ঢাকায় চলে আসেন। ভাড়া বাসায় থাকার টাকা না থাকায় বেড়িবাঁধের পাশে একটি শুকনা স্থানে বাঁশের চৌকি বানিয়ে ছোট ছোট ঝুপড়ি তোলেন। এখানে ২০টি পরিবারের সব মিলিয়ে প্রায় ৬০ জনের বেশি মানুষ বসবাস করছে। কিন্তু এবার বর্ষায় সেখানে পানি উঠে ঘরের অর্ধেক অংশ ডুবে গেছে। ঘরের চারদিকে প্রচুর পানি। পানি আর নোংরা পরিবেশের কারণে শিশুরা নানা রকম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের সন্তানরা যারা গ্রামের স্কুলে পড়ত, এখন তারা শ্রমিকের কাজ করে।
‘সন্তান বা নিজেরা অসুস্থ হলে বেড়িবাঁধ এলাকায় সহজে পাওয়া যায় না চিকিৎসক। কাছাকাছি কোনো বাজারও নেই। তাই মাঝে মধ্যে মনে হয় এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করছি।’ বলছিলেন সুরুজ।
ঝুপড়ির বাসিন্দাদের এখন রান্না করার একমাত্র ভরসা মাটির চুলা। চারিদিকে পানি হওয়ায় ওই ঝুপড়ির এক কোণার চুলা রেখে রান্না করতে হয়। আর খাবার পানি আনতে হয় দূরের একটি নির্মাণাধীন ভবন থেকে। ঝুপড়ির পাশে কথা হয় শিশু শ্রমিক আশরাফুল ইসলামের সঙ্গে। সে জানায়, গ্রামের একটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত। কিন্তু ঘরবাড়ি ছাড়া হওয়ার কারণে এখন পরিবারের সঙ্গে ঝুপড়িতে থাকতে হয় তাকে। পাশের একটি কারখানায় কাজ করছে সে।
ঝুপড়ির আরেক বাসিন্দা আতাউর রহমান। তিনি বলেন, ‘এখানে ঘর বানাইয়া থাকি, কাউকে ভাড়া দিতে হয় না। ফ্রি থাকি, তাই যত কষ্ট হোক আমাদের বাধ্য হয়েই থাকতে হয়। চারদিকে পানি আর ময়লার কারণে মশার উৎপাত বেশি। কিন্তু এখানে অনেকেরই মশারি নাই।’
নদী ভাঙনের পর স্থানীয় বা সরকারিভাবে সহায়তা পাওয়ার বিষয়ে আতাউর রহমান বলেন, ‘সরকার কি আমাদের এসব দেখার জন্য বইসা আছে। গরিবের ঘরে জন্ম, তাই সারা জীবন কষ্ট করেই কাটাতে হবে। এসব নিয়ে ভাবি না, ভেবে লাভ কী। কার কাছে গিয়ে আমাদের এসব কথা বলব।’