হাজিদের নিরাপত্তায় এআই, ড্রোন ও হাজারো ক্যামেরা

পবিত্র হজের সময় লাখো মানুষের সমাবেশ নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে পরিচালনা করতে সৌদি আরবের কর্মকর্তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি, ড্রোন ও ১৫ হাজারেরও বেশি ক্যামেরার একটি বিশাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছেন। রাতদিন মানচিত্র, পর্দা ও অসংখ্য তথ্যের স্তূপের সামনে কাজ করে চলেছেন তারা, যা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এই ধর্মীয় সমাবেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
মক্কা ও তার আশপাশে স্থাপন করা ১৫ হাজারেরও বেশি ক্যামেরা থেকে আসা বিপুল পরিমাণ ভিডিওচিত্র বিশ্লেষণে এআই প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এই ব্যবস্থা এমনভাবে প্রস্তুত করা হয়েছে, যাতে ভিড়ের অস্বাভাবিক চলাচল শনাক্ত করা যায় বা পথচারীদের গমনপথে কোনো স্থান ‘জটিল’ হয়ে উঠছে কিনা, তা আগেভাগে নির্ধারণ করা যায়। অতীতে ভয়াবহ পদদলনের ইতিহাস থাকা জমায়েতে এই প্রযুক্তি জীবনরক্ষার ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ধর্মীয় সমাবেশ চলাকালে পবিত্র স্থানগুলোর মধ্যে হজযাত্রীদের আনা-নেওয়ার কাজে নিয়োজিত ২০ হাজারেরও বেশি বাস পরিচালনায়ও ব্যবহার করা হচ্ছে সফটওয়্যারভিত্তিক প্রযুক্তি। এ বছর বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আগত ১৪ লাখের বেশি ধর্মপ্রাণ মুসলমান যখন মক্কা ও তার আশপাশে জড়ো হচ্ছেন, তখন তাদের নির্বিঘ্ন যাত্রা নিশ্চিত করতে সৌদি আরব এ ধরনের নানা প্রযুক্তিগত উপকরণ কাজে লাগাচ্ছে।
রয়্যাল কমিশন ফর মক্কার আওতাধীন জেনারেল ট্রান্সপোর্ট সেন্টারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজির বলেন, ‘আমাদের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কক্ষে এমন বিশেষায়িত ক্যামেরা রয়েছে, যাতে এআই স্তর সংযুক্ত; যা চলাচল, ভিড়ের স্থানসমূহ বিশ্লেষণ করে এবং আচরণ পূর্বাভাস দিতে পারে।’ মক্কায় সংস্থাটির একটি মূল নিয়ন্ত্রণ কক্ষে পর্দা ও মানচিত্রে ঘেরা ঘরে উচ্চপ্রযুক্তির সরঞ্জাম ব্যবহার করে দিন-রাত নজরদারি চালান কর্মীরা। প্রায় ডজনখানেক কর্মী সারি সারি ডেস্কটপ কম্পিউটারের সামনে বসে পবিত্র স্থানগুলোর আশপাশে জনস্রোতের গতি নিরীক্ষণ করেন।
পাহাড়ি পথ ঘেঁষে থাকা হজ রুটজুড়ে (মক্কা থেকে মিনা, মুজদালিফা হয়ে আরাফাত পর্যন্ত বিস্তৃত ২০ কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ পথ) ছোট সাদা রোবটের মতো দেখতে ক্যামেরাগুলো ভবন, সড়ক ও পথের ভিডিও ধারণ করে। নাজির জানান, হজের পথগুলোতে গাড়িচাপার মতো দুর্ঘটনা এড়াতে ও মরু অঞ্চলের প্রচণ্ড গরমে হাঁটার সময় কমিয়ে আনতে পর্যাপ্ত বাস সরবরাহ নিশ্চিতে এসব ক্যামেরা ও সফটওয়্যার ব্যবহার করা হচ্ছে।
পরিবহণ কেন্দ্রের হজ ও সারা বছরের ওমরাহ বিষয়ক তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ আলুকারনি বলেন, নিয়ন্ত্রণ কক্ষই আমাদের মাটির চোখ। তিনি জানান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থাটি পবিত্র স্থানগুলোর দিকে গমনপথে যাত্রার প্রবাহ নির্ধারণে সাহায্য করে, এমনকি জরুরি পরিস্থিতি ঘটার আগেই তা সনাক্ত করতে পারে। একই সঙ্গে কোনো নির্দিষ্ট স্থানে কত মানুষ জমায়েত হয়েছেন, সেটিও নিরূপণ করতে পারে প্রযুক্তিটি।
কারনি জানান, ক্যামেরা ও এআই মিলে বুঝে নিতে পারে কোনো স্থান সর্বোচ্চ ধারণক্ষমতায় পৌঁছে গেছে কিনা—তখন কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন অনুযায়ী যাত্রীপ্রবাহ অন্যদিকে সরিয়ে দিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, চলতি বছরের রমজানে যখন দেখা গেল মসজিদুল হারাম পূর্ণ হয়ে গেছে, তখন এ ব্যবস্থা তৎক্ষণাৎ বিষয়টি শনাক্ত করে হারামে প্রবেশ বন্ধ করে দেয় ও প্রবেশপ্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালনা করা হয়।
প্রযুক্তির ব্যবহার শুধু যানব্যবস্থাপনা ও জননিয়ন্ত্রণেই সীমাবদ্ধ নয়; পূর্বনিবন্ধনবিহীন অবৈধ হজযাত্রীদের নজরদারিতেও তা ব্যবহৃত হচ্ছে। সৌদি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত বছর হজে তীব্র দাবদাহে মারা যাওয়া এক ৩০১ জনের বেশির ভাগই ছিলেন অননুমোদিত তীর্থযাত্রী, যাদের জন্য শীতাতপনিয়ন্ত্রিত তাঁবু বা বাসের ব্যবস্থা ছিল না।
২০২৪ সালের হজ মৌসুমে তাপমাত্রা ৫১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১২৫ দশমিক ২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এবারও সপ্তাহজুড়ে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে পূর্বাভাস রয়েছে।
অননুমোদিত প্রবেশ ঠেকাতে এবার সৌদি আরব ক্যামেরা-সংবলিত ড্রোনের একটি বহর দিয়ে মক্কায় প্রবেশপথসমূহ নজরদারির আওতায় এনেছে। সৌদি আরবের জননিরাপত্তা বিভাগের মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল মোহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ আলুবাসসামি সাংবাদিকদের বলেন, আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পাশাপাশি ড্রোন ও তাপ-চিত্রগ্রহণ ক্যামেরা ব্যবহার করছি।
এদিকে সৌদি আরবের সড়ক নিরাপত্তা বিশেষ বাহিনী জানিয়েছে, তারা মক্কা ও পবিত্র স্থানগুলোর চারপাশে ‘স্মার্ট থার্মাল ইমেজিং’ পদ্ধতি ব্যবহার করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।