শিল্পী এস এম সুলতান কেবল একজন চিত্রকর নন, তিনি ছিলেন একজন দার্শনিক, একজন নির্লোভ সৃষ্টিশিল্পী, যিনি বেছে নিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জীবন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও খ্যাতির হাতছানি থাকলেও তিনি পিছু ফেরেননি। ফিরেছেন তাঁর প্রিয় নড়াইলে—যেখানে নদী, ধানক্ষেত, কৃষক আর শিশুদের মাঝে খুঁজে পেয়েছেন শিল্পের প্রকৃত সুর।

এস এম সুলতান ছিলেন এমন এক শিল্পী, যিনি ধ্বংসপ্রবণ শহর ও যান্ত্রিকতার বিপরীতে তুলে ধরেছিলেন প্রকৃতি, শ্রম ও মানবতার সৌন্দর্য।

সুলতানের জন্ম ১৯২৩ সালের ১০ আগস্ট, সে সময়ের যশোর জেলার (বর্তমানে নড়াইল) মাছিমদিয়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ মেহের বক্স, যিনি ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রি। খুব অল্প বয়সেই সুলতান পিতার সঙ্গে নির্মাণকাজে যেতেন। সেখানেই শুরু হয় তাঁর গঠনশৈলীর প্রতি আকর্ষণ—ইট, কাঠ, বাঁশ দিয়ে ছবি আঁকার প্রবণতা।

বিভিন্ন অভাব-অনটনের মধ্য দিয়েও তিনি নিজের সৃষ্টিশক্তিকে হারাতে দেননি। কখনো স্কুলে পড়াশোনা ঠিকমতো করতে পারেননি, তবু শিল্পের প্রতি গভীর অনুরাগই তাঁকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।

১৯৪৪ সালে বহু চেষ্টার পর তিনি কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে (বর্তমান গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট) ভর্তি হন। তবে, প্রচলিত শিক্ষা-পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে খুব বেশি দিন সেখানে থাকতে পারেননি। তাঁর জীবনের বেশিরভাগ অংশই ছিল স্বশিক্ষায় গড়া।

১৯৪৬ সালে তাঁর প্রথম একক চিত্রপ্রদর্শনী হয় লাহোরে। এরপর তিনি আমন্ত্রিত হন আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন প্রদর্শনীতে। ১৯৫০-এর দশকে কেমব্রিজ, লন্ডন, নিউইয়র্কসহ ইউরোপের বিভিন্ন গ্যালারিতে তাঁর চিত্র প্রদর্শিত হয়। তিনি ‘রকফেলার ফাউন্ডেশন’-এর স্কলারশিপে নিউইয়র্কে অবস্থান করেন এবং ওখানে কিছু সময় কাটিয়ে ফিরে আসেন পূর্ব বাংলায়।

সুলতানের আঁকা ছবির প্রধান বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমজীবী মানুষ ও তাঁদের সাথে প্রকৃতির অনিবার্য সম্পর্ক। তাঁর ছবিতে মানুষের শরীর হঠাৎ করে বড়—পেশিবহুল, কর্মঠ, যেন তারা শুধু শস্য ফলায় না, মাটিকেও সোনায় রূপান্তর করে। এই ‘অতিকায় মানবদেহ’ তাঁর শিল্পের প্রধান স্বাক্ষর হয়ে ওঠে। তিনি কৃষকের মুখে গর্ব দেখিয়েছেন, কষ্ট নয়। তাঁরা যেন প্রকৃতির প্রতিভূ—মাটি, আকাশ আর জল একসূত্রে বাঁধা তাঁদের সাথে।

সুলতানের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, কৃষকই জাতির আসল নির্মাতা। তাঁর ভাষায়

“কৃষকরা জাতির রিয়েল ইন্টেলেকচুয়াল। আমি তো তাদেরই মহিমা আঁকি।”

বিশ্বভ্রমণ শেষে তিনি স্থায়ীভাবে ফিরে আসেন তাঁর জন্মস্থান নড়াইলে। তিনি বেছে নেন এক নিঃস্ব, অথচ আত্মমর্যাদায় ভরপুর জীবন। নগরের কোলাহল থেকে দূরে থেকে শিশুদের জন্য গড়ে তোলেন “শিশুস্বর্গ”—একটি অলাভজনক স্কুল, যেখানে শিশুরা আপন খেয়ালে প্রকৃতির সাথে মিশে চিত্রাংকন, সঙ্গীত, সাহিত্য ও মানবিকতা শেখে।

এই বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ছিল—নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষা নয়, বরং শিশুদের মধ্যে সৃজনশীলতা ও স্বাধীন চিন্তা জাগানো। তিনি বলতেন—

“বাচ্চাদেরকে প্রকৃতির কোলে এনে শেখাতে হবে। স্কুলে বন্দি রেখে নয়।”

সুলতানের তুলিতে শুধু ছবি আঁকা হয়নি—তিনি সৃষ্টি করেছেন এক নিজস্ব চিত্রভাষা। কোনো ছবির নাম ‘Char Dakhal’ বা ‘অধিকার’—যেখানে কৃষকরা ভূমির ওপর দাঁড়িয়ে দাবির ভঙ্গিতে হাত তোলে। আবার ‘জলে ডুবে’ বা ‘ক্লান্ত শরীর’— এইসব নাম যেন বর্ণনা করে বাংলার জীবনসংগ্রাম ও স্বপ্নের গল্প।

প্রকৃতি, নদী, নারী, শিশু, গরু-মহিষ—সবই তাঁর ছবিতে স্থান পেয়েছে; তবে তার সবকিছুর কেন্দ্রে ছিল মানুষ।

বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক মহলে সুলতানের অবদান স্বীকৃতি পেয়েছে অনেকভাবে। তিনি পেয়েছেন—একুশে পদক (১৯৮২), স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৮৪), বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদের আজীবন সদস্যপদ, চিত্রশিল্পে অসামান্য অবদানের জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা। তবে এগুলো তাঁকে বিশেষভাবে টানেনি। তিনি বিশ্বাস করতেন—প্রকৃত পুরস্কার মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকা।

১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর এই মহৎ শিল্পী পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তাঁকে সমাহিত করা হয় তাঁর প্রিয় নড়াইলেই। তবে তিনি আজও বেঁচে আছেন তাঁর চিত্রকর্মে, দর্শনে, শিশুস্বর্গে, আর বাঙালির হৃদয়ের গভীরে। তাঁর স্মৃতিকে ধরে রাখতে নড়াইলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এস এম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা, যেখানে সংরক্ষিত রয়েছে তাঁর কিছু শিল্পকর্ম, ব্যবহৃত বস্তু ও স্মৃতিচিহ্ন।

এস এম সুলতান ছিলেন বাংলার মাটির সন্তান, যিনি শিল্পকে ব্যবহার করেছেন একটি দার্শনিক ও মানবিক শক্তি হিসেবে। তাঁর চিত্রকর্মে ফুটে ওঠে শ্রমজীবী মানুষের শক্তি, প্রকৃতির সৌন্দর্য, শিশুর নিষ্পাপ হাসি ও বাংলার আত্মা।

আজকের যান্ত্রিক ও ভোগবাদী সমাজে সুলতানের জীবন ও কাজ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়—আসল শিল্প সে-ই, যা মানুষের পাশে দাঁড়ায়, যা প্রকৃতিকে ভালোবাসে, যা হৃদয়ের স্পর্শে তৈরি হয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক