ভূমিকম্পের পর খোলা আকাশের নিচে আফগানরা

আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে মারাত্মক ভূমিকম্প আঘাত হানার পর ক্ষুধার্ত ও গৃহহীন অবস্থায় বিভিন্ন স্থানে জড়ো হয়ে আছে সাধারণ মানুষ। আফটারশকের ভয়ে তারা যে কয়েকটি ভবন এখনও দাঁড়িয়ে আছে সেগুলোতেও প্রবেশ করার সাহস পাচ্ছে না। কারণ আরও ভূকম্পন সহ্য করার মতো অবস্থায় নেই ভবনগুলো। খবর এএফপির।
গত সোমবার (১ সেপ্টেম্বর) গভীর রাতে ছয় মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পটি প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে লাগোয়া সীমান্তের দুর্গম অঞ্চলগুলোতে আঘাত হানে, যার ফলে এক হাজার ৪০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। মূল ভূকম্পন আঘাত হানার পরে অন্তত ছয়টি শক্তিশালী আফটারশক এবং অসংখ্য ছোট কম্পন অনুভূত হয়। ভূমিকম্পের আঘাতে সবুজ পাহাড়ের কোলে লুকিয়ে থাকা কিছু কৃষিনির্ভর গ্রাম সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে এবং এখনও অনেক মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়ে আছে।
অন্যান্য জায়গায় কিছু বাড়ি আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে, কিন্তু বাসিন্দারা যেকোনো মুহূর্তে চাপা পড়ার ঝুঁকি নেওয়ার চেয়ে খোলা আকাশের নিচে থাকাকেই নিরাপদ হিসেবে বেছে নিয়েছেন।
সেই ‘ভয়ংকর রাতের’ কথা এখনও মনে করে শিহরিত হন এমরান মোহাম্মদ আরেফ। সেই রাতে নানগারহার প্রদেশের দার-ই-নুর গ্রামে তার বাড়িটি ধ্বংস হয়ে যায়। আরেফ বলেন, এরপর থেকে তিনি তার পরিবারের আরও চার সদস্যের সাথে একটি মোটা প্লাস্টিকের মাদুরে বাইরে ঘুমিয়েছেন।
আরেফ আরও বলেন, ‘গতকালও একটা কম্পন হয়েছিল এবং আজ সকালেও একটা হয়েছে। এখন আমাদের থাকার কোনো জায়গা নেই এবং আমরা সবার কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন করছি।’
যাদের সামর্থ্য ছিল, তারা গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু যেসব বাসিন্দার যাওয়ার কোনো উপায় নেই, তারা ধ্বংসস্তূপের মধ্যে যা কিছু পেয়েছেন, তা দিয়ে অস্থায়ী আশ্রয় তৈরি করেছেন। এমনকি, নানগারহারের প্রাদেশিক রাজধানী জালালাবাদেও, যেখানে কোনো ক্ষতি হয়নি কিন্তু ভূমিকম্প এবং তার আফটারশক অনুভূত হয়েছে, সেখানকার ৪২ বছর বয়সী একজন চিকিৎসক বলেন, ‘আমরা খুবই ভীত।’
ওই চিকিৎসক বলেন, ‘প্রতিবার যখন আমি এক পা ফেলি, তখন মনে হয় যেন মাটি কাঁপছে। আমরা ঘরের ভিতরে থাকি না এবং বাগানে ঘুমাই, সবসময় ভাবি যে আরেকটি ভূমিকম্প হবে।’
ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত কুনার প্রদেশের বিচ্ছিন্ন কিছু এলাকায়ও একই রকম দৃশ্য দেখা যাচ্ছে, যা ভূমিকম্প এবং আফটারশকের কারণে সৃষ্ট ভূমিধসের ফলে এখনো ত্রাণ সরবরাহ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে।

ইয়াজ উলহাক ইয়াদ নামে কুনারের নুরগাল জেলার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সতর্ক করে বলেন, বেঁচে যাওয়া লোকজন তাদের বাড়িঘর (যা সাধারণত উঁচু জমিতে নির্মিত হয়) ছেড়ে নিম্নভূমিতে, নদীর তীর বা রাস্তার পাশে আশ্রয় নিলে আফটারশক আঘাত করলে পাথরের আঘাতে আহত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
ইয়াদ বলেন, ‘এলাকাটি খুবই বিপজ্জনক, আপনি সেখানে বেশি সময় থাকতে বা এমনকি হেঁটে যেতেও পারবেন না।’
এদিকে জাতিসংঘ জানিয়েছে, তাদের কাছে ১৪ হাজার তাঁবু বিতরণের জন্য প্রস্তুত আছে। রেড ক্রস এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির আন্তর্জাতিক ফেডারেশন বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছে, তাদের কাছে অন্তত ৭০০টি তাঁবু আছে, কিন্তু গ্রামগুলিতে প্রবেশ করা কঠিন হওয়ায় তারা সেগুলো বেঁচে যাওয়া লোকজনদের কাছে পৌঁছাতে পারছে না।
স্বামী ও সন্তানদের সঙ্গে ভূমিকম্পে আহত হওয়া সোরাত নামের একজন গৃহিণী আকুতি জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের সাহায্য করুন, আমাদের আশ্রয় দিন, আমার বাচ্চাদের সাহায্য করুন, আমাদের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।’
তার বাড়ি থেকে উদ্ধারকর্মীরা তাকে টেনে বের করার পর একটি আঞ্চলিক হাসপাতালে তার চিকিৎসা করা হয়, তারপর তাকে গ্রামে ফেরত পাঠানো হয়, যেখানে তার জন্য কিছুই ছিল না।
ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করতে করতে সোরাত বলেন, ‘আমরা উপত্যকায় রয়েছি।’ নীল বোরকা পরা এই নারী তিনটি ছোট সন্তানের সঙ্গে একটি ঐতিহ্যবাহী সাধারণ মাদুরের উপর বসেছিলেন।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) বলেছে, এই ভূমিকম্পটি ছিল কয়েক দশকের মধ্যে আফগানিস্তানের অন্যতম মারাত্মক। তারা জানায়, অনেক পরিবারে পর্যাপ্ত খাবার নেই এবং অনেক শিশু ইতোমধ্যে অপুষ্টিতে ভুগছে।
যুদ্ধ এবং একটি দীর্ঘায়িত মানবিক সংকটের পর এখনও নাজুক আফগানিস্তান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আরও কয়েকটি প্রাণঘাতী ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে দেশটি।