দুর্ঘটনা
মহাসড়ক যেন মৃত্যুপুরি

২০০০ সালের জুন মাস। একটি প্রয়োজনে ঢাকা থেকে যশোর যাচ্ছিলাম। আমার নৈশকোচটি ঢাকা থেকে যখন যশোরের উদ্দেশে রওনা হলো, তখন রাত ১০টা। আমার বাসটি গাবতলী ছেড়ে যখন ঢাকা-দৌলতদিয়া মহাসড়কে উঠল, তখন আমি অনুভব করতে লাগলাম আমি মোটামুটি হাওয়ায় ভাসছি।
কেননা গাড়ির গতি এত বেশি ছিল যে মনে হচ্ছিল ভূমি থেকে চার পাঁচ ইঞ্চি ওপরে উঠে তীব্র গতিতে ছুটে চলছে। বাসের গতি দেখে অনেক যাত্রী চালককে বলছিলেন, ভাই এত জোরে কেন চালাচ্ছেন? চালক যাত্রীদের কথায় কোনো ভ্রুক্ষেপ করলে তো না-ই, উল্টো গতি আরো বাড়িয়ে দিল। গাড়ির সে কী গতি! মহাসড়কের একেকটি বাক ও গতিরোধকের ওপর দিয়ে যখন যাচ্ছিল, তখন কেবলই মনে হচ্ছিল এই বুঝি উল্টো গেল।
আমি নৈশকোচে অভ্যস্ত হওয়ায় প্রথম দিকে ভয় না পেলেও আমার বাস যখন মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া থানায় গাবতলী থেকে মাত্র ৩৭ মিনিটে পৌঁছে গেল, তখন আমার মনের ভেতরও কেমন ভীতি কাজ করতে লাগল। এত অল্প সময়ে এখানে পৌঁছানো আদৌ সম্ভব কি না, সেটা ভাবতে ভাবতেই আমি ভয়ে ভেতর থেকে সংকুচিত হয়ে আসতে থাকলাম। বয়স তখন নিতান্তই কম, তাই চালককে কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। এভাবে মাত্র পৌনে দুই ঘণ্টার ভেতর আমরা দৌলতদিয়া ঘাটে পৌঁছে গেলাম।
সেদিন ঘাটে যানবাহনের কোনো লাইন না থাকায় আমাদের বাসটি ফেরিতেও উঠে গেল বেশ তাড়াতাড়ি। আমরা যখন পদ্মা পাড়ি দিলাম তখন রাত দেড়টা। গাড়ি ফেরি থেকে নেমেই আবার যথারীতি সেই আগের টান অব্যাহত রেখে যখন গোয়ালন্দ মোড় পার হয়েছে, তখনই ঘটে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি।
গোয়ালন্দ মোড় পার হয়ে কিছুটা সামনে যেতেই দেখলাম চালক আঁতকা ব্রেক করলে এবং গাড়িটি জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল। সামনের সিটের পেছনের দিকটায় আমার মুখমণ্ডল গিয়ে সজোরে লাগে এবং আমার নাক দিয়ে রক্ত পড়া শুরু হয়ে যায়। তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকায় কিছু বুঝে ওঠার আগেই এমন ধাক্কা খেলাম যেন মুহূর্তেই আমি জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লাম।
আর আমার পাশের ঘুমন্ত যাত্রীদের দেখলাম কেউ সজোরে চিৎকার করছে অ্যাক্সিডেন্ট! অ্যাক্সিডেন্ট! বলে। আর কেউ বা নিজের সিট থেকে পড়ে গেছে। কোনো রকম উঠে চালকের দিকে হাঁটা দিতেই বাসের হেডলাইটের আলোতে দেখলাম রাস্তার পাশে একটি মানুষের রক্তাক্ত শরীর পড়ে আছে। আমি ভয় পেলাম, ফলে আর সামনে যেতে পারলাম না। ড্রাইভারকে দেখলাম তার জানালা দিয়ে বাইরে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। এরপর এমন টান দিল, প্রায় সোয়া এক ঘণ্টায় আমাদের গাড়ি চলে এল মাগুরা ভায়নার মোড়ে। এরপর কিছুটা ধীরালয়ে গাড়ি চালিয়ে চালক আমাদের যখন যশোর গাড়িখানা নামিয়ে দিল, তখন ভোর ৪টা।
এই ঘটনা থেকে আমার কয়েকটি উপলব্ধি হয়েছে। সেগুলো হলো : আমার বাসের চালককে বারবার সতর্ক করার পরও সে সতর্ক হচ্ছিল না। তার মানে সে বা তারা যাত্রীদের পাত্তা দিতে প্রস্তুত নয়। যাকে পাত্তা দেওয়ার কথা অর্থাৎ হাইওয়ে পুলিশ তাদের কোনো হদিসই ছিল না।
ঢাকা থেকে যশোর নিছক কম দূরত্ব নয়। এত দীর্ঘ একটি ভ্রমণে পুরো মহাসড়কের দুই পাশে কোনো আলোর ব্যবস্থা আমার চোখে পড়েনি। আজও হয়েছে বলে মনে হয় না।
আর যে মানুষটিকে গোয়ালন্দ মোড় থেকে ধাক্কা দিয়ে রক্তাক্ত করে দ্রুতগতিতে পালিয়ে এলো, কই কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তো একবার ধাওয়াও করল না! যা হোক এভাবেই হয়তো অনাদি, অনন্তকাল থেকে চলে আসছে।
নৈশকোচ দুর্ঘটনা যেমন নতুন কোনো বিষয় নয়, তেমনি ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনাও এ দেশে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের দেশে ঈদের সময় সড়কপথে দুর্ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যা বছরের অন্যান্য সময়ের চেয়ে বহুগুণ বেড়ে যায়। চলতি একটি পরিসংখ্যান থেকেই এর সত্যতা পাওয়া যাবে। যেমন গেল বছরের ঈদুল ফিতরে সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে যেখানে ১৫ জনেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, ঈদুল আজহার সময় তা বেড়ে হয়েছে প্রতিদিন গড়ে ১৭ জনের বেশি। গত ১০ দিনে সড়ক-মহাসড়কে দেড় শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এটা কি কোনো সভ্য দেশে হতে পারে?
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে ৮৫ দশমিক ৫ শতাংশ। পশ্চিমাদের প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মাত্র ৩ শতাংশ। আশঙ্কার কথা হলো, সড়ক দুর্ঘটনায় এ দেশে প্রতিবছর কতজন নিহত হয়, সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। পুলিশের হিসাবে তিন-চার হাজার। আর বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্যমতে আট হাজার ৬৪২ জন। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে প্রায় ১২ হাজার মানুষের প্রাণ যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সংখ্যাটি প্রায় ১৮ হাজার।
কেন মহাসড়কগুলোতে এমন মৃত্যুর মিছিল? সংশ্লিষ্টরা বলছেন বেপরোয়া গতি, বেশি সংখ্যক ট্রিপ মারার প্রবণতা, সড়ক মহাসড়কগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর না থাকা ও চালকদের স্বেচ্ছাচারিতাই এর মূল কারণ। পাশাপাশি ভাঙাচোরা ও ত্রুটিপূর্ণ সড়ক, ভুয়া লাইসেন্সধারী চালক, ওভার টেকিং, নিয়ম না মানা এবং জনসচেতনতার অভাব।
এ ছাড়া আছে নির্ধারিত গতিসীমার চেয়ে বেশি গতিতে যান চালানোর প্রবণতা, সড়কের সংকীর্ণতা, বিপজ্জনক বাঁকের মতো মরণফাঁদকে তোয়াক্কা না করা। নছিমন, ভটভটি, অটোরিকশার মতো তিন চাকার যান মহাসড়কে চলাচল করা ইত্যাদি।
মহাসড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম আরেকটি কারণ হলো দুর্বল মোটরযান আইন এবং এর কোনো প্রয়োগ না থাকা। মোটরযান আইনে সড়ক দুর্ঘটনায় চালকের শাস্তি মাত্র তিন বছর! মজার ব্যাপার হলো, এই আইনেরও কোনো প্রয়োগ নেই। দণ্ডবিধি অনুযায়ী মামলা হলেও তার কোনো নিষ্পত্তি হয় না।
তাই যদি হয়, তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা তো একটি চলমান অপ্রিয় সত্য হয়েই এ দেশের মানুষের রাতের ঘুম কে নেবে, মানুষ রাস্তায় বের হতে ভয় পাবে, দেশ ও সরকারের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলবে।
আমার ধারণা, সরকারের নেওয়া কিছু পদক্ষেপ এ দেশের সড়ক দুর্ঘটনারোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
১. চলতি মোটরযান আইন সংস্কার করে নতুন আইনের প্রয়োগ এবং তা বাস্তবায়ন করা। প্রয়োজনে ঘাতক চালকের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা।
২. ফিটনেসহীন বাস মহাসড়কে চলতে না দেওয়া।
৩. শ্রমিক ইউনিয়নের স্বেচ্ছাচারিতা বিলুপ্ত করা।
৪. মহাসড়কগুলোতে গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রক প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করা। যারা নির্ধারিত গতিসীমা অতিক্রম করবে, তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা।
৫. মহাসড়কের শৃঙ্খলার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক হাইওয়ে পুলিশ নিয়োগ দেওয়া।
৬. চালকের সুস্থ শারীরিক অবস্থা নিশ্চিত করে তারপর গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়া। আর এই ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে হবে পরিবহন কর্তৃপক্ষকেই।
৭. চালক গাড়ি চালানো অবস্থায় কোনোভাবেই মোবাইল ফোনে যেন কথা বলতে না পারে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে। প্রয়োজনে গাড়িতে সিসি ক্যামেরা বসানো যেতে পারে।
৮. চালকের অবশ্যই বৈধ লাইসেন্স থাকতে হবে।
৯. ক্ষতিগ্রস্ত এবং ত্রুটিপূর্ণ মহাসড়কগুলো দ্রুত সংস্কার করে জনসাধারণের ব্যবহার উপযোগী করে তোলা।
১০. পথচারীদের রাস্তা পারাপারেও আইনের প্রয়োগ প্রয়োজন। মহাসড়কের নির্ধারিত স্থান বা জেব্রা ক্রসিং ছাড়া পথচারীরা কোনোভাবেই রাস্তা পার হতে পারবেন না।
১১. সড়ক দুর্ঘটনারোধে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা।
উল্লিখিত ১১টি পদক্ষেই শেষ নয়। এ দেশে আরো বিশেষজ্ঞ আছেন, আছেন সমাজ ও রাষ্ট্রসচেতন ব্যক্তিবর্গ। আসুন আমরা সবাই মিলে একটি নিরাপদ সড়কের বাংলাদেশ গড়ে তুলি।
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক