গাজায় সাহায্যের খোঁজে গিয়ে নিখোঁজ বহু ফিলিস্তিনি, পরিবারে হাহাকার

ইসরায়েলের চাপিয়ে দেওয়া দুর্ভিক্ষের কবলে পড়া গাজা উপত্যকায় সহায়তা সংগ্রহ করতে গিয়ে বহু ফিলিস্তিনি নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছেন। বেঁচে থাকার তাগিদে যারা খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রের পথে পা বাড়াচ্ছেন, তাদের অনেকেই আর ফিরে আসছেন না। খবর আল জাজিরার।
মধ্য গাজার দেইর আল-বালাহ শহরে প্রতিদিন উপকূলীয় সড়কে দাঁড়িয়ে আছেন খালেদ ওবায়েদ। দুই মাস ধরে তিনি খুঁজে ফিরছেন তার প্রিয় ছেলে আহমেদকে। পরিবারের জন্য খাওয়ার সংগ্রহ করতে আহমেদ গিয়েছিলের জিকিম ক্রসিং পয়েন্টের দিকে, যেখানে উত্তর গাজায় সহায়তা প্রবেশ করে।
কান্নায় ভেঙে পড়া খালেদ ওবায়েদ বলেন, “সে আর ফিরে আসেনি। ক্ষুধার্ত ছিল বলেই গিয়েছিল। ঘরে খাবার কিছুই নেই।”
ছেলের সন্ধানে আন্তর্জাতিক রেডক্রসসহ যত সংস্থা রয়েছে, সবার কাছে গেছেন তিনি—কিন্তু এখনও কোনো উত্তর মেলেনি।
এই ঘটনা শুধু খালেদের একার নয়—এটি গাজার প্রতিটি পরিবারেরই বাস্তবতা। জাতিসংঘ এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ভাষায়, গাজায় খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রগুলো এখন হয়ে উঠেছে “মৃত্যুকূপ” ও “মানব কসাইখানা”।
গত মে মাসের শেষ দিক থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন ফিলিস্তিনি এই কেন্দ্রগুলোর আশেপাশে নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন।
অনেক নিখোঁজ ব্যক্তির মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে সহায়তা কেন্দ্রে বা রাস্তায়, তবে ইসরায়েলি হামলার কারণে তাদের মরদেহ উদ্ধার করাও প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটরের মিডিয়া প্রধান মাহা হুসাইনি বলেন, “অনেকেই খালি হাতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন এক ব্যাগ ময়দা নিয়ে ফিরবেন বলে—কিন্তু আর ফেরেননি।”
আল জাজিরার প্রতিবেদক তারেক আবু আজ্জুম বলেন, “গাজায় এখন বেঁচে থাকার আশা আর নিখোঁজ হওয়ার মধ্যকার পার্থক্যটা মর্মান্তিকভাবে ক্ষীণ হয়ে গেছে।”
গাজায় বর্তমানে দুর্ভিক্ষ ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। গত পাঁচ সপ্তাহে শুধু অনাহারে মারা গেছেন ৮০ জনের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক ও যুদ্ধ শুরুর পর থেকে অপুষ্টিজনিত কারণে মারা গেছে ৯৩ শিশু।
গাজা প্রশাসনের তথ্যে জানা গেছে, ২৭ জুলাই থেকে প্রতিদিন গড়ে মাত্র ৮৪টি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করছে, অথচ কমপক্ষে ৬০০ ট্রাকের প্রয়োজন রয়েছে ন্যূনতম মানবিক চাহিদা পূরণে।
বিভিন্ন মহলের কড়া সমালোচনার মধ্যেও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সোমবার ঘোষণা দেন, গাজা যেন আর কখনও ইসরায়েলের জন্য হুমকি না হয়, তা নিশ্চিত করতে মঙ্গলবার মন্ত্রিসভার বৈঠক করবেন।
ইসরায়েলের চ্যানেল ১২-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নেতানিয়াহু গাজায় সামরিক অভিযান আরও সম্প্রসারণের দিকে ঝুঁকছেন।
সোমবার সকাল থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৭৪ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৩৬ জন সহায়তা নিতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। দেইর আল-বালাহ শহরে এক বাড়িতে হামলায় নিহত হয়েছেন ৩ জন, শুজাইয়া এলাকায় মারা গেছেন ৭ জন এবং উত্তর গাজার বেইত লাহিয়ায় আরও ২ জন নিহত হয়েছেন।
একই দিনে দেইর আল-বালাহর আল-আকসা হাসপাতালে কর্মরত এক নার্স মারা যান, যখন আকাশপথে ফেলা একটি সহায়তা প্যাকেট তার ওপর আছড়ে পড়ে।
এই বিপজ্জনক এয়ারড্রপগুলোর সমালোচনা করে ইউএনআরডব্লিউএ প্রধান ফিলিপ লাজারিনি বলেন, এগুলো মূলত “একটি বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা এবং ধোঁয়াশা সৃষ্টি” ছাড়া কিছু নয়।
সোমবার ইউনিসেফ জানায়, প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন শিশু মারা যাচ্ছে ইসরায়েলি হামলা ও সহায়তার অভাবে—যা একটি পূর্ণাঙ্গ শ্রেণিকক্ষের সমান।
এক্স (সাবেক টুইটার) প্ল্যাটফর্মে এক বার্তায় ইউনিসেফ জানায়, “গাজার শিশুদের খাবার, পানি, ওষুধ ও নিরাপত্তা দরকার। সবচেয়ে বেশি দরকার একটি তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি, এখনই।”
ফিলিস্তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে আহ্বান জানিয়েছে, যেনো অবিলম্বে গাজায় যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করা হয়, সেখানে আনুষ্ঠানিক সফর চালানো হয় এবং নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সম্মেলনে গৃহীত দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

এক বিবৃতিতে মন্ত্রণালয় জানায়, “গাজার দুই মিলিয়নের বেশি মানুষ এখন হত্যা, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, চিকিৎসার অভাব ও মৌলিক মানবাধিকারের চরম ঘাটতির একটি কঠোর মৃত্যুবৃত্তে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে।”