সাংবাদিক শামছুর রহমান : এক সাহসী কলমের নির্মম অবসান

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের এক সাহসী সাংবাদিকের নাম শামছুর রহমান। ২০০০ সালের ১৬ জুলাই যশোরে কর্মরত অবস্থায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে নির্মমভাবে প্রাণ হারান তিনি। তাঁর এই মৃত্যু শুধু একটি জীবনের অবসান নয়, বরং স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধের এক জ্বলন্ত নিদর্শন।
১৬ জুলাই—একটি দিন, যা প্রতিবার ফিরে আসে গভীর বেদনার তরঙ্গে, নিঃশব্দে, কিন্তু অজস্র স্মৃতি নিয়ে। এই দিনে, ঠিক পঁচিশ বছর আগে, আমরা হারিয়েছিলাম একজন সত্যনিষ্ঠ, নির্ভীক ও সংবেদনশীল সাংবাদিককে—শামছুর রহমান। তাঁর মৃত্যু ছিল নিছক কোনো মৃত্যু নয়; তা ছিল এক প্রতিশ্রুতিশীল কণ্ঠের চিরতরে থেমে যাওয়া, যা অবিরাম উচ্চারণ করত সমাজের কথা, মানুষের কথা, প্রকৃতির ভাষা।
শামছুর রহমান নামটি উচ্চারণ করলেই ভেসে ওঠে এক অনমনীয় চরিত্রের প্রতিচ্ছবি—যিনি কেবল একজন সংবাদকর্মী ছিলেন না, ছিলেন চিন্তাশীল একজন ভাষ্যকার, অনুভবের দিকপাল। তাঁর কলম ছিল না কেবল প্রতিবেদন লেখার যন্ত্র; তা ছিল সময়ের সাহসী সাক্ষ্যদাতা। তাঁর প্রতিটি রিপোর্টের ভেতরে থাকত সত্যের নির্যাস, মানুষের মুখের ভাষা, প্রকৃতির নিঃশব্দ আহ্বান।
রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে শুরু করে গ্রামীণ চাষির জমির গল্প, সীমান্তের বিভীষিকা থেকে শহরের নিস্তব্ধ কান্না—শামছুর রহমানের রিপোর্ট ছিল হৃদয়ের ক্যানভাসে আঁকা দৃশ্যপট। তিনি জানতেন, একজন সাংবাদিকের দায়িত্ব শুধুমাত্র তথ্য পরিবেশন নয়—তথ্যকে হৃদয়ে পৌঁছে দেওয়াই সাংবাদিকতার সত্য রূপ। তাঁর লেখায় থাকত শব্দের শরীর আর অনুভবের আত্মা।
সাংবাদিকতা তাঁর কাছে ছিল দায়বদ্ধতার চর্চা। তিনি বলতেন—
“সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে ভয় পেলে বাঁচার কোনো মানে হয় না।”
এই কথাগুলো শুধু সাংবাদিকতা নয়, সমগ্র সামাজিক চেতনার ভিতকে নাড়িয়ে দেয়। শামছুর রহমান জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ বিশ্বাসেই ছিলেন অটল। সত্যের পথে থাকা তাঁকে জীবন দিয়ে হলেও ছাড়তে হয়নি; বরং তিনি রেখে গেছেন সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর অবিনাশী দৃষ্টান্ত।
আজ তাঁর অনুপস্থিতি কেবল শূন্যতা নয়—তাঁর অভাব এক অদৃশ্য উপস্থিতি হয়ে রয়ে গেছে আমাদের প্রতিদিনের কর্মে, চিন্তায়, বিবেকের আয়নায়। যখনই কোনো সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কলম ধরেন, যখনই কোনো তরুণ সংবাদকর্মী প্রকৃতির ভাষায় মানুষের দুঃখ লিখতে চায়—সেখানে শামছুর রহমানের ছায়া এসে পড়ে।
তাঁর মৃত্যু আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল এক শক্তিশালী কণ্ঠ, কিন্তু রেখে গেছে অসংখ্য অনুপ্রেরণার সূত্র। আজকের এই দিন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সত্যের পথ কখনো নিঃসঙ্গ নয়—তাতে সাহসীরা পথ করে যান, তাঁদের পদচিহ্ন ধরে এগিয়ে যেতে হয়।
শামছুর রহমানের পরিবার আজও তাঁকে খোঁজে প্রতিটি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি স্মৃতির আলো-ছায়ায়। সমাজ এখনও তাঁকে স্মরণ করে একজন সাহসী সাংবাদিক হিসেবে, যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন আপসহীন, আর মাটির কাছাকাছি একজন মানুষ হিসেবে ছিলেন হৃদয়ের অতল থেকে উদিত।
শিউলি ঝরা ভোরে, অথবা শিমুল ফোটা বসন্তে—যখনই প্রকৃতি আপন ভাষায় কথা বলে, তখন তাঁর লেখা আমাদের কানে বাজে। তাঁর ভাষা ছিল নির্ভার, অথচ গভীর। এমন একজন সাংবাদিক শুধু একটি প্রজন্মের নয়, পরবর্তী সব প্রজন্মের জন্যও হয়ে উঠেন পথপ্রদর্শক।
আজ তাঁর প্রয়াণের রজতজয়ন্তীতে আমাদের একটাই কথা—শামছুর রহমান ছিলেন, আছেন, থাকবেন—সাংবাদিকতার হৃদপিণ্ডে, সাহসের শিরায়, বিবেকের বিস্তারে।
শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় আমরা তাঁকে স্মরণ করি। তাঁর দেখানো পথেই আমরা শিখি, সত্যকে ভালোবাসতে হয়, মানুষকে ভালোবাসতে হয়—আর তাতেই একজন সাংবাদিক হয়ে ওঠেন সত্যের প্রকৃত অনুবাদক।
শামছুর রহমানের জন্ম ১৯৫৭ সালের ৫ মে, যশোর জেলার শার্শা উপজেলার শালগ্রামে। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির প্রতি আগ্রহ ছিল তাঁর। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন শিববাস শালকোনা সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। এরপর তিনি পাকশিয়া হাই স্কুল ও লক্ষণপুর হাই স্কুলে অধ্যায়ন করেন। উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন যশোর সিটি কলেজে। পরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স ও মাস্টার্স করেন যশোর সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন সাংবাদিকতাকে। যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘দেশহৈতিষী’, ‘দৈনিক ঠিকানা’, এবং ‘দৈনিক বাংলা-তে তিনি কাজ করেন একাগ্রতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে। পরে তিনি যোগ দেন দৈনিক জনকণ্ঠ-এ। সেখানে তিনি সর্বশেষ বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।
শুধু সংবাদের জন্যই নয়, গবেষণামূলক ও মানবিক প্রতিবেদন তৈরিতে তাঁর ছিল দক্ষতা। তিনি ছিলেন সংবাদপত্রের পাশাপাশি ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ পত্রিকার একজন নিয়মিত লেখক। সেখানে বিভিন্ন সময় সমাজ, রাজনীতি, ইতিহাস ও সীমান্তজনিত সংকট নিয়ে তাঁর লেখা প্রবন্ধ পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করত।
শামছুর রহমানের লেখালেখির ক্ষেত্র শুধু সাংবাদিকতায় সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি একজন কথাসাহিত্যিক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তাঁর প্রকাশিত বই ‘ধূসর সীমান্তে’ একটি প্রামাণ্য দলিলস্বরূপ গ্রন্থ, যেখানে তিনি সীমান্তবাসীর জীবনসংগ্রাম এবং উপমহাদেশীয় রাজনীতির অন্যতম মুখ জ্যোতি বসুকে নিয়ে বই ‘রাজনীতির জ্যোতি বসু’ পাঠক সমাজে ব্যাপক সমাদৃত হয়। বইটি পাঠক ও সমালোচক মহলে প্রশংসিত হয়।
২০০০ সালের ১৬ জুলাই, যশোরে তাঁর নিজ অফিসে কাজ করাকালীন সময়ে সন্ত্রাসীরা খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করে তাঁকে। এ ঘটনা বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার উপর এক দুঃসহ আঘাত হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এখনো তাঁর হত্যার বিচার দাবি করে আসছে সহকর্মীরা এবং সাংবাদিক সংগঠনগুলো।
শামছুর রহমান ছিলেন একটি আলোকবর্তিকা, যিনি ন্যায়ের পক্ষে, নিপীড়িতের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করতেন। সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে উঠে এসে তিনি জাতীয় পর্যায়ে সাংবাদিকতার দৃঢ় ভূমিকা রেখেছেন। তিনি কেবল একজন সংবাদকর্মী ছিলেন না, ছিলেন সত্য ও সাহসের প্রতীক।
সাজেদ রহমান : লেখক, সাংবাদিক ও প্রয়াত শামছুর রহমানের ভাই