নেপালে কারফিউ ভেঙে সহিংস বিক্ষোভ, নিহত ১৯
নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে তরুণ প্রজন্মের (জেন-জি)প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যদের সহিংস সংঘর্ষে অন্তত ১৯ জন নিহত এবং তিন শতাধিক লোক আহত হয়েছে। প্রতিবাদকারীরা সরকারের দুর্নীতি এবং কয়েকটি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছে। বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদকারীরা কারফিউ ভেঙে পার্লামেন্টের কাছে নিষিদ্ধ এলাকায় প্রবেশ করার পর রাজধানীতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
নেপালের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই বিক্ষোভে মোট ১৯ জন নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে আরও ৩৪৭ জন। খবর এএফপি, এনডিটিভি ও দি হিমালয়ান টাইমসের।
নেপালের দি হিমালয়ান টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ছয়জনের মরদেহ রয়েছে রাজধানী কাঠমান্ডুর ট্রমা সেন্টারে, তিনজনের মরদেহ রয়েছে সিভিল হাসপাতালে, এভারেস্ট হাসপাতালে রয়েছে তিনজনের মরদেহ, কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজনের এবং ত্রিভূবন ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে রয়েছে একজনের মরদেহ।
বিক্ষোভকারীরা গাছের ডাল ও পানির বোতল ছুঁড়ে এবং সরকারবিরোধী স্লোগান দিতে থাকলে পুলিশ জলকামান, কাঁদানে গ্যাস এবং রাবার বুলেট দিয়ে এর জবাব দেয়। দ্য কাঠমান্ডু পোস্টের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, কিছু প্রতিবাদকারী পার্লামেন্টের সীমানার ভেতরেও প্রবেশ করতে সক্ষম হয়, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে।

এই অস্থিরতার প্রতিক্রিয়ায় কাঠমান্ডু জেলা প্রশাসন কারফিউর মেয়াদ বাড়িয়েছে, যা প্রাথমিকভাবে রাজধানীর বানেশ্বর এলাকায় জারি করা হয়েছিল। নতুন নিষেধাজ্ঞার আওতায় এখন কয়েকটি উচ্চ-নিরাপত্তা অঞ্চলও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যেমন রাষ্ট্রপতির বাসভবন (শীতল নিবাস), ভাইস-প্রেসিডেন্টের বাসভবন (লাইনচৌর), মহারাজনগঞ্জ, সিংহ দরবারের চারপাশের সমস্ত দিক, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন (বালুয়াটার) এবং সংলগ্ন এলাকাগুলি।
প্রধান জেলা কর্মকর্তা ছবিলাল রিজালের মতে, এই কারফিউ স্থানীয় সময় দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। এই সময়ে ওই অঞ্চলগুলোতে জনসাধারণের চলাচল, সমাবেশ, প্রতিবাদ বা ঘেরাও কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
পুলিশের রাবার বুলেটের আঘাতে দুজন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। কাঠমান্ডুতে কান্তিপুর টেলিভিশনের সাংবাদিক শ্যাম শ্রেষ্ঠা বানেশ্বরে বিক্ষোভের খবর সংগ্রহ করার সময় রাবার বুলেটের আঘাতে আহত হন। বর্তমানে তিনি সিভিল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এদিকে, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির নিজ শহর দামাকে বিক্ষোভ সহিংস রূপ নিলে সেখানেও একজন আহত হয়।
ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদের পর পোখারার কিছু অংশেও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কারফিউ জারি করেছে, যেখানে প্রতিবাদকারীরা মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয় ভাঙচুর করেছে বলে জানা গেছে।

কেন মানুষ প্রতিবাদ করছে
নেপালে শুক্রবার থেকে ফেসবুক, ইউটিউব এবং এক্সসহ বেশ কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাইটটে প্রবেশ করা যাচ্ছে না, কারণ সরকার ২৬টি অনিবন্ধিত প্ল্যাটফর্ম ব্লক করে দিয়েছে। এতে ব্যবহারকারীরা ক্ষুব্ধ এবং বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। ইনস্টাগ্রাম এবং স্ন্যাপচ্যাটের মতো জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মগুলির নেপালে লাখ লাখ ব্যবহারকারী রয়েছে, যারা বিনোদন, সংবাদ এবং ব্যবসার জন্য এগুলোর উপর নির্ভরশীল।
সরকারের এই পদক্ষেপ জনসাধারণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে, যারা সরকারের বিরুদ্ধে মুক্ত মতপ্রকাশকে দমন করার এবং দুর্নীতি মোকাবিলায় ব্যর্থ হওয়ার অভিযোগ এনেছে। সোমবার, হাজার হাজার জেন-জি বিক্ষোভকারী কাঠমান্ডুতে মিছিল করে সরকারের প্রতি সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার এবং দেশে বিদ্যমান দুর্নীতির সংস্কৃতি বন্ধ করার দাবি জানায়।
২৪ বছর বয়সী ছাত্র ইয়ুজন রাজভান্ডারী বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘আমরা সামাজিক মিডিয়া নিষেধাজ্ঞার কারণে অনুপ্রাণিত হয়েছি, কিন্তু এটিই আমাদের এখানে জড়ো হওয়ার একমাত্র কারণ নয়। আমরা নেপালে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেওয়া দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছি।’
আরেকজন ছাত্রী, ২০ বছর বয়সী ইক্ষমা তুমরোক, বলেন যে তিনি সরকারের ‘স্বৈরাচারী মনোভাবের’ বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন। তিনি এএফপিকে বলেন, ‘আমরা পরিবর্তন দেখতে চাই। অন্যরা এই অবস্থা সহ্য করে গেছে, কিন্তু আমাদের প্রজন্মের মাধ্যমেই এর শেষ হতে হবে।’
নিষেধাজ্ঞার পর থেকে, সাধারণ নেপালিদের দুর্দশার সঙ্গে রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসবহুল জিনিসপত্র এবং ব্যয়বহুল ছুটি কাটানোর দৃশ্যের তুলনা করে তৈরি করা ভিডিওগুলো টিকটকে ভাইরাল হয়েছে, যা এখনও চালু আছে।

ভূমিকা ভারতী নামে একজন প্রতিবাদকারী বলেন, ‘বিদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে, এবং তারা (সরকার) ভয় পাচ্ছে যে এটি এখানেও ঘটতে পারে।’
কেন অ্যাপসগুলো নিষিদ্ধ করা হলো
মন্ত্রিসভা গত মাসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নেপালে নিবন্ধন করতে, একটি যোগাযোগ কেন্দ্র স্থাপন করতে এবং একজন অভিযোগ নিষ্পত্তি কর্মকর্তা ও একজন কমপ্লায়েন্স কর্মকর্তা নিযুক্ত করার জন্য সাত দিন সময় দিয়েছিল। গত বছরের সেপ্টেম্বরে সুপ্রিম কোর্টের একটি আদেশের পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

রোববার এক বিবৃতিতে সরকার জানায়, তারা চিন্তাভাবনা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং এগুলোর সুরক্ষা ও অবাধ ব্যবহারের জন্য একটি পরিবেশ তৈরি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
নেপালে অতীতেও জনপ্রিয় অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলিতে প্রবেশাধিকার সীমিত করা হয়েছে। জুলাই মাসে সরকার অনলাইনে জালিয়াতি ও অর্থ পাচার বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে টেলিগ্রাম মেসেজিং অ্যাপে প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দেয়। গত বছরের আগস্টে টিকটক নেপালের নিয়মাবলী মেনে চলতে রাজি হওয়ার পর নয় মাসের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়েছিল।