শিল্পী এস এম সুলতান : নতুন নিরিখে

এস. এম সুলতান আমাদের চিত্রশিল্পের ইতিহাসে এমনই একজন সিদ্ধসন্তান, যিনি বুনো আগাছার মতো জন্ম নেয়া মনুষ্যজীবনের অন্তর্গত শক্তিকে তুলে আনতে পেরেছেন বলিষ্ঠ মেধায়। কৃষকের সন্তান লাল মিয়া। শিল্পী জীবনে হয়ে গেলেন এস এম সুলতান। দোর্দণ্ড প্রতাপের সাথে যুদ্ধ করলেন জীবনের সঙ্গে, প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে। জয়ী হলেন। মাথা উঁচু করে পরাক্রমশালী সুলতানের মতোই ফিরে এলেন জন্মভূমির কাছে। সব মোহ, লোভ, সম্পদ, পরাভূত হলো তাঁর দৃপ্ত প্রত্যয়ের কাছে। নিবিড় ঠিকানা খুঁজে নিলেন নড়াইলের চিত্রা নদীর পাড়ে, যেখানে তাঁর জন্ম, যেখানে তাঁর বিলয়। না প্রকৃতপক্ষে বিলয় বোধ হয় ঘটেনি; বিলয় ঘটেনি বলেই তো বারবার তিনি ফিরে আসেন আমাদের অস্তিত্বের কাছে, চেতনার কাছে, ঐতিহ্যের কাছে।
বিশ্বখ্যাত লেখক, চিত্রশিল্পী গুন্টার গ্রাস একবার ঢাকায় এসে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে সুলতানের ছবির যথার্থ মূল্যায়ন দেখতে না পেয়ে মন্তব্য করেছিলেন- “সুলতানকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশ হয় না।”[১] কত বড় সাংঘাতিক কথা! ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। গুন্টার গ্রাসের এই অবিস্মরণীয় উক্তির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করলে সুলতানের অবস্থান ও গুরুত্ব আমরা অনুধাবন করতে পারি। বাংলাদেশ চিরায়ত যুদ্ধের দেশ, নদীমাতৃক সবুজ সুষমাসজ্জিত ফল-ফসলের দেশ, যে দেশটি দাঁড়িয়ে আছে তার লোকজ ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ইতিহাস; কৃষক, শ্রমিক, মজুরের কঠিন আত্মত্যাগ, সংগ্রাম মুখর প্রবণতার ওপর। সেই দেশের সার্থক সন্তান সুলতান। পৃথিবীর কাছে এই ঐতিহ্যময় বাংলাকে যে অকৃত্রিম ও বলিষ্ঠ ভাবে তুলে ধরতে পারে তাঁকে বাদ দিয়ে সত্যিই তো বাংলাদেশ হয় না।
বাংলার লোকজ জীবন সর্বপ্রথম ধরা পড়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের তুলিতে। এ ক্ষেত্রে তিনি সুলতানের পূর্বসূরী। জয়নুলের চেয়ে সুলতানের লোকজীবন অধিক শক্তিমান ও সংগ্রামমুখর। জয়নুলের ছবিতে বাংলার বিপর্যস্ত জনজীবন আছে। দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা আছে, অভাব-দারিদ্র্য আছে, গরীবের মুখ আছে। সেখানে সুলতানের ছবিতে আছে বাংলার লোকজ জীবনের অমিত শক্তি, সকল প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে মাথা উঁচু দাঁড়ানোর শক্তিময়তা। এখানেই জয়নুল থেকে সুলতানের ভিন্নতা। যদিও সুলতান স্বীকার করেছেন জয়নুল তাঁর শিক্ষক-শিক্ষাগুরু।
বাঙালি বীরের জাতি, বারবার তারা অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, সকল অপতৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে জীবনকে বাজি রেখে ছিনিয়ে নিয়েছে তার অধিকার। সুলতানের ছবিতে তারই প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে বারবার। এ কারণেই আমরা তাঁর ছবিতে কৃষকের মাংশলপেশী, বিশাল দেহ, বিশাল ক্যানভাসে এক উৎসবমুখর যাত্রাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করি। কৃষকরাই আমাদের অহঙ্কার, আমাদের শক্তি, সকল ঔপনিবেশবাদ, বুর্জোয়াদের চক্রান্ত পরাজিত হয়েছে বাংলার কৃষকের অমিততেজা শক্তির কাছে। তারা কিন্তু রাজনীতি বোঝে না। শুধু তাদের অধিকার আদায়ের জন্য শড়কি-বল্লম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, জমিকর্ষণ করে, মনের অফুরন্ত শক্তির জোরে সোনার ফসল ফলায় মাঠে, আর তাতেই সম্মৃদ্ধ হয় দেশ। মাটির মানুষেরা মাটির সঙ্গেই যুদ্ধ করে টিকে থকে, এরা দৃশ্যত হাড্ডিসার হলেও তাদের ভেতরের শক্তি অমেয়। এ কারণে সুলতানের ছবিতে কৃষক, বলদ, মাঝি, এমন কি রমণীদেরকেও আমরা বিশাল, মাংশলপেশী সম্মৃদ্ধ অবস্থায় দেখি, যা সাধারণত বেমানান-অবাস্তব মনে হতে পারে অনেকের কাছে। এ প্রসংগে শিল্পী নিজেই বলেছেন, “আমার নিমক হলো কৃষক। আমি যদি লাঙলের মুঠি ধরে বসে থাকি তো আমাদের চাষ হবে না। আমাকে চাষ করতে গেলে এমন জমি করতে হবে যে মাটিতে ফসল ফলে। জমিবন্ধ্যা নয়। আর এই ফসলের মাঠ কারা তৈরি করে? আমার বাংলার বলিষ্ঠ কৃষকেরা। আমার গর্ব এই মাটি, এই কৃষক, এই গর্ব দেখাতে হলে আমাকে স্বাস্থ্যবান দেখাতে হবে তাদের। কর্মঠ দেখাতে হবে। বাঙালি চিরকালই কর্মঠ। মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তার সব চিন্তা জমির চাষাবাদ নিয়েই। তাদের আমি বলিষ্ঠ দেখিয়েছি-যেমনটি আমরা নই। যেটা নিয়ে কথা ওঠে। আমার তো উদ্দেশ ওদের আঁকা না! ওদের বলিষ্ঠ সত্তাকে চিহ্নিত করা। কৃষিজীবী মানুষ আমরা, কৃষি প্রধান আমাদের দেশ। এই কৃষক শ্রেণিকে দুর্বল দেখার চোখ আমার নেই। আমি মানুষের ছবি আঁকি, মেহনতি মানুষের। ওরা যত কষ্টে থাকুক না কেন ওরা বলিষ্ঠ। বলিষ্ঠ বলেই ওরা এখনও টিকে আছে। ওদের আঁকি বলেই অনেকে ঠাট্টা করে।’ [২]
শিল্পীর সৃষ্টিকে শিল্পীর জীবনবোধ ও মানসচেতনাকে বিশ্লেষণ করতে হলে শিল্পীর জীবনধারা অনুধাবন করা জরুরি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘কবিকে পাবে না তাহার জীবন চরিতে।’ এটা তিনি ঠিক বলেননি। এটা হয়ত তাঁর ব্যক্তিগত ক্ষণিক উপলব্ধি। কেননা আমরা রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে তাঁর মানসচেতনার বিপুল প্রতিফলন দেখি। শিল্পী এস এম সুলতান বাংলার লৌকিক ঐতিহ্যকে ধারণ করে নিজ মানসকে পরিপুষ্ট করেছিলেন। তাঁর শিল্পে তার ছাপই সুস্পষ্ট। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি যেমন অন্যদের থেকে ভিন্ন, তেমনি তাঁর ছবিও অন্য শিল্পীদের থেকে ভিন্ন। তাঁর আবেগ, চিন্তা, কল্পনা, দ্রোহ, মানবপ্রেম, মাটিপ্রেম, বিশ্বাস, স্বপ্ন একাকার হয়ে গেছে তাঁর রঙ-তুলিতে।
আমরা জানি, দেশ যখন তাঁকে চিনতে পারেনি, তখন সমগ্র ইউরোপ জুড়ে ঘটেছে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি ঘটেছে। ইউরোপ, আমেরিকায় তাঁর ছবির কয়েকটি প্রদর্শনী হয়েছে, যেখানে পিকাসো, মাতিস, মিকাঞ্জেলো, রাফায়েল, ডুফি, ভ্যান গগ, কর্নেট, দালি, ক্লি প্রমুখ বিশ্বখ্যাত শিল্পীদের ছবির পাশেই ছিল তাঁর ছবির অবস্থান। লণ্ডনের বিখ্যাত লিসেস্টার মিউজিয়ামে এশিয়ার মধ্যে তাঁরই ছবি প্রথম স্থান পেয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য মিউজিয়াম, চিত্রশালাতেও সযত্নে রক্ষিত আছে তাঁর ছবি। ল্যান্ডস্কেপে তিনি তুলে ধরেছেন বাংলার জনজীবন, বাংলার প্রকৃতিকে। যেসব ছবি প্রতিনিধিত্ব করেছে বাংলার। কোন বাংলার? কৃষি নির্ভর, গ্রামীণ জীবন নির্ভর সমৃদ্ধ অমিত শক্তিধর বাংলার। বাংলার লোকসমাজের। যে প্রাচ্য ছিল একসময় পাশ্চাত্য থেকে উন্নত, যে ইউরোপ প্রাচ্যের বাংলা থেকে নিয়েছে, শোষণ করেছে সেই ইউরোপ, আগ্রাসী জাতি আমেরিকাকে চোখে তিনি আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়েছেন বাংলার মানুষের অমিততেজা অন্তর্নিহিত শক্তিকে।
সুলতান ঘুরে বেড়িয়েছেন এশিয়া-ইউরোপের পথে পথে। অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন অনন্ত। কিন্তু বরাবরই থেকেছেন তিনি স্বতন্ত্র, অনন্য। অনুপ্রাণিত হয়েছেন, বিশ্ব শিল্পের ইতিহাসকে অনুধাবন করেছেন, প্রভাবিত হয়েছেন কখনও, কিন্তু তা ব্যবহার করেছেন নিজের মতো করে। স্টোক পেইন্টিং এর মতো ভিন্নধারা, নাটকীয় ফিগার তিনি আত্মস্থ করেছেন। কিন্তু বিদেশি শিল্পের ভাণ্ডার থেকে চুরি করেননি। তিনি ইম্প্রেসনিস্ট ধারার ছবি এঁকেছেন। বিশ্ববিখ্যাত সব ছবি নিয়ে তাঁর ধারণা ছিল অন্যরকম। তিনি বলতেন, “পিকাসোর ‘গোয়ের্নিকা’ বিখ্যাত ছবি, কিন্তু কী আছে এই গোয়ের্নিকায়! এর চেয়ে অনেক বড় গোয়ের্নিকা ঘটেছে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে আমাদের দেশে।” তিনি পিকাসোকে পছন্দ করেননি। পছন্দ করেছেন ‘ভ্যানগগ’ ; ‘সেজান’ ; ‘গগ্যাঁ’; ‘মনে’ এর ছবি। কারণ এঁরা ছবিতে তাঁদের মাতৃভূমিকে এঁকেছেন, কৃষকের ছবি এঁকেছেন। ‘মিলে’ এর একটি ছবি আছে 'এ্যাঞ্জেলাস' ; এক কৃষক দম্পতির ছবি। তারা মাঠে কাজ করছে, সন্ধ্যা নেমেছে, প্রার্থনার সময় সমাগত, চার্চে যাওয়ার সময় তাঁদের নেই। তাই মাঠে দাঁড়িয়েই সেরে নিচ্ছে প্রার্থনা। আলাপচারিতায় তিনি এই ছবিটির কথা প্রায়ই বলতেন। এসব শিল্পীর ছবি তিনি পছন্দ করেছেন। কিন্তু এঁদের ছবি থেকে সুলতানের ছবির পার্থক্য আছে। তাঁর ছবিতে যতগুলি ফিগার একসঙ্গে দেখা যায়, উল্লিখিত শিল্পীদের ছবিতে সেটা অনুপস্থিত। তিনি বরাবরই একটা শ্রেণিকে একসঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। কেননা বাঙালির ঐক্য ও সমৃদ্ধি ছিল সমবায় প্রথার মধ্যে। তাঁর ছবিতে এই সমবায়ের সমবেত রূপ পরিস্ফুটিত হয়েছে বারবার। তাঁদের থেকে পার্থক্য আছে রঙের ব্যবহারেও। ইউরোপীয় শিল্পীদের প্রভাব নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমার উপর রেনেসাঁ শিল্পীদের প্রভাব আমি অস্বীকার করি না। রেনেসাঁ শিল্পীরা মানুষকে বড় করে দেখতেন। তাঁরা মনে করতেন মানুষ এত বড় হলে ভালো হয়। ওঁদের এই কনসেপ্টটা আমার ভালো লাগে। আমিও ভাবলাম, আমার কৃষকরাও বিশালদেহী হোক, শক্তি সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক হোক, কিন্তু আমার টেকনিক তো পুরোপুরি ইউরোপীয় নয়। যে এনাটমি আমার মানুষের তা আমার নিজস্ব। এটাকে অনেকে Distortion বলেন, আমি এনাটমি জানি না। কিন্তু ছবি থেকে পরিচিত জগৎ হারিয়ে গেলে তা অবাস্তব হল এমন নয়। তা এমন এক বাস্তবতার সন্ধান দেয় যা হতে পারে স্বপ্নের বাস্তবতা। হয়ত আমি তেমনই এক বাস্তবতার সন্ধানে আছি, যেখানে আমার মানুষগুলো এমনই হবে।’ [৩]
বিভিন্ন সময়ে আর্টের যে ইজমের উদ্ভব ঘটেছে, যেমন এক্সপ্রেশনিজম, ফুতুরাজিয়ম, ফাওভিজম, অফরিজম, সিম্বলিজম, সুপ্রীম্যাটিজম, সিঙ্কোমমিজম, ইম্প্রেশিয়ালিজম, ভেন্টিসিজম, এসব ইজম সম্পর্কে সুলতানের ধারণা ছিল সুস্পষ্ট। পরবর্তীকালে ডাডাবাদ, পরাবাস্তববাদ, জ্যামিতিক বিমূর্ততা, পপ আর্ট, মডার্ন ল্যাঙ্গুয়েজ আর্ট, পোস্টমিনিমালিজম এসব সম্পর্কে ধারণার পাশাপাশি শিল্পের পোস্টমডার্ন যে আন্দোলন সেসব জেনে বুঝেও সুলতান তাঁর নিজের মতো করে একটি ইজম তৈরি করেছিলেন, শিল্প বিশ্লেষক একে বলেন দেশজ আধুনিকতা। এটাকে আবার ঔপনিবেশিক আধুনিকতাও বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু কলোনি থেকে দেশজ চেতনার উন্মেষ ঘটলেও তা একটি সুস্থির রূপদানে সক্ষম নয়। আমি মনে করি দেশজ আধুনিকতা নয়, এটাকে সুলতানিজম বলা যুক্তিযুক্ত। আমার বিশ্বাস সুলতান আধুনিকতার সংজ্ঞাকে পাল্টে দিয়েছেন। সুলতানের ছবিতে আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতার সংমিশ্রন ঘটেছে—এমনটি যদি বলতে হয়, তাহলে বলব সুলতান দোদুল্যমান আধুনিকতা ও অকার্যকর উত্তরাধুনিকতার গড়া যে বৃত্ত, সেই বৃত্তকে ভেঙে বঙ্গীয় চেতনাজাত দর্শন দাঁড় করিয়েছেন।
সুলতানের আধুনিকতা নিয়ে প্রশ্ন ছিল, সংশয় ছিল কথিত চিন্তকদের। সে প্রশ্ন ছিল কখনও প্রকাশ্যে, কখনও আড়ালে। তিনি তাঁদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, "অনেকে আমাকে কঠিন সমালোচনা করে বলেছেন, আমি আধুনিক চিত্রকলা বুঝি না। আধুনিক চিত্রকলা বোঝার মতো পড়াশুনা আমার নেই। আমি তো বলতে গেলে স্কুল পালিয়ে যাওয়া অবাধ্য বালক। স্কুল পালিয়ে যাওয়াটাই হলো আমার school of thought ; এটা কিন্তু কথার কথা নয়। পথে-বিপথে ঘুরতে ঘুরতে আমি আমার সত্তাকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছি—বলতে পারেন এটাই আমার স্কুল। আপনি আমার ছবিতে ভদ্রলোকের মুখ পাবেন না। ভদ্রনারীর কৃত্রিম মুখোশ লাগানো অবয়ব কিংবা পালিশ করা দেহভঙ্গিমা পাবেন না। অনুসূয়া, শকুন্তলা, লক্ষ্মীর মতো মায়াবী মানবীর সন্ধান পাবেন। যে মানবীর মধ্যে শাহরিক আভিজাত্য নেই। বারবণিতার কটাক্ষ পাবেন না। খেঁজুর গাছ, তাল গাছ, নারিকেল গাছ দেখতে পাবেন। আমি আমার ছবিতে টিনের ঘর, পাকা বাড়ি, শানে বাঁধানো পুকুরঘাট, ট্রেনে, বাসে চড়ার যাত্রীকে আবিষ্কার করতে পারবেন না। কারণ ঐ বাহনগুলো আমরা নির্মাণ করিনি—ঐগুলোর সাথে আমাদের যে সম্পর্ক তাহলো দূরাগত সম্পর্ক। আরো সহজে বলতে পারেন, আরোপিত। আরোপিত জিনিসপত্র,মালপত্র আমার হয় কী করে! আমার মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে গিয়েছে শক্তি নিয়ে, দাপট নিয়ে, দক্ষতা নিয়ে। তাঁরা একাত্তরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে দা, বল্লম, ঢাল, সড়কি, লাঠি নিয়ে। কারণ এইগুলো হলো আমার অস্ত্র। রাইফেল, বন্দুক, স্টেনগান, কামান, যুদ্ধবিমান, টর্পেডো এটা তো ধার করা অস্ত্র, আমাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল। আর এইসব ধারণা ও বস্তুসকল একান্তই বাঙালির ও বাংলার। এই ধারার ছবির মধ্য দিয়ে আমি আমার দেশ ও জাতিকে represent করেছি, আমি সেখানেই আছি।” [৪]
আধুনিকতাকে পিটার চাইল্ডসের কথায় ‘একটি স্খলিত ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পরিভাষা’ বলে যদি স্বীকার করে নিই; তাহলে সুলতানীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে আমি বলব, যা শেকড়সংলগ্ন ও জীবনজাত তাইই আধুনিক। শেকড়কে প্রত্যাখ্যান করে কোনো শিল্প চির গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর এই শেকড় সংলগ্নতা বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিহার করেও নয়।
আধুনিকবাদীরা যখন এঁকে চলেছেন বিষণ্নতা, নিঃসঙ্গতা, ছন্দময় বিবস্ত্র রমণীর নৃত্য, মানসিকমুক্তির নামে ভোগ-সুখের অনুভূতি, জীবনের জটিল জাল, অপার রহস্যময়তা; তখন সুলতান এঁকেছেন পেশীবহুল মানব, বাংলার কৃষক সম্প্রদায়ের জীবনসংগ্রামের জীবন্ত ছবি, কৃষিজীবনে সয়াহক বিশাল পেশীবহুল বাঙালি রমণীর ছবি । অন্যরা যখন এঁকেছেন মানুষের মুখোশ; সুলতান তখন এঁকেছেন মানুষের মুখ।
“বাঙালির কোনো ধর্ম নাই। বাঙালির Basic কিছু গুণ আছে, ত্যাগী, সংযমী, সরল, সত্যবাদী, অতিথিপরায়ণ। আর আমাদের মধ্যে অনেক বড় মাপের absolute thinker তৈরি হয়েছে, Seculer thinket. কালিদাস, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জয়দেব, তারপর ঐ মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিদ্যাসাগর আর একজন বড় মানুষ। মধুসূদনের মেঘনাদবধ কাব্য, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, শর্ম্মিষ্ঠা নাটক এগুলো Religious মোটিভ নিয়ে লেখা হলেও ওগুলো আসলে অসাম্প্রদায়িক। একজনকে এসব বলেছিলাম, তো বলে, দেখেন আপনাকে ঐ রুশদীর মতো ফাঁসি দিতে চাইবে। আমি বলি, যাই করুক আমার বাপু ঐ পরকালে বিচার হবে কিনা, বেহেস্ত দোজখ হবে কিনা, সেজন্য প্রস্তুতি নিতে হবে কিনা, এসব নিয়ে ভাবনা নেই। এগুলোর মধ্যে আমি নাই।” [৫]
এই ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রেক্ষাপটে সুলতানমানসের বিচার করা সঙ্গত। হয়ত কোনো গবেষক ইউরোপীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের শিল্প ও সাহিত্য বিচারের যে প্রবণতা, তা থেকে বেরিয়ে এসে একদিন সুলতানমানসের স্বরূপ উন্মোচনে ব্রতী হবেন। সেই অপেক্ষায় রইলাম।
একজন শিল্পীর জীবন শুধু রঙ,তুলি আর ক্যানভাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। উপেক্ষিত জাতির জীবনে সে রঙ ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। ছবি শুধু জীবিকা অর্জনের জন্য নয়, মানুষের জীবনে সেই ছবি ফুটিয়ে তুলতে হয়। সেই কাজটি করেছেন সুলতান। তাঁর ছবি গভীর বোধ আছে, কিন্ত বোধের জটিলতা নেই। যে কেউ তাঁর ছবি বোঝে। তিনি যে কৃষকদের ছবি আঁকতেন, তারা কি তাঁর ছবি বুঝত? গ্রামের মানুষেরা তাঁর ছবি দেখতে এলে, তারা বলত - আমরা তো এরকম না। তিনি যখন বুঝিয়ে দিতেন, বলতেন - 'তোমাদের ভেতরের শক্তি এরকম।' তখন তারা বুঝত। তারা বেশি খুশী হত স্বাস্থ্যবান বলদ দেখে। গরুগুলো এমনটি হলে তারা চাষ করে মজা পেত, এমন অনুভূতি ব্যক্ত করে ভেতরের শক্তিকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ফিরে যেত কর্মক্ষেত্রে, ফসলের মাঠে।
বিচিত্র জীবন বোধ, বিচিত্র জীবনযাপনের মধ্যেই নিহিত ছিল তাঁর ছবির উৎস। অপূর্ব প্রাণশক্তিতে ভরপুর জীবনে যে ঐশ্বর্যময় রঙ তিনি আত্মস্থ করেছিলেন, তাইই ফুটিয়ে তুলেছেন ক্যানভাসে।
জাতির জীবনে প্রয়োজন সৌন্দর্য চেতনা। চারণকবির মতো সেই চেতনা বাংলার মানুষের মধ্যে সুলতান জাগাতে চেয়েছিলেন তৃণমূল থেকে। এজন্য তিনি চারণশিল্পী। গ্রামই ছিল তাঁর জীবন, তাঁর জীবনের সব শক্তি ও সব অনুষঙ্গ এই জীবনকে ঘিরেই। ছবি আঁকার রঙও তিনি কখনও সংগ্রহ করেছেন গ্রামীণ প্রকৃতি থেকে। রঙ তৈরি করতেন গাছ গাছড়া, গাছের লাতা-পাতা, মাটি, ইটের গুড়াসহ সহজলভ্য দ্রব্য থেকে। বিশেষ করে গ্রামের ছেলে-মেয়েদের আর্ট শেখানোর ক্ষেত্রে পয়সা বাঁচাতে এসব রঙ ব্যবহার করেছেন। বাজার থেকে কিনে জিঙ্ক অক্সাইড, পেউড়ি, রেড অক্সাইড, ব্লু ইত্যাদি দ্রব্যের সঙ্গে কোপাল বার্নিশ, লিনসিড মিশিয়ে রঙ তৈরির পদ্ধতি চাষা-ভুষার ছেলে-মেয়েদের শিখিয়ে দিয়েছেন। নিজেও ব্যবহার করেছেন। ছবি আঁকার জন্য প্রয়োজন ক্যানভাসের, একটি হোয়াইট স্পেসের। কিন্তু ক্যানভাস কেনার পয়সা কই! তিনি তার জন্য সিদ্ধান্ত নেন চট ব্যবহারের। যা কোনো শিল্পী আগে ভাবেননি। শুধু চটের ওপর ছবি আঁকা সম্ভব নয়। গ্রামে গাব একটা পরিচিত ফল। চটের ক্যানভাসকে ছবি আঁকার উপযোগী করে তুলতে ব্যবহার করেছেন গাবের রস। তখন এটা স্থায়ী হলো, বর্ষাকালে বা ভেজা আবহাওয়ায় যা সঙ্কুচিত হবে না, ছত্রাক পড়বে না। এভাবে ছবি আঁকার উপাদান তৈরি করে স্কুল খুলে গ্রামের শিশু-কিশোরদের ছবি আঁকা শিখিয়েছেন। শিশুদের জন্য ছিল তাঁর অশেষ ভাবনা। একটি সুন্দর জাতি গঠনে শিশুদের মন বিকাশের কোনো বিকল্প নেই। দেশের অবহেলিত, সৃজনশীলতাহীন প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে বারবার স্কুল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছেন। সরকারি পর্যায়ে দৌড়াদৌড়ি করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন শিশুদের মধ্যে সৃজনশীলতার জন্ম হলে সে প্রকৃত মানুষ হবেই। তার ভেতর কোনো অন্যায়, মিথ্যা দানা বেঁধে উঠবে না। তিনি সবসময় স্কুলে বাচ্চাদের খাবার দেওয়ার ব্যবস্থার উপর গুরুত্বারোপ করেছেন। আজ প্রামথিক স্কুলে ডে-মিল ও ফিডিং কর্মসূচি চালু হয়েছে বা সর্বতোভাবে চালু হতে যাচ্ছে, তা সুলতানের শিশুশিক্ষা-চিন্তার ফসল। আমেরিকা সফরকালে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি কি কি দেখতে চান বা কোথায় কোথায় যেতে চান? তিনি সেখানকার শিশুশিক্ষা কার্যক্রম স্বচক্ষে দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি দেখেন আধুনিক শিশুশিক্ষার স্কুলগুলো। লন্ডনেও দেখেছেন সেখানকার শিশু শিক্ষার কর্মকাণ্ড। দেশ-বিদেশ থেকে ধারণা নিয়ে নিজের এলাকায় গড়ে তুলেছেন 'শিশু স্বর্গ'। শুধুমাত্র আর্টের জন্য 'নন্দনকানন'। বেশিদূর এগোতে পারেননি। চক্রান্তকারীরা এগুতে দেয়নি। শিশুদের মনোবিকাশের জন্য প্রণয়ন করেছিলেন শিশুস্বর্গ ধারা বা নীতিমালা। যা একটি দেশের যুগোপযোগী প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তি রচনায় সহায়ক হতে পারত। তিনি চেয়েছিলেন শিশুরা খেলাধূলার মধ্য দিয়ে শিখবে। জীবজন্তু,পশুপাখি, প্রকৃতির মাঝে মিলেমিশে শিখবে। তাঁর স্বপ্ন সফল হয়নি। শিশুস্বর্গের জন্য সরকারি বরাদ্দকৃত জমি তাঁর জীবদ্দশাতেই বেদখল হয়ে গেছে। শিশুদের নিয়ে নদী থেকে নদীতে প্রকৃতির কোলে ঘুরে বেড়ানোর জন্য প্রচুর অর্থব্যয় করে তৈরি করেছিলেন বিশাল নৌকা। যা আজও পড়ে আছে চিত্রা নদীর চরে।
একজন স্বশিক্ষিত বোহেমিয়ান, বাউল হৃদয়ের মানুষ যিনি হিন্দু নন, মুসলমান নন। আগে মানুষ, তারপর খাঁটি বাঙালি। তিনি তো অনেকের ভিড়ে ভিন্ন হবেনই। আমাদের বাংলা সাহিত্যে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত যেমন এক অমিত প্রতিভা নিয়ে আমূল বদলে দিলেন চিরাচরিত কাব্যরীতি, সুলতানও তেমনি এক বিশাল অভিনব শিল্প চেতনায় চমকে দিলেন চিরায়ত চিত্রশিল্পের গতিময়তাকে। নাড়া দিতে পারা, চমকে দেয়া মহৎ শিল্পের লক্ষণ। সুলতানের ছবি নাড়া দিয়ে যায় আমাদের মর্মে। চাকচিক্যময় সোনার মোহর, নগর সভ্যতার আবাহন, বিশ্বের হাতাছানি উপেক্ষা করে তিনি ফিরে এসেছেন মাটির কাছে, গ্রামীণ নিসর্গের কাছে। নির্ভেজাল খাঁটি মানুষের কাছে। কজন এমনি করে ফিরতে পেরেছেন, বা ফিরতে পারেন ? যেমন করে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত ফিরেছেন, সুলতান ফিরেছেন। সুলতানের এ ফেরা শেকড়ের কাছে ফেরা, তাঁর ঐতিহ্যের কাছে ফেরা। আমাদের সম্মৃদ্ধময় যে লোকসংস্কৃতি, চিত্রশিল্পে তারই সার্থক ও শ্রেষ্ঠ রূপকার তিনি। পৃথিবীর প্রত্যন্ত পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে বাংলার প্রকৃতির কাছে, বাংলার মানুষের কাছে, বিশেষত বাংলার ধুলোমাটির কাছে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। এই সমর্পণ আর স্বাতন্ত্র্যধর্মী সৃষ্টির সমন্বয়ে সমুজ্জ্বল তাঁর বিস্ময়কর উপস্থিতি। একইসাথে দৈশিক ও বৈশ্বিক চেতনায় ঋদ্ধ শিল্পচেতনা এক বিরল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধারণ করে তিনি স্বাতন্ত্র্যে চিহ্নিত। বিশাল ক্যানভ্যাসে তাঁর নিটোল জলরং, কখনও বণার্ঢ্য মায়াময় তেল রঙে আঁকা, লাবণ্যময় ধানক্ষেত, প্রথম রোপন, ধানমাড়াই, পাট ধোয়া, শাপলা তোলা, নদী পার হওয়া, গ্রাম্য রমণীদের স্নান, গাঁতাচাষ, চরদখল, জমি কর্ষণে যাত্রা, মাছ ধরা, গুনটানা, খাল, নদী, লাঙল, বৈঠা, বাতাস দেওয়া, গীতময় নারীমুখ সবই তো এই বাংলার, চিরায়ত বাঙালির সাহস ও সংগ্রামের প্রতিচিত্র।
আমরা অনেকেই বলি—সুলতানের ছবিতে কোনো বিষণ্নতা নেই, বিষাদ নেই। সত্যিই তাই? আছে, তবে তা অশুভ বোধ থেকে শুভবোধের ইঙ্গিতবাহী। তাঁর বাংলা ও বাঙালিত্বের যে বোধ, সেখানে নিরন্তর সুখ-ঐশ্বর্য ছাড়া কোনো বিষাদ থাকতেই পারে। কোনো অশুভ-অশুচি তাঁকে ক্ষত-বিক্ষত করতেই পারে। কলোনিয়ান প্রভুত্ব, সুসংস্কৃতির ক্রমপতন, বৈশ্বিক আধুনিকতার উন্মাদনা, আত্মপ্রবঞ্চনা, দ্রোহ, বিশ্বাসঘাতকতা, প্রাকৃতিক বিপর্যয় তাঁকে অবশ্যই বিক্ষত করেছে। এ জন্যই তো তাঁর ছবির বিশাল মানুষটি, বিশাল বাহুময় কৃষকটি নিজের হাত, পা, এমনকি মাথা নিজেই ছিঁড়ে ফেলছে, দেখতে পাই। ভেঙে টুকরো টুকরো করেছে সবকিছু , এমনটি আমরা দেখেছি। তাঁর হৃদয়ে ক্ষত রয়েছে বলেই তো আমরা তাঁর ছবিতে দেখতে পাই, বিশাল-বলিষ্ঠ কৃষক ফসলভরা ধানক্ষেতে সোনালি ধানগাছটি বুকে জড়িয়ে মরে পড়ে আছে। বন্যা-জলোচ্ছ্বাসে মাতৃস্তন পানরত শিশুটি মাকে জড়িয়ে উর্বর মাটির বুকে মরে পড়ে আছে। জাতীয় জীবনের সংকট, আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তির যে আশাহীনতা শিল্পীকে বিষাদে আক্রান্ত করেছে কখনও। একবার প্রশ্ন করেছিলাম, তিনি মুক্তিযুদ্ধের ছবি এঁকেছেন কিনা! তিনি বলেছিলেন, “একজন কৃষকের যেমন মোটা চিন্তা আমারও তেমনি। আমরা কেমন করে স্বাধীন হলাম? আমাদের ফ্রি মুভমেন্ট নেই। কথা বলার স্বাধীনতা নেই। স্বাধীনতা আপনাদের। আমার কল্পনায়ও আসে না। আমার যা উৎপাদন, তাও আমার ঘরে থাকে না। বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। কৃষকের সুখ ছিল, দুবছরের খাদ্য-খাবার ঘরে ছিল, গোয়ালভরা গরু, মাঠভরা ধান ছিল। ওরা মেজবানি দিত। লোকজনের সঙ্গে মিশে আনন্দ উল্লাস করত। সে সমস্ত এখন আর নেই। নিজের ঘরের পণ্য বিক্রি করে আমাদের চাল পর্যন্ত কিনে খেতে হয়। কোথায় আমাদের স্বাধীনতা?...
স্বাধীনতার জন্য আমার অনেক ছবি আছে। তো, অনেকে বলেছে, এটি কেমন মুক্তিযুদ্ধের ছবি? ছবিতে আপনি পাকিস্তানিদের চিহ্নিত করেননি? না, পাকিস্তানিরা গুলি করছে, সে ছবি আমি আঁকিনি। আমি এঁকেছি একটা কৃষকের ছেলে জবাই করছে আর একজন কৃষককে। বাপ তার ছেলেকে, ছেলে তার বাপকে। বাপই ছেলেকে জবাই করছে। একটা কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বধ্যভূমিতে। পিছনে হাত বাঁধা আছে, আর গাছি দা দিয়ে তাদের জবাই করা হচ্ছে। পাকিস্তানিরা আমাদের শত্রু হতে পারে, এরকম আমি ভাবিনি।... আমার ছবিতে অন্য কোনো শত্রু খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা নিজেরাই আমাদের শত্রু।” [৬]
আমাদের বীরত্বগাথা, হীনমন্যতা, সকল দুঃশাসন-দুর্যোগ-দুঃসময়ে টিকে থাকার যে জীবনদম্ভ সবকিছু মিলিয়েই তো আমাদের বাঙালিত্ব। এস এম সুলতান আমাদের মাটি ও জীবন প্রভাবিত ঐতিহ্যানুসন্ধানী এক মহান বাঙালি শিল্পী। সুলতানের মতো খাঁটি শিল্পীর জন্ম পৃথিবীর ইতিহাসে খুব বেশি ঘটেনি।
লালন ফকিরের মতো এক অনন্য আধ্যাত্মিকতা, অদ্বৈতবাদ, সুফিবাদ, সহজিয়া দর্শনের একটি অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছিল সুলতানের জীবনে।
আর শিল্পীর পশু ও প্রকৃতিপ্রেম, হিংস্র প্রাণিকে বশ মানানো, ঝঁকড়া চুল, রাধার খোঁজে কৃষ্ণ হওয়া অথবা কৃষ্ণের খোঁজে শাড়ি পরে রাধা সাজা, ঘুঙুর পরে নৃত্য করা, শশ্মানে রাত্রি যাপন, খাকসার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া, বুনো-ব্রাত্য সমাজে আপন হয়ে ওঠা. পথে পথে ছবি আঁকা, ছবি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ, হোটেলে অসংখ্য ছবি রেখে চলে যাওয়া, নিজের ছবি অন্য শিল্পীরা অন্যের নামে চালিয়ে দিচ্ছে—চুরি করেছে জেনেও কিছু না বলা, অপমান-গঞ্জনা সহ্য করেও মানুষের পাশে দাঁড়ানো, গাঁজায় দম দেয়া, তন্ত্র-মন্ত্রের সাধন, নদী থেকে নদীতে শিশুদের নিয়ে ভেসে বেড়ানোর উদ্দেশে নৌকা নির্মাণ, শিশুস্বর্গ গড়ে তোলা, জঙ্গল কেটে শিশুদের জন্য স্কুল করা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত না করে কয়েকটি ভাষায় অনর্গল কথা বলা, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে বক্তৃতাদান, গায়ে চাঁদনী রাতে বাঁশিতে সুর তুলে হারিয়ে যাওয়া, এসব কিছু একটি অদ্ভুত, বিচিত্র কিংবদন্তীময় ব্যক্তি-সুলতানের চিত্র আমাদের সামনে ভেসে উঠলেও, তার মধ্য থেকে আত্মত্যাগী, নির্মোহ, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদবিরোধী একজন খাঁটি বাঙালি শিল্পীর স্বরূপ ক্রামগত স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির দর্পণে; যা আগামীতে আরও জীবন্ত হয়ে উঠবে, বিশেষত আমাদের সংকট, আত্মপরিচয়ের অনুধ্যানে।
তথ্য সংকেত:
১. মুখোমুখি সুলতান। খসরু পারভেজ সম্পাদিত। সম্পাদক কর্তৃক গৃহীত সাক্ষাৎকার। প্রকাশক: ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা। সম্পাদক কর্তৃক গৃহীত সাক্ষাৎকার। পৃষ্টা ৩০
২. প্রাগুক্ত। পৃষ্ঠা ৩০-৩১
৩. প্রাগুক্ত। শরীফ আতিক-উজ-জামান গৃহীত সাক্ষাৎকার। পৃষ্ঠা ৯০
৪. শিল্পী সুলতানের আত্মকথা : জীবনের জলরঙ। অনুলেখন- মহসিন হোসাইন। মনন প্রকাশ, ঢাকা। পৃষ্ঠা ১৬৯
৫. নৃ। নূরুল আলম আতিক সম্পাদিত। সংখ্যা ১ আগস্ট ১৯৯০। শাহাদুজ্জামান গৃহীত সাক্ষাৎকার। সুলতান ক্রোড়পত্র, পৃষ্ঠা ২৭
৬. মুখোমুখি সুলতান। সম্পাদক কর্তৃক গৃহীত সাক্ষাৎকার। প্রাগুক্ত।