স্কুল শিক্ষার্থীদের ‘মস্তিষ্ক প্রশিক্ষণ’ কতটা কার্যকর?

স্কুল শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের ধাঁধা ও অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে ‘মস্তিষ্ক প্রশিক্ষণ' দিয়েছিলেন কগনিটিভ বিজ্ঞানীরা। তাদের একাংশের দাবি, এর ফলে শিশুদের কার্যকরী স্মৃতি অনেক কর্মক্ষম হয়েছে।
করোনা মহামারির সময় সুরক্ষার খাতিরে বাড়ি থেকে লেখাপড়া করার বিষয়টি চালু হয়, যার গুরুতর প্রভাব পড়েছে সারা বিশ্বের শিশু ও কিশোর-কিশোরদের লেখাপড়ায়। গবেষণা বলছে, কমেছে মনোযোগ, মনে রাখার ক্ষমতা। পাল্লা দিয়ে কমেছে স্বতঃস্ফূর্ত চিন্তাভাবনার ক্ষমতা৷ তাই, করোনা শুধু স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলেনি, প্রভাব ফেলেছে পড়ালেখাতেও৷ বিশেষ করে, সমাজের নিম্নবিত্ত পরিবারের শিশুদের উপর এই প্রভাব আরও গভীর। এর প্রেক্ষিতেই গবেষকদের একাংশের প্রস্তাব, স্কুলে ‘স্পেশাল ব্রেইন ট্রেইনিং'-এর ব্যবস্থা করলে এই সংকট মোকাবিলা করা যেতে পারে।
‘ওয়ার্কিং মেমোরি মস্তিষ্কের এমন একটি অংশ যেখানে স্বল্পমেয়াদে নানা তথ্য বিশ্লেষিত হয়৷ মূলত কিছু শিখতে গেলে, যৌক্তিক কোনো বিশ্লেষণ বা সমস্যার সমাধানে আমাদের এই অংশটি কাজে লাগে। সচরাচর অঙ্কের উত্তর না মিললে বা কোনো সমস্যার যৌক্তিক সমাধান না পেলে মানুষের মনে হয়, এই অংশটি কাজ করা বন্ধ করে দেয়৷ মস্তিষ্ক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিগুলি এই অংশের দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা করে।
ব্রিটেনের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ববিদ ও শিক্ষা সংক্রান্ত গবেষক টমাস পেরি ডিডাব্লিউকে জানান, ‘‘কোনও কোনও শিক্ষার্থীর এই ‘ওয়ার্কিং মেমোরি'র ক্ষমতা কম হয়৷ শিক্ষার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।’’
জার্মান গবেষণায় দাবি, মস্তিষ্ক-প্রশিক্ষণে শিশুদের শেখার ক্ষমতা বাড়ে
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দাবি করা হয়েছে, ১২ ঘণ্টা মগজের ব্যায়াম শিশুদের মনোযোগ, আইকিউ অনেকাংশেই বৃদ্ধি করেছে। যার প্রভাব পড়েছে দীর্ঘকালীন শিক্ষার ক্ষেত্রেও।
তিন বছর ধরে ৫৭২ জন জার্মান স্কুলশিক্ষার্থীর উপর চালানো হয়েছে এই গবেষণা। তাদের বয়স ছয় থেকে সাত বছরের মধ্যে৷ গবেষণায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক রুটিনের অঙ্ক বা জার্মান ক্লাসে অংশগ্রহণ করেনি। তাদের দৈনিক ১২ ঘণ্টা করে পাঁচ সপ্তাহের ‘ব্রেন ট্রেনিং’ হতো। বাকিরা স্বাভাবিক ক্লাস করেছে। এই প্রশিক্ষণ নেয়া শিশুদের পরবর্তী এক বছরে ‘ওয়ার্কিং মেমোরি' অনেকাংশেই বৃদ্ধি পেয়েছে। তিন বছর পরে গবেষকরা দেখেছেন, অন্যদের তুলনায় ওই শিশুদের সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তি হওয়ার সম্ভাবনা অন্তত ১৬ শতাংশ বেশি৷ সচরাচর এই সম্ভাবনা থাকে গড়ে ৩০ শতাংশ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে তা বেড়ে হয়েছে ৪৬ শতাংশ।
সুইডেনের কারোলিনস্কা ইনস্টিটিউটের নিউরোসায়েন্টিস্ট টরকেল ক্লিনবার্গ বলেন, ‘‘এই প্রশিক্ষণে শুধু ‘ওয়ার্কিং মেমোরি' বেড়েছে তা নয়, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও আইকিউ-ও বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকটা। যা বেশ বিস্ময়কর।’’
অ্যাপের মাধ্যমে মস্তিষ্ক প্রশিক্ষণ কি কার্যকরী
বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলনের মাধ্যমে শিশুদের এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া, ‘নুরো’ নামে একটি অ্যাপও ব্যবহার করা হয়। গবেষকদের একাংশের দাবি, এই অ্যাপ মস্তিষ্কের শেখার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে। তবে তা নিয়ে এখনও আরও গবেষণা প্রয়োজন বলেই মনে করেন টমাস পেরি৷ তিনি বলেন, ‘একটি মাত্র গবেষণার ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। বিভিন্ন স্কুলে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই গবেষণা চালাতে হবে।’
বিভিন্ন স্কুলে প্রায় ৪০০টি বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণায় যুক্ত ছিলেন পেরি৷ ব্রিটেনের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ক্লাসরুমের বাইরে এই ধরনের গবেষণা কাজ করে ভাল৷ কিন্তু শ্রেণিকক্ষে এটি প্রয়োগ করতে গেলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায় না৷ যেমন অ্যামেরিকার স্কুলগুলিতে এই ধরনের মস্তিষ্ক প্রশিক্ষণ প্রকল্পের প্রয়োগে বিশেষ ফল পাওয়া যায়নি৷ পেরি বলেন, ‘একটি গবেষণা থেকে নির্দিষ্ট একটি চিত্র উঠে এসেছে যে ওয়ার্কিং মেমোরি ট্রেনিং নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে হয়তো কার্যকর, কিন্তু অন্যান্য গবেষণায় কোনও প্রভাব দেখা যায় না।' কিছু গবেষকের দাবি, ‘ওয়ার্কিং মেমোরি' ট্রেনিং সার্বিকভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ কতটা ঘটায় তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
পেরি ভরেন, ‘‘দীর্ঘদিন ধরে আহরিত জ্ঞান থেকে তৈরি হয় বিশ্লেষণমূলক চিন্তাভাবনার দক্ষতা৷ সুতরাং, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিশুদের কার্যকরী স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করলেও তা তাদের কতটা বুদ্ধিমান করে তুলবে, প্রশ্ন থেকেই যায়৷''