মায়ের কাছে যাচ্ছি বাড়ি

ঈদে দলবেঁধে বাড়ি ফিরতেই হবে-এটা এখন মুখ্য বিষয়। আর এই ঐতিহ্য সানন্দ্যচিত্তে লালন করে সবাই। গ্রামে যত্নে ফেলে রেখে আসা জল ছলছল নদী, পাখপাখালির কলকাকলি, গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথে ধুলো উড়িয়ে গরুদের ঘরে ফেরা, রাখালিয়ার বাঁশরির প্রাণ উদাস করা সুরলহরি, ঝোপের ধারে জোনাকজ্বলা সাঁঝেরবেলা, বৃষ্টিবেলায় ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ, ঘাসের ডগায় শিশিরবিন্দু, শস্যশাঁখে প্রজাপতি আর ফড়িঙের বিরামহীন নাচন কোথায় গেলে পাব? নরম জোছনায় গা ভেজানোর ফুরসৎ কই কর্মক্লিষ্ট এই শহরে? রোজকার যানজট, রাস্তায় বসে বসে গরমে নাকাল হওয়া, চোর ছ্যাঁচড়ের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলা, অফিসের কর্তার চোখরাঙানি আর কাহাতক ভালো লাগে? তাই চলো বাড়ি ফিরি ঈদের নিমন্ত্রণে।
আমি যদি হতাম বনহংস, বনহংসী হতে যদি তুমি; কোনো এক দিগন্তের ধানসিঁড়ি নদীর ধারে ধানক্ষেতের কাছে ছিপছিপে শরের ভিতর এক নিরালা নীড়ে আকাশের রুপালি শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম-এমন ভাবনার কাঙালপনায় প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ যদি চেতনায় ভর করে অথবা কবি কাজী নজরুল ইসলাম যদি আপনার মননে দরাজ গলায় কবিতা শুনিয়ে যায় : হেরিলে মায়ের মুখ দূরে যায় সব দুখ, মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান, মায়ের শীতল কোলে সকল যাতনা ভোলে কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।
তাহলে আপনাকে মায়ের কাছে চিরচেনা সেই সুবর্ণ গাঁয়েই ফিরতে হবে। মায়ের সুখ সান্নিধ্য আর প্রাণান্ত আশীর্বাদ নিয়ে প্রাণেশ্বরীর হাতটি ধরে জন্মস্থান নতুন করে খুঁটিয়ে দেখার সুবর্ণ সুযোগ তো একটাই; উৎসব বা পার্বণ। আর বাঙালির কর্মমুখর আটপৌরে জীবনে ঈদ হলো প্রধানতম উৎসব। ঈদের এর আবেদন তাই বরাবর প্রথম প্রেমের মতো।
যান্ত্রিক জীবনে মমতা ও ভালোবাসায় সন্তানকে আগলে রাখবার অভ্যেসটা আবার ঘুরেফিরে আসে ওই উৎসবেই। ফিকে হয়ে যাওয়া শৈশব-কৈশর তার সোনালি অতীতকে ফিরে পায় পার্বণেই। তাইতো শত প্রতিকূলতা আর ঝঞ্ঝা ঝড়ঝাপটা সয়েও আনন্দালোকে বিরাজ করে মানুষ বলতে পারে : শেকড়ের টানে মায়ের কাছে যাচ্ছি বাড়ি।
পারিবারিক বন্ধনের জাদু আর ভালোবাসা-মহব্বতের জোয়ার দেখে প্রাণেশ্বরীর দু’চোখ বেয়েও জলকণার মুক্তো চিকচিক করে ওঠল কি? এমন স্বপ্নসুখের সাক্ষী হতেই বাঙালিকে বাড়ি ফিরতে হয়; ঘরে ছুটে যেতে হয়।
তারপর সকালে কৃষ্ণচূড়ার লাল পাঁপড়ি ভেজানো অথবা হিজলের সফেদ পুষ্প ধুয়া পুকুরের স্বচ্ছ জলে স্নান শেষে পুতঃপবিত্র হয়ে মিষ্টি মুখ করে নতুন টুপি জামা পরে মুরুব্বীদের কদমবুসি। মা-বাবা-দাদু কি বলবেন তখন, বাছা এমন করে মায়ের কোলে বারবার ফিরে ফিরে আসিস। হাতে জায়নামাজ নিয়ে ছোট্ট সোনামনিটির হাত ধরে ঈদগাহে যাওয়া। পথে যেতে যেতে শহুরে ইটপাথরের চার দেয়ালে বন্দি শিশুকে গ্রাম চিনিয়ে দেওয়া, জগৎ চিনিয়ে দেওয়া। এই যে, ইনি তোমার চাচ্চু হন, আমরা প্রাইমারি স্কুলে একসঙ্গেই পড়েছি। আমার প্রিয় চাষি বন্ধু। ঐতো পুকুরপাড়ের তালগাছটায় ধরে আছে সবুজ কচি তাল। পেকে হলদে-গোলাপি হয়ে যাওয়া প্রায় জলস্পর্শী আম। এই তো ঝোপঝাড়ের পাশ দিয়ে কাঠবিড়ালি ওঠে গেল তালগাছে। ছোট্ট খোকাটি মুগ্ধ হয়ে বলবে যেন : বাবা, গ্রাম যে ভারি সুন্দর। আমি গ্রাম খুব ভালোবাসি।
পরম ভালোবাসা ও আন্তরিক সৌহার্দ্যে সবার সম্মিলনে ঈদগাহ মাঠে নামাজ হয়। কতদিন দেখা হয় না বন্ধুর সঙ্গে আলিঙ্গনে শত কথা হয়। বিনিময় হয় হাজারো বিবর্ণ সুখ-দুঃখ।
ঈদে তাই গ্রামে যাওয়াটা নিছক একগুঁয়েমি মুক্ত হয়ে বৈচিত্র্যের খোঁজ বা স্বজনের সুখ সান্নিধ্য না হয়ে সামাজিক দায়িত্ব পালনের উপলক্ষ হয়ে ওঠে। শিক্ষাদীক্ষা বা কর্মকুশলতায় আপনি হতে পারেন সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। নিজ গ্রামের খেটে খাওয়া স্কুলের সেই বন্ধুটি অথবা কোনো অসহায় মানুষটির জন্য পরান কেমন না করে কি পারে? গ্রামের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ বা ক্রীড়া ক্লাবের দেখভালের দায়টা আমার আপনার সবার। কাজেই যে গ্রাম তার আলো বাতাস দিয়ে আপনাকে পরিপুষ্ট করে সামাজিক মানুষ করেছে। জন্মভূমিকে প্রাণভরে ভালোবাসবার জন্য তাই বাড়ি আমাদের ফিরতেই হবে। আর হাজারো দুর্বিষহ দুর্ভোগ সয়েও বাড়ি ফিরবার উপলক্ষ সৃষ্টি করবার জন্য মুসলিম চেতনায় আনন্দের প্রতীক ‘ঈদ উৎসব’কে সুস্বাগত। শেকড়ের টানে মায়ের কাছে বাড়ি ফিরবার কালে মানুষের অন্তরে গুঞ্জরিত হোক প্রিয় কবি শহীদ কাদরী :
সব পাখিরা ঘরে ফেরে,
সব নদী।
আমরা কেন দন্ডায়মান
গাছতলাতে নিরবধি।
কীর্তিনাশার কালোস্রোতে
নৌকো ভাসে সারি সারি
এবার আমি বলতে পারি-
যাচ্ছি বাড়ি।
যাচ্ছি বাড়ি।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন