মিয়ানমারের দুর্লভ খনিজের ওপর ট্রাম্পের নজর, নীতি বদলের চিন্তা

মিয়ানমারের বিশাল রেয়ার আর্থ বা দুর্লভ খনিজ মজুদের ওপর নিয়ন্ত্রণ পেতে এবং তা চীনের প্রভাব থেকে সরিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন নতুন নীতি বিবেচনা করছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো। এসব আলোচনা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও, এটি কার্যকর হলে দীর্ঘদিনের যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ানমার নীতিতে বড় পরিবর্তন ঘটতে পারে।
সূত্রগুলো জানায়, ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সামনে দুটি বিপরীতমুখী প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়েছে—একটি প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কাচিন স্বাধীনতা বাহিনী (কেআইএ)-র সঙ্গে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে জান্তা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করা হোক; আরেকটি প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে জান্তাকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি কাচিন বিদ্রোহীদের সঙ্গে কাজ করতে।
২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ এড়িয়ে চলছে। তবে বর্তমানে বিদ্যমান রেয়ার আর্থ খনিজের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে এই অবস্থানে পরিবর্তন আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কে রেখেছে প্রস্তাব?
প্রস্তাবগুলো এসেছে একজন মার্কিন ব্যবসায়ী লবিস্ট, অং সান সুচির সাবেক উপদেষ্টা, কাচিন বিদ্রোহীদের সঙ্গে পরোক্ষভাবে যুক্ত কিছু পক্ষ এবং কিছু আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকের কাছ থেকে।
যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কাছে পেশ করা প্রস্তাবগুলোর মধ্যে আরও রয়েছে—মিয়ানমারের ওপর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত সম্ভাব্য ৪০ শতাংশ শুল্ক হ্রাস করা, দেশটির সামরিক জান্তা ও তাদের মিত্রদের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা, ভারী রেয়ার আর্থ খনিজ প্রক্রিয়াজাতকরণের ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করা এবং এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য একজন বিশেষ দূত নিয়োগ দেওয়ার বিষয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
মিয়ানমারের একটি নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের সাবেক প্রধান অ্যাডাম ক্যাসটিলো এই আলোচনার অন্যতম অংশগ্রহণকারী। ১৭ জুলাই ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সের অফিসে এসব বিষয়ে একটি বৈঠক হয়, যদিও ভ্যান্স নিজে উপস্থিত ছিলেন না।
হোয়াইট হাউসে মিয়ানমার ইস্যুতে অনুষ্ঠিত আলোচনাগুলোকে এখনো "অনুসন্ধানমূলক ও প্রাথমিক পর্যায়ের" বলে উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা বলেন, এই আলোচনা থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা, তা এখনো নিশ্চিত নয়—কারণ প্রশাসন সাধারণত বিদেশি সংকটে হস্তক্ষেপে সতর্কতা অবলম্বন করে, বিশেষ করে মিয়ানমারের মতো জটিল পরিস্থিতিতে।
জুলাইয়ের ১৭ তারিখে হওয়া একটি বৈঠক প্রসঙ্গে এক জ্যেষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, “এই বৈঠকটি মার্কিন ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের প্রতি সৌজন্য হিসেবে নেওয়া হয়েছিল এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মিয়ানারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ৫৭৯ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি সমন্বয়ের প্রচেষ্টাকে সমর্থন দিতেই এর আয়োজন।”
ক্যাসটিলো বলেছেন, “চীন যেভাবে মধ্যস্থতা করে, আমরাও তেমনভাবে কাচিন বিদ্রোহীদের সঙ্গে জান্তার একটি স্বায়ত্তশাসন ভিত্তিক চুক্তি করিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করতে পারি।”
রেয়ার আর্থ: যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কৌশলগত সম্পদ
রেয়ার আর্থ হলো ১৭টি ধাতব উপাদানের একটি গ্রুপ, যেগুলো উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন চুম্বক তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। হেভি রেয়ার আর্থ ফাইটার জেট ও আধুনিক অস্ত্র তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ।
তবে যুক্তরাষ্ট্রে এর উৎপাদন খুবই সীমিত, তাই দেশটি আমদানির ওপর নির্ভরশীল। চীন বর্তমানে বৈশ্বিক রেয়ার আর্থ প্রক্রিয়াজাতকরণের ৯০ শতাংশের বেশি নিয়ন্ত্রণ করে।
মিয়ানমারের কাচিন অঞ্চলের খনিগুলো থেকে ভারী রেয়ার আর্থ উত্তোলন করা হয়, যা পরে চীনে রপ্তানি হয়ে প্রক্রিয়াজাত হয়।
চ্যালেঞ্জ ও জটিলতা
বিশেষজ্ঞদের মতে, কাচিন রাজ্য পাহাড়ি এবং দুর্গম হওয়ায় এখানে যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ শৃঙ্খলা গড়ে তোলা অত্যন্ত কঠিন হবে। সুইডিশ লেখক ও কাচিন বিশেষজ্ঞ বার্টিল লিন্টনার বলেন, “মিয়ানমার-ভারত সীমান্ত দিয়ে এসব খনিজ পরিবহন অসম্ভবপ্রায়, কারণ সীমান্তে একটিমাত্র রাস্তা এবং তা চীনের নজরদারির মধ্যে পড়ে।”
একই সঙ্গে মিয়ানমার এখন গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত। জান্তা সরকার দেশটির অনেক সীমান্ত অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কাচিনের রেয়ার আর্থ খনি অঞ্চল।

জান্তার আগ্রহ ও চীনের প্রভাব
যদিও যুক্তরাষ্ট্র এখনো জান্তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলছে না, মিয়ানমারের সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইং সম্প্রতি ট্রাম্পকে চিঠি দিয়ে তার “শক্তিশালী নেতৃত্বের” প্রশংসা করেছেন এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও শুল্ক কমানোর অনুরোধ জানিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কাচিন বিদ্রোহীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুললেও, সরবরাহ শৃঙ্খলা গড়ে তোলা, চীনের হস্তক্ষেপ এড়ানো এবং কূটনৈতিক সমন্বয় বজায় রাখা হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
সম্ভাব্য কূটনৈতিক পথ ও কোয়াড
কিছু প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ভারতসহ কোয়াড (যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া) জোটের অংশীদারদের সঙ্গে যৌথভাবে এই খনিজ প্রক্রিয়াকরণ করা যেতে পারে। তবে ভারতের খনিজ মন্ত্রণালয় এখনও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।