জুলাই অভ্যুত্থান
নির্দয় হুকুমের বিপরীতে নির্ভীক ছাত্রজনতা

সেদিনগুলোতে বাংলাদেশের আকাশে আলো ছিলো। তবে, সে আলো যেন কোথাও আগুন, কোথাও থমথমে মরুবালিকার লু হাওয়া! বহুতল ভবনে সেজে ওঠা গ্লাস অ্যান্ড লাইট হয়ে ফুটে থাকা রাজধানী ঢাকার বাতাস তখন ছিলো স্লোগানে-স্লোগানে উত্তাল। সেসব বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর রোধে নির্দয় হকুমে বুক-তাক করে ছোঁড়া বুলেট-বৃষ্টিতে ঝরেছিলো রক্ত। তবুও বহুদিনের ক্ষোভ জমে-জমে পরিণত হওয়া আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ দমেনি, আরও বেশি জ্বলে উঠে ঘটিয়েছিলো বিপ্লবী অগ্ন্যুৎপাত ১৬ জুলাই দু’হাত উঁচু করে বুক চিতিয়ে থাকা নির্ভিক আবু সাঈদের শাহাদতে। সেদিন থেকে তাজা রক্তে রঞ্জিত রাজপথ কথা বলতে শুরু করেছিলো বলিষ্ঠতা নিয়ে। চারদিকে রব ওঠেছিলো, ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর।’
যদিও তার দুদিন আগে ১৪ জুলাই ফুঁসে উঠেছিলেন শিক্ষার্থীরা। যেদিন তদানিন্তন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা তার চীন সফর শেষে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, মুক্তিযোদ্ধার বিরুদ্ধে এতো ক্ষোভ কেনো? মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিরাও (চাকরি) পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে? আর মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে, মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার তাদের কে দিয়েছে?’
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে কোটা সংরক্ষণ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই বিতর্ক চলছিলো। আগে মোট ৫৬ শতাংশ কোটা সংরক্ষণের নিয়ম ছিলো, যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা, নারী, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীসহ নানা ক্যাটাগরি ছিলো। তবে, বাস্তবায়নের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয় মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে ঘিরে। তরুণ প্রজন্ম এই কোটানীতিকে ‘বৈষম্যমূলক’ উল্লেখ করে তা ‘প্রতিযোগিতায় মেধাকে বাধাগ্রস্ত করে’ বলে সংস্কারের দাবি তোলে।
২০১৮ সালের শুরুতে এই দাবি নিয়ে শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা দাবি জানাতে থাকেন—কোটা থাকতে পারে, তবে তা হতে হবে যৌক্তিক এবং সীমিত পরিসরে। তারা কোটাকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং অব্যবহৃত কোটাগুলো মেধা অনুযায়ী পূরণ করার দাবি জানান।
সে সময় কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে উত্তাল সময়কে শিথিল করতে সাবেক সরকারপ্রধান ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের ওপর ‘বিরক্ত’ হয়েই নেন অপরিপক্ক এক সিদ্ধান্ত। ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে ঘোষণা দেন, ‘আমরা কোটা রাখব না। কোনো কোটা থাকবে না। যখন কোটার জন্য এত কথা হয়, তখন কোটা ব্যবস্থা তুলে দেওয়াই ভালো।’ তার এই বিরক্তির কথা ছয় বছর পর ১৪ জুলাইয়ের সংবাদ সম্মেলনে স্বীকারও করেন। ওদিন একাত্তর টিভির প্রধান প্রতিবেদক (বর্তমানে অব্যহতিপ্রাপ্ত) ফারজানা রুপার এক প্রশ্নে শেখ হাসিনা বলেন, ‘একবার তারা (শিক্ষার্থীরা) এ ধরনের আন্দোলন, শুধু আন্দোলন না, তখন যে সমস্ত ঘটনা তারা ঘটাচ্ছিল, মানে আমেরিকার ওপর আক্রমণ, সেখানে মানুষকে মানুষের ওপর আঘাত করা, কিছু জ্ঞানীগুণী আছে একেবারে ঘরের মধ্যে বসে মিথ্যা অপপ্রচার রেকর্ড করে ছেড়ে দিচ্ছে—এই ধরনের সমস্ত দেখে আমি খুব বিরক্ত হয়ে যাই এবং তখন একপর্যায়ে বলি, ঠিক আছে কোটা বাদই দিলাম।’
যদিও ২০১৮ সালে নেওয়া শেখ হাসিনার বিরক্তিভরা ঘোষণা যে চাপের মুখে একটি তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া, তা শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারেন। কারণ, এই ঘোষণা বাস্তবায়নে দীর্ঘ সময় লেগে যায় এবং পুরোপুরি কোটা বাতিল হয় না, বরং একই বছরের ৩ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে নবম থেকে ১৩তম গ্রেডে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটাব্যবস্থা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। যেখানে একথাও উল্লেখ করা হয় যে, সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা বিবেচনা করার ক্ষমতা সরকারের রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রেখে এবং কোটাব্যবস্থার মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন এনে জারি করা প্রজ্ঞাপণে অনেক শিক্ষার্থী অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এ ঘটনার সাড়ে পাঁচ বছর কেটে যায়। মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (নবম থেকে ১৩তম গ্রেড) ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এতে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। সেই অসন্তোষই ২০২৪ সালের জুলাইয়ের আন্দোলন তৈরিতে উত্তাপ ছড়ায়।
অপরিপক্ক সিদ্ধান্ত, ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য
শেখ হাসিনার বিভিন্ন সময়ের অপরিক্কতা, বিশেষ করে রাজাকারের নাতিপুতি বলে তকমা দেওয়া তার জন্য অপরিণামদর্শিতার পরিচায়ক হয়ে ধরা দেয়। ২০২৪-এর জুলাইয়ের শুরুতে বৈষ্যমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নামা সব স্তরের শিক্ষার্থীদের চেতনায় জেগে থাকা দাবি আরও পোক্ত হয়ে ওঠে। শেখ হাসিনার ১৪ আগস্টের সংবাদ সম্মেলন শেষ না হতেই রাতের আঁধার কেটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা স্লোগানে কেঁপে ওঠে। ছাত্রছাত্রীদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ‘তুমি কে আমি কে? রাজাকার, রাজাকার/কে বলেছে কে বলেছে? স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’, ‘ছাত্ররা যদি রাজাকার, দেশটা তবে কার বাবার?’ প্রভৃতি স্লোগান।
শেখ হাসিনা বুঝতে পারেন, তার মহাভুল হয়েছে। তিনি এই ভুলকে ধামাচাপা দেওয়ার নানা চেষ্টা করেন। শিক্ষার্থীদের তিনি রাজাকার বলেননি বলে দাবি করেন। যদিও তার ঔদ্ধত্য তাকে জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে। টলে ওঠা তার মসনদ টিকিয়ে রাখতে নিতে থাকেন একের পর এক জনবিধ্বংসী সিদ্ধান্ত। সেই সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে এমন কিছু লোকজনকে তিনি বেছে নেন, যাদের দূরদর্শিতা তো ছিলোই না, ছিলো না মানবতার ও দেশপ্রেমের লেশমাত্রও। এজন্য কোমলমতিদের বুকে গুলি ছুড়ে হত্যা করতে তারা পিছপা হননি। লেলিয়ে দেন মানুষের জানমালকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি পুলিশকে বাহিনী।
নির্ভীক ছাত্রজনতা
কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিরস্ত্র আবু সাঈদকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক নম্বর ফটকের সামনে গুলি করা হয়। গুলি বুকে ধারণ করেও দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করেন দুই হাত কাঁধের দুদিকে বাড়িয়ে বুক টান করে রাখা সাঈদ। এক সময় রাজপথে ঢলে পড়েন তিনি।
খুব কাছ থেকে নিরস্ত্র এক শিক্ষার্থীর বুকে গুলি চালানো নিয়ে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও ওঠে নানা প্রশ্ন। দেশজুড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলন আরও জোরদার হয়। এতদিন যারা চুপ করে ছিলেন, তারাও এবার সমালোচনা শুরু করেন বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। আর তখনই অর্থাৎ, ১৭ জুলাই মধ্যরাত থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট। এরমধ্যেও ঘণ্টায় ঘণ্টায় আরও বেগবান হতে থাকে বিক্ষোভ। রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কণ্ঠে-কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ‘চেয়ে দেখ এই চোখের আগুন, এই ফাগুনেই হবে দ্বিগুণ।’

সাঈদের পর ‘পানি লাগবে পানি?’ বলে ঢাকার উত্তরায় বিক্ষোভকারীদের পানি বিতরণ করতে গিয়ে ১৮ জুলাই গুলিবিদ্ধ হন মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। একদিকে সাঈদ, অন্যদিকে মুগ্ধ নিহত হলে ক্ষোভে ফেটে পড়ে জনতা। জায়গায় জায়গায় বেরিকেড ভেঙে বিক্ষোভ মিছিল ও মোড়ে মোড়ে অবরোধ শুরু করেন তারা। বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর চালায় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা।
ভাঙচুরে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মিরপুর-১০ নম্বর মেট্রোরেল স্টেশন ২৫ জুলাই পরিদর্শন করেন শেখ হাসিনা। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর বুকে গুলির আদেশ দেওয়া হাসিনা সাঈদ-মুগ্ধর মৃত্যুতে না কাঁদলেও মেট্রোরেলের ক্ষতি দেখে চোখের পানি ছেড়ে দেন। এতে আরও ক্ষোভের মুখে পড়েন তিনি। এ সময় নেটিজেনদের ওয়ালে-ওয়ালে ভাসতে থাকে, ‘নাটক কম করো পিও।’ যদিও এই স্লোগানের সৃষ্টি আবু সাঈদের মৃত্যুর পর পরিস্থিতি ঘোলাটে হলে জাতির উদ্দেশে শেখ হাসিনা যে ভাষণ দেন, তারপর। কারণ, তার সেই ভাষণে শহীদদের প্রতি কোনো সমেবেদনা ছিল না, বরং ১৬ জুলাই নিহত হওয়া তথাকথিত ছাত্রলীগের এক কর্মীর জন্য ছিলো মায়াকান্না।
নির্দয় হুকুম
রাষ্ট্রের আকাশও তখন লালচে যেন। একদিকে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের স্লোগানে কম্পিত হচ্ছে অলিগলি-রাজপথ, অন্যদিকে তাদের ওপর নির্দয়ভাবে গুলি চালাচ্ছে পুলিশ। বাসাও তখন নিরাপদ নয়। ১২ জুলাই সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আন্দোলনকারীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, আন্দোলন চলতে থাকলে সরকার ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবে। ১৫ জুলাই সে সময়ের ত্রাস বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধ) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে যারা স্লোগান দিচ্ছেন, তাদের শেষ দেখিয়ে ছাড়বেন। এরপর সাঈদ-মুগ্ধই নয়, বিভিন্ন স্থানে পড়তে থাকে একের পর এক লাশ; নির্মম অত্যাচার, গুলিতে আহত হতে থাকেন ছাত্রছাত্রীরা। ১৯ জুলাই ঢাকার রামপুরার বাসার নিচে সিঁড়ির কাছে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন মুস্তাফিজুর নামে এক ব্যক্তির ৬০ বছর বয়সী মা মায়া ইসলাম, তারই সাত বছরের ছেলে বাসিত খান মুসা হয় মাথায় গুলিবিদ্ধ। নিজের বাসায় নিরাপদ থাকতে পারেননি সদ্য মা হওয়ার স্বাদ পেয়ে আনন্দিত ২০ বছর বয়সী সুমাইয়া আক্তারও। ঘরের প্রাঙ্গণে নিহত হয় ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপ, কিশোরী নাঈমা সুলতানা, তরুণী নাছিমা আক্তার, গৃহকর্মী মোসাম্মৎ লিজা আক্তারের মতো অনেকে। তাদের কারও মাথায়, কারও পেটে, এমনকি কারও গলায় লেগেছিলো গুলি, যা দেখেই অনুভব করা যায়, কতটা নির্দয় হুকুমের মালিক ছিলেন সেই স্বৈরাচার।

হত্যাকাণ্ডের মধ্যে মজা করে বক্তব্য
এরইমধ্যে মজা নিতেও ভোলেননি সে সময়ের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকের মতো অনেকে। ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়ার ১১ দিনের মাথায় ‘কেন ইন্টারনেট বন্ধ’ প্রশ্নে ২৭ জুলাই তিনি বলেন, ‘সরকার দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করেনি, ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে গেছে।’ ১৬ থেকে ১৮ জুলাই বেগবান হতে থাকা আন্দোলনের সময় চাউর হয়, দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। অবস্থান নিয়েছেন ভারতে। পরদিনই অবশ্য সংবাদ সম্মেলনে দম্ভের সঙ্গে হাসিনা বলেন, ‘শেখ হাসিনা পালায় না।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সে সময়ের সড়ক, পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ‘আওয়ামী লীগ বেশিদিন টিকবে না’ বলে বিএনপির মহাসচিব যে মন্তব্য করছিলেন তার জবাবে মজা করে বলেছিলেন, ‘পালাব না...প্রয়োজনে ফখরুল সাহেবের বাড়িতে যাব।’ তাদের এ ধরনের বক্তব্য চিন্তকদের মনে নাড়া দেয়; রাষ্ট্রযন্ত্রের পরিচালকদের এমন সব কথা প্রমাণ করে দেয়, তারা রাষ্ট্র চালানোর গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।
‘বিকল্প কে? আমি, তুমি, আমরা’
শেখ হাসিনা যখন বুঝলেন তার গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে ঠেকেছে, তখন নিজের অবস্থানকে মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের বেশ কয়েকজনকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, নিপীড়ন, অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে নির্যাতন করেও যখন সংলাপে বসাতে পারেননি; যখন তারা ‘রক্ত মাড়িয়ে সংলাপ নয়’ প্রশ্নে একমত; তখন ১৫ বছরে চালানো প্রপাগান্ডা আবারও চাউর হয়। আর সেটি হলো, দেশ পরিচালনায় ‘শেখ হাসিনার বিকল্প বাংলাদেশে নেই।’ ততদিনে বিপ্লবী ছাত্রদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মুক্তিকামী কোটি কোটি সাধারণ জনতা। তারা ছাত্রদের সঙ্গে একমত হয়ে পাল্টা উত্তর দেয়, ‘বিকল্প কে? আমি, তুমি, আমরা।’
একপর্যায়ে ২০ জুলাই থেকে জারি হয় কারফিউ। বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্যমতে, প্রথম দিনে অন্তত ২১ জন নিহত হন। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারফিউ বাড়ানো হয় এবং দুই দিনের সাধারণ সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। নিজের মসনদকে টিকিয়ে রাখতে সেনাবাহিনীকে দিয়ে আন্দোলন ঠেকানোর অপচেষ্টা করা হলে ছাত্রজনতা তাদের মনও জয় করে নেয়। বাংলাদেশে বীর সেনা সদস্যরা ছাত্রজনতার বুকে গুলি ছুড়তে অস্বীকৃতি জানায়। এ সময় ছাত্রজনতার মুখে মুখে বলতে শোনা যায়, ‘এই মুহূর্তে দরকার, সেনাবাহিনীর সরকার।’
রক্তে আগুন লাগা শিক্ষার্থীদের স্লোগান ও কর্মসূচি
জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গণবিপ্লবে রূপ নেওয়ার বেশ কিছু কারণের মধ্যে অন্যতম ছিলো তাদের নেওয়া সময়োপযোগী বিভিন্ন কর্মসূচি ও স্লোগান। ৪ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ৫ জুন হাইকোর্টের রায় বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিলে ৬ জুলাই থেকে শুরু হয় ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি। তারপর ১৬ জুলাইয়ে নিহতদের ‘গায়েবানা জানাজা’ ১৭ জুলাই চলাকালে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশি হামলার প্রেক্ষিতে ১৮ জুলাই থেকে সারাদেশে শুরু হয় ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি। ৩১ জুলাই বিক্ষোভকারীরা ‘জাস্টিসের জন্য মার্চ’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ২ আগস্ট ‘দ্রোহের যাত্রা’, ৩ আগস্ট আট দফার কোটা সংস্কার আন্দোলন এক দফায় রূপ নেয়, হয়ে ওঠে রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকারের পদত্যাগের দাবি ঘোষণা করে এবং সর্বশেষ ৪ আগস্ট ঘোষিত ৫ আগস্টের ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষিত হয়। শিক্ষার্থীদের এসব কর্মসূচির সাথে সাধারণ জনতাও যেন একমত প্রকাশ করেন। কারণ, তাদের কেউ এ সময় কোনো কর্মসূচির কারণে জনজীবনের প্রতিবন্ধকতার কথা বলেনি। বরং, নীরব থেকে সমর্থন জুগিয়েছেন, অনেকে আবার আন্দোলনরতদের পানি, খাবার, ছাতা, চিকিৎসা দিয়ে এগিয়ে এসেছেন।
অন্যদিকে, রক্তে আগুন লাগা স্লোগানগুলোতে জ্বলে উঠেছিল শিক্ষার্থীদের সাথে জনতাও। তাদের মুখে মুখে যেসব স্লোগান ছিলো তার মধ্যে অন্যতম, ‘আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরও দেব রক্ত’, ‘একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে ওঠো আরেকবার’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনিরা কেন বাইরে’, ‘হাল ছেড় না বন্ধু বরং কণ্ঠ ছাড় জোরে’ ইত্যাদি। এ ছাড়া, এই লেখাজুড়ে তুলে ধরা হয়েছে সে সময়ের আরও কিছু স্লোগান।
স্বৈরাচারের শেষ কামড়
গুম, খুন, গুলিতেও যখন ছাত্র-জনতাকে থামানো যাচ্ছিলো না, তখন ২৭ জুলাই থেকে শেখ হাসিনার সরকার ‘ব্লক রেইড’ পরিচালনা শুরু করে। পুলিশ তার বিভিন্ন বিভাগ দিয়ে এলাকায় এলাকায়, বাসায় বাসায় হানা দিয়ে নামে-বেনামে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের তুলে নিয়ে যেতে থাকে; দিতে থাকে মামলা। শুধু ২৮ জুলাইয়ে শুধু ঢাকাতেই ২০০টিরও বেশি মামলায় দুই লাখ ১৩ হাজারের বেশি মানুষকে অভিযুক্ত করা হয়। আগেই তুলে নেওয়া আন্দোলনের সম্মুখভাগের ছয় সমন্বয়কের সঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও গোয়েন্দা শাখার তৎকালীন প্রধান হারুন-অর-রশিদের এক টেবিলে বসে খাওয়ার ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েও বিক্ষোভকে অন্যখাতে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ১ আগস্ট সন্ত্রাসবিরোধী আইনে জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।

এদিকে, টালমাটাল সরকার তার অবস্থান বজায় রাখতে কোটা আন্দোলন ঘিরে নিহতদের স্মরণ করতে চায়। তারা দেশব্যাপী শোক পালনের আহ্বান জানায়। যদিও মানুষ মেরে আবার তাদের স্মরণকে মেনে নেয়নি ছাত্রজনতা। অন্যদিকে, ‘এই আন্দোলন ঘিরে নিহতদের’ বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি তখন, এটিও এই আহ্বান প্রত্যাখ্যানের অন্যতম কারণ। শিক্ষার্থীরা সরকারের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে প্রফাইল লাল করার কর্মসূচি ঘোষণা করে। কোটি কোটি বাংলাদেশি এই আহ্বানে সাড়া দেয়। তারা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানায়। এদিন ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযগমাধ্যমের প্রোফাইলে লালে লাল হয়ে ওঠে।
পুলিশবাহিনী দিয়ে যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনসমর্থন আদায়ে ও ছাত্রজনতার আন্দোলন ঠেকাতে পুরোপুরি ব্যর্থ, তখন ৪ আগস্ট সেই জনগণকেই নাশকতাকারী উল্লেখ করে ‘শক্ত হাতে নাশকতাকারীদের প্রতিহত করার’ আহ্বান জানান। এদিনই বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশের জনগণকে প্রথমে ৬ আগস্ট পরবর্তীতে একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ সফল করার আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনার পলায়ন
‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে নামে ছাত্র-জনতার প্রবল স্রোত। সেই স্রোতে ভেসে যাওয়ার হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালাতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।

জুলাই বিপ্লব
জুলাই ২০১৮-এর ছাত্র আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-রাজনৈতিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ; বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি রক্তাক্ত, সাহসী এবং পরিবর্তনের আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠা মাস। এ সময়টি শুধু কোটাবিরোধী আন্দোলন না; বরং তা হয়ে উঠেছে একনায়কতান্ত্রিক ঔদ্ধত্য ও রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে নতুন প্রজন্মের ন্যায্যতার দাবিতে গর্জে ওঠা নির্ভীক প্রতিরোধের দলিল। ‘জুলাই বিপ্লব’ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—আন্দোলন হারিয়ে যায় না, সে শুধু রক্তের স্রোতে ইতিহাস লেখে।