ভারতে শীতে কাবু নতুন ভারতীয়রা

সুখের খোঁজে বাংলাদেশ থেকে দীর্ঘদিনের বন্ধন ছিঁড়ে ভারতে গেছেন তাঁরা। সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, বিনোদন তো দূরে থাক এখন স্বাভাবিক জীবনযাত্রার স্বপ্নটাই যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। সেখানেও তাঁরা নানা সমস্যায় জর্জরিত। পৌষ মাসের তীব্র শীত জেঁকে বসেছে। এই শীতে কাবু বাংলাদেশে বিলুপ্ত ছিটমহল থেকে যাওয়া ৯০০ নতুন ভারতীয়।
বাংলাদেশে বিলুপ্ত ছিটমহল থেকে এসে এই নতুন ভারতীয়রা কোচবিহারের মেঘলিগঞ্জ, হলদিবাড়ি ও দিনহাটায় আশ্রয় নিয়েছে। ভারত সরকার প্রতিটি পরিবারকে ছোট টিনের ঘর করে দিয়েছে। কিন্তু এখানে একসঙ্গে থাকা অনেকটাই কঠিন। তাই উত্তুরে বাতাসের মধ্যেই বাইরে রাত কাটাতে হচ্ছে বেশির ভাগ পরিবারকে। বাড়ছে সর্দি-কাশির প্রকোপ। শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে এখন দুশ্চিন্তায় পড়েছেন বাসিন্দারা।
এর পাশাপাশি তিনবেলা খাবারের জোগান নেই বলেও অভিযোগ উঠেছে। সরকারি বরাদ্দে যে খাবার তাদের দেওয়া হচ্ছে, তাতে অনেকের চাহিদা পূরণ হচ্ছে না। তা ছাড়া একই ধরনের খাবার খেয়ে অরুচি ধরে গেছে বলেও জানিয়েছেন বাসিন্দারা।
নতুন ভারতীয়দের প্রসঙ্গে স্থানীয় ভারত-বাংলাদেশ নাগরিক রক্ষা কমিটির কো-অর্ডিনেটর দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, ‘বাংলাদেশ ভূখণ্ড থেকে পাকাপাকিভাবে ভারতে চলে আসা প্রায় ৯০০ বাসিন্দা চূড়ান্ত দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের দুর্দশার কথা নিজের চোখে না দেখলে কেউই বিশ্বাস করতে পারবেন না।’
এদিকে বাংলাদেশ থেকে আসাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ প্রশাসনের হাতে আসছে না বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে কোচবিহার জেলার জেলাশাসক পি উলগনাথন সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে তিনি বলেছেন, ‘চাহিদা অনুযায়ী টাকা এলে কাজ করতে সুবিধা হতো।’
কোচবিহার জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত তাদের পেছনে বিভিন্নভাবে প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয় হলেও সরকারিভাবে কেন্দ্রীয় অর্থ বরাদ্দ মিলেছে মাত্র ১০ কোটি টাকা। ফলে বাসিন্দাদের স্বাচ্ছন্দ্যের ক্ষেত্রে নানা অভিযোগ উঠছে। তা ছাড়া এখানে রয়েছেন সাবেক বাংলাদেশি ৫১টি ছিটমহলের প্রায় ১৫ হাজার বাসিন্দা। শুধু বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে আসা বাসিন্দারাই নন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের পর সাবেক ৫১টি বাংলাদেশি ছিটমহল ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ফলে সেই সব ছিটের রাস্তা-ঘাট, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বিদ্যুতায়নসহ পরিকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন। যার জন্য ৩০০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রস্তাবও পাঠানো হয়েছে কেন্দ্রের কাছে। কিন্তু আর্থিক বরাদ্দ সেভাবে না পাওয়ায় সেখানেও উন্নয়নের কাজ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে স্থানীয় জেলা প্রশাসনকে।
কয়েকদিন আগে কোচবিহারে এসে সাবেক ছিটমহলবাসীদের পুনর্বাসন, উন্নয়ন এবং বাংলাদেশ থেকে আসা প্রায় ৯০০ জন বাসিন্দার অবস্থা দেখে যান পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানান, যেভাবে টাকা পাওয়া যাবে সাবেক ছিটমহলের বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের কাজ সেভাবেই এগুবে। অথচ এই টাকার জন্যই আটকে গেছে এখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা, স্বচ্ছন্দ্তা।
স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আগামী সপ্তাহ থেকে রেশনের সুবিধা পাবেন বাংলাদেশে সাবেক ভারতীয় ছিটমহল থেকে চলে আসা ২০১টি পরিবারের এই সদস্যরা। এতদিন ধরে তাঁরা সরকারিভাবে সকালের নাশতা এবং দুপুর ও রাতের খাবার পেতেন। আগামী সপ্তাহ থেকে তাঁদের রেশনের মাধ্যমে চাল, ডাল, তেল, চিনি, কেরোসিন তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করা হবে। এরই মধ্যে তাদের রান্না করার জন্য স্টোভ ও বাসনপত্র দেওয়া হয়েছে। তবে এই রেশন পরিবারপিছু নাকি মাথাপিছু দেওয়া হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
এ ব্যাপারে দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, ‘বাসিন্দাদের রেশন দেওয়া হলেও এলপিজি গ্যাস (রান্নার গ্যাস) দেওয়ার ব্যাপারে আপাতত কোনো সিদ্ধান্তের কথা নেওয়া হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। ফলে স্টোভে কতদিন রান্না করা সম্ভব?’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে আসা এসব মানুষের খাবারের জোগান সরকার যদি না দিতে পারে, তাই আমরা চেয়েছিলাম, আপাতত ব্যবস্থা করে দিতে। কিন্তু সরকার সেই দায়িত্ব নিজেই নিয়েছে। সুতরাং এখন এই দুর্দশার চিত্র আমাদের দেখা ছাড়া আর কী করার আছে?’