রোহিঙ্গাদের ‘প্রস্থানে’ কি সু চির পতন?

অগ্নিশিখায় ছেয়ে যাওয়া গ্রামগুলোর প্রথম ছবি স্যাটেলাইটে ধরা পড়ে ২৫ আগস্ট। মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে মুসলিম জঙ্গিদের হামলার পর একের পর এক পুড়িয়ে দেওয়া হয় গোটা পৌর এলাকাই।
দ্রুতই প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে শরণার্থীদের নতুন ঢল নামে। সেনাবাহিনীর দৃশ্যত বদলা থেকে বাঁচতে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। সেই শরণার্থীরা সাহায্যকর্মীদের জানিয়েছেন, সেনারা তাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয় এবং পালানোর পথে স্থল মাইন পুঁতে রাখে। তাদের মতে, মিয়ানমারের সেনারা পলায়নপর রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।
রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাদের আক্রমণের ঘটনা এটাই প্রথম নয়। তবে এবারেরটা আগেকার সব মাত্রাকে ছাড়িয়েছে। এই হামলার পরের তিন সপ্তাহে দুই শতাধিক গ্রাম পোড়ানো হয়েছে। শরণার্থী ক্যাম্পগুলো কানায় কানায় ভরে দিয়েছে চার লাখ ২০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা, যাদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই শিশু। এমন বাস্তবতায়ও মানবিক সহায়তা সংস্থা ইউনিসেফ ও মেডেসিনস সানস ফ্রন্টিয়ারসকে (এমএসএফ) সংঘাতপীড়িত এলাকায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান এই সংকটকে 'জাতিগত নির্মূলকরণের ধ্রুপদী উদাহরণ' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
এই সংকটে মিয়ানমারের একটি কণ্ঠ একেবারেই নীরব। মানবাধিকারের প্রতীক ও নোবেলজয়ী, বর্তমানে মিয়ানমারের বেসামরিক সরকারের কার্যত নেতা অং সান সু চি এই নৃশংসতার নিন্দা জানাননি। কিন্তু অন্য নোবেলজয়ীরা ছিলেন ঠিক বিপরীত। পাকিস্তানি মানবাধিকারকর্মী মালালা ইউসুফজাই বলেন, তাঁর (সু চি) মুখ থেকে কথা শোনার জন্য 'বিশ্ব অপেক্ষা করছে'। দক্ষিণ আফ্রিকার যাজক ডেসমন্ড টুটু আশা প্রকাশ করে বলেন, সু চি 'আবার সাহসী ও আগের ভূমিকায় ফিরবেন'। কিন্তু সু চি তা না করে, উল্টো 'অপতথ্যের প্রচারণা'কে দুষলেন এবং ঘোষণা দিলেন সেপ্টেম্বরের শেষের দিনগুলোতে অনুষ্ঠেয় (যেটা এখন চলছে) সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেবেন না।
অবশেষে, প্রথম গ্রামটি পোড়ার ২৫ দিন পর, সু চি বিশ্বকে বার্তা দিলেন। সেনা কর্মকর্তা ও বিদেশি কূটনীতিকদের সামনে মিয়ানমারের রাজধানী থেকে টেলিভিশনে সারা বিশ্বের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সু চি সেনাবাহিনীর সমালোচনা করেননি। রোহিঙ্গাদের কাছে যাওয়ার বদলে সু চি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের আহাজারিকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেন। তিনি বলেন, তাঁর সরকার রাখাইনে গ্রাম পোড়ার খবরে 'উদ্বিগ্ন'। তবে ব্যবস্থা নেওয়ার আগে তাঁদের 'অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগ' শুনতে হবে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত সংঘাতপীড়িত এলাকার চেয়ে আক্রান্ত হয়নি এমন এলাকার দিকে বেশি নজর দেওয়া। তিনি দাবি করেন, 'এটা খুবই কম আলোচিত যে, রাখাইন রাজ্যের বেশির ভাগ মুসলিম প্রস্থান করেনি। এটা খুবই বেদনাদায়ক যে, আমাদের কূটনৈতিক সম্প্রদায়ের সামনে আমাকে শুধু আমাদের ক্ষুদ্র কিছু সমস্যাতেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হচ্ছে।' তাঁর এই বক্তব্যে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা গেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক কেনেথ রোথ বলেন, ‘তাঁর বক্তৃতার মধ্য দিয়ে জাতিগত নির্মূলকরণকে ব্যাপকভাবে বৈধতা দেওয়া হয়েছে।’
এভাবেই আইকনদের পতন হয়। যুক্তরাষ্ট্র সু চিকে শুধু তাঁর দেশের ত্রাণকর্তা বলেই ক্ষান্ত হয়নি; তাঁকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মডেলও বলেছে। তাঁর অধীনস্থ বার্মার (যদিও অনেক দিন ধরে মিয়ানমার হিসেবে সুপরিচিত) কাছে আশা ছিল জাতিসংঘের। কিন্তু তাঁর কাছে এখন অন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সময়কার সহকারী জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বেন রোডস বলেন, ‘তিনি এখন পরিবর্তনশীল বার্মায় ভেবেচিন্তে নিজেকে রাজনীতিক ক্রীড়নকে পরিণত করেছেন, সেই আইকনটি নয়, যা মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে।’
‘বার্মায় অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংস্কারে তাঁর একদেশদর্শী লক্ষ্য খুবই ভয়ানক ও বেদনাদায়ক অন্ধত্ব তৈরি করেছে।’
খ্যাতির চেয়ে বেশি কিছু নষ্ট হচ্ছে। ভারত, চীন ও থাইল্যান্ড পরিবেষ্টিত, যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের চেয়ে দ্বিগুণ মিয়ানমারে এই অস্থিরতার সুযোগে গণতান্ত্রিক সংস্কারে থাকা সরকারের দখল নিতে পারে সেনাবাহিনী। মুসলিমদের ওপর নিপীড়নকে নিয়োগের হাতিয়ার হিসেবে দেখছে সন্ত্রাসীরা। আল-কায়েদা জঙ্গিরা এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নের দায়ে মিয়ানমারকে শাস্তি দেওয়ার হুমকি দিয়ে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙতে চাপ দিয়েছে। আর চীন বঙ্গোপসাগরে কৌশলগত প্রবেশাধিকার নিশ্চিতে রাখাইনে অর্থনৈতিক ফায়দা লুটতে ব্যস্ত। সু চির শক্ত অবস্থানের ওপর নির্ভর করতে পারে লাখ লাখ মানুষের জীবন।
গণতন্ত্রের পথ প্রায়ই কণ্টকাকীর্ণ। মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে অসংখ্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ দিনকার গৃহযুদ্ধ ছাড়াও সাংবিধানিক পরিবর্তনে ভেটো ক্ষমতা থাকা সেনাবাহিনীর জেনারেল ও ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠা বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদীদের চাপে আছেন সু চি। ‘আমেরিকা প্রথম’ পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে চলা ট্রাম্প প্রশাসনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তারা কীভাবে প্রথমবারের মতো সামনে আসা গোষ্ঠীগত একটি সংঘাতকে মোকাবিলা করবে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে কিছু আইনপ্রণেতা মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে চান এবং তাঁরা ওবামার আমলে সূচিত হওয়া সীমিত সামরিক সম্পর্কেরও অবসান চান। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ মিয়ানমারের সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে অগতানুগতিক একটি বিবৃতি দিয়েছে। তবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দিকে চোখ রাঙানি দিয়ে কোনো নিষেধাজ্ঞা প্রায় অসম্ভব। কারণ এতে নিশ্চিতভাবেই ভেটো দেবে চীন। আর পুরো সময়টা ধরে রোহিঙ্গাদের ‘প্রস্থান’ অব্যাহত রয়েছে।
বীরদের হারাতে দিতে চায় না বিশ্ব । ৭২ বছর বয়সী সু চি তাঁর দেশের অন্যতম বনেদি পরিবার থেকে আসা। তাঁর বাবা জেনারেল অং সান মিয়ানমারের আধুনিক সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা এবং তিনি ১৯৪০-এর দশকে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তিনি (সু চি) শিশু থাকা অবস্থায় তার বাবাকে হত্যা করে আততায়ীরা এবং তাঁকে শহীদ ঘোষণা দেওয়া হয়। এর পরই দেশটি গৃহযুদ্ধে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে এবং পরবর্তী সময়ে তাঁর মা ভারত ও নেপালে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হন। প্রাপ্ত বয়সে তরুণী সু চি বিদেশি ছিলেন, রাজনীতি নিয়ে পড়েছেন অক্সফোর্ডে; জাতিসংঘের হয়ে কাজ করেছেন নিউইয়র্ক সিটিতে। ১৯৮৮ সালে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) প্রতিষ্ঠা করে পশ্চিমের মানসপটে স্থান করে নেন তিনি। এর পরের ২১ বছরের মধ্যে ১৫টি বছরই তাঁকে রাজনৈতিক বন্দি থাকতে হয়েছে। গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় তাঁর দল ১৯৯০ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়ী হয়। তবে সেনাবাহিনী সেই জয় স্বীকার করতে চায়নি। কিন্তু এর পরও হাল ছেড়ে না দিয়ে বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন বেড়ার ভেতর থেকে গণতন্ত্রের পক্ষে বক্তব্য দেন তিনি। এ অবস্থায় সাময়িক মুক্তি পেয়ে তিনি ব্রিটেনের মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়া স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে যাননি। কারণ তিনি জানতেন, দেশ ছাড়লে সামরিক শাসকরা তাঁকে ফিরতে দেবে না।
২০১০ সালে মুক্ত হওয়ার পর মিয়ানমারে গণতন্ত্র সম্ভব বলে আশা করেছিলেন অনেকে। ওবামা তাঁকে (সু চি) ‘আমার হিরো’ হিসেবে আখ্যা দেন।
১৯৯১ সালে নোবেল পাওয়ার ২১ বছর পর নরওয়ের অসলোতে দেওয়া বক্তব্যে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার একটি অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করে সু চি বলেন, ‘নোবেল কমিটি যখন আমাকে শান্তির জন্য পুরস্কার দেয়, তারা এটা স্বীকার করে যে, বার্মায় নির্যাতিত ও প্রান্তিক লোকজনও পৃথিবীর অংশ। শান্তির জন্য নোবেল আমাদের হৃদয়ে একটি দরজা খুলে দিয়েছে।’
কিন্তু সু চির নোবেল গ্রহণের আগের সময়টা ছিল খুবই ভয়ানক। ২০১২ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মুসলিম গ্রামগুলোতে সমন্বিতভাবে সরকারি হামলা, পাইকারি হারে গ্রেপ্তার ও রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক স্থানান্তরের চিত্র তুলে ধরে। যখন সু চি কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল গ্রহণ করেন, তখনো হাজার হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে যায়।
সু চি মিয়ানমারের আইনপ্রণেতা হওয়ার তিন বছর পর ২০১৫ সালে ২৫ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় মিয়ানমারে। তাঁর দলে বিপুল ভোটে জয় লাভ করে। সু চি প্রধানমন্ত্রীর প্রায় সমমর্যাদার পদ রাষ্ট্রীয় পরামর্শক হন।
কিন্তু এর পরও তাঁর ক্ষমতা সীমিত। গণতন্ত্র কারোর আকাঙ্ক্ষার চেয়ে বেশি ভঙ্গুর। ২০০৮ সালে ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তার তৈরি সংবিধানে সেনাবাহিনীকে পার্লামেন্টে ২৫ শতাংশ আসন দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সাংবিধানিক যেকোনো পরিবর্তনে ভেটো ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
২০১৬ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে সু চি বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি তুলে ধরতে তাঁর দেশের ‘জায়গা’ দরকার। তিনি বিভিন্ন দেশের কর্তাব্যক্তিদের রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার না করার অনুরোধ করেন। ওবামা সরকারের আমলে মিয়ানমারে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ডেরেক মিচেল বলেন, ‘তিনি (সু চি) সব সময়ই মনে করতেন, বার্মার বাইরের লোকজন রোহিঙ্গা সমস্যার জটিলতা বুঝবেন না।’
‘তিনি বোঝানোর চেষ্টা করতেন। তিনি কৌশলগত যোগাযোগে সফলতা দেখাতে পারেননি।’
মানবাধিকারকর্মীদের মতে, এই সময়ের মধ্যে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক রোথ বলেন, ‘সেনাবাহিনীর প্রতি বার্তা হলো, নামমাত্র গণতান্ত্রিক সুবিধা দিয়ে তোমরা চলে যাও, অং সান সু চিকে সামনে আনো, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে চালানো নিপীড়ন বন্ধ করতে হবে না এবং নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে।’
ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ নেতা পোপ ফ্রান্সিসের নিযুক্ত মিয়ানমারে ইয়াঙ্গুনের কার্ডিনাল চার্লস মং বো বলেন, এই পর্যায়ে এসে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীকে সামলানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘অং সান সু চি টাঙ্গানো দড়ির ওপর দিয়ে হাঁটছেন। ইতিমধ্যেই অশুভ শক্তিগুলো সেনাশাসন ফেরানোর জন্য গোলপাকানো শুরু করে দিয়েছে।’