শিক্ষা দিবস
সুশিক্ষাই হোক এবারের শিক্ষা দিবসের ব্রত

একটি দেশের জন্য শিক্ষা কোনো সুযোগ নয়, অধিকার। সেই সার্বজনীন শিক্ষার অধিকারের জন্য সংগ্রামী এ বাঙালি জাতিকে আন্দোলন করতে হয়েছে। এসব ইতিহাস পর্যালোচনা করার জন্য বারবারই আমাদেরকে পিছনের কথা জানার প্রয়োজন রয়েছে। ব্রিটিশদের শাসন শোষণের হাত থেকে রক্ষা পওয়ার জন্য পুরো পাক-ভারত উপমহাদেশ যখন স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর তখন আমাদের এ বাংলার নেতারাও এতে সায় দিয়ে সর্বশেষ ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশমুক্ত করতে সমর্থ হয়েছিল। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেই স্বপ্নে চির ধরতে শুরু করেছিল। কথিত আছে, যখন তাদের এ সাম্ররাজ্য ছেড়ে চলে যেতে হলো তখন ব্রিটিশরাই তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার অংশ হিসেবে ধর্মের ভিত্তিতে দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টি করে রেখে গেল।
সেখানে আরো যেটি আশ্চর্যের বিষয় তা হলো পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে তৈরি হলো অবাস্তব একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। কারণ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের দুটি প্রদেশের মাঝখানে ভারত নামক একটি স্বাধীন দেশ যেখানে দুটি প্রদেশের মধ্যকার দূরত্ব প্রায় এক হাজার ২০০ মাইল। এ রকম দূরের দুটি প্রদেশ মিলে কীভাবে একটি স্বাধীন দেশ হতে পারে তা নিয়ে কেউ কোনোদিন কল্পনাও করতে পারেনি। সেজন্য পাকিস্তানের সৃষ্টিটাই মূলত সমস্যাযুক্ত। তখন থেকে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মন্তব্য করেছিলেন, ‘এ দুটি প্রদেশ নিয়ে কখনোই একটি দেশের অস্তিত্ব পৃথিবীর মানচিত্রে থাকতে পারে না।’ আর পশ্চিম পাকিস্তানিরাও এ বিষয়টি অক্ষরে অক্ষরে অনুধাবন করতে পেরেছিল। সেজন্য ’৪৭ পরবর্তী সময়ে শুরু হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের ধন-সম্পদ লটতরাজের ঘটনা। সেজন্যই তারা প্রথমেই হাত দিয়েছিল বাঙালির ভাষা ও শিক্ষায়। কারণ ’৪৮ সালেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল উর্দু হবে একমাত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।
দেশ ভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৫৬% এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৪৪%। তারপরও শাসনে-শোষণে তারাই অগ্রগণ্য ছিল। তারই ধারবাহিকতায় শিক্ষার হার কমানো ও সর্বক্ষেত্রে বিমাতাসুলভ আচরণের অংশ হিসেবে পূর্ব বাংলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যাই শুধু কমায়নি, তারা এখানকার শিক্ষার সব সুযোগ-সুবিধা আস্তে আস্তে কমিয়ে দিচ্ছিল। সেজন্য তখনকার একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ১৯৪৭-৪৮ সালে যেখানে পূর্ব বাংলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল ২৯ হাজার ৬৩৩টি, সেখানে মাত্র পাঁচ-ছয় বছরের ব্যবধানে সেই সংখ্যা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ২৬ হাজারটিতে। সেখানে শিক্ষার সুযোগ না পেয়ে তখন যারা বিদ্যালয়ে ভর্তি হতো তাদেরও একটি বিরাট অংশ ঝড়ে পড়ত। তখন শেখ মুজিব তরুণ নেতা হিসেবে আস্তে আস্তে স্বাধীকার ও স্বাধীনতার আস্বাদ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন পূর্ব বাংলার নাগরিকদের মাঝে। কাজেই তখনকার প্রাদেশিক জাতীয় নেতৃবৃন্দ, কেন্দ্রীয় ছাত্র নেতৃবৃন্দসহ সচেতন সকল মহলের নিকট এসব অসম উন্নয়ন ও বঞ্চনার চিত্র ধরা পড়তে থাকে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যখন পশ্চিম পাকিস্তান উর্দুকে প্রতিষ্ঠা করতে না পেরে একবার ধরাশায়ী হয়েছে, তখন থেকে এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তারা উদগ্রীব হয়ে রয়েছে সবসময়। সেজন্য ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবরে সামরিক শাসন জারির পর উর্দু ভাষায় এ দেশের জনগণকে শিক্ষিত করার ঘৃণ্য অপপ্রয়াসে আইয়ুব খান সরকারের তৎকালীন সচিব এবং তাঁরই এক সময়কার শিক্ষক এসএম শরিফকে প্রধান করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট এক শিক্ষা কমিশন গঠন করেন ইতিহাসে যাকে ‘শরিফ কমিশন’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। সে কমিশনে পূর্ব বাংলার চারজন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বাকিদের নিয়ে ১৯৫৯ সালে একটি রিপোর্ট আইয়ুব সরকারের নিকট পেশ করে। পরে ১৯৬২ সালে সরকার সে রিপোর্ট প্রকাশ করলে করাচি থেকে ফিরে এসে একে জনবিরোধী হিসেবে আখ্যা দেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। পরে ছাত্ররা সর্বপ্রথম এর বিরোধিতা করে মিছিল ও আন্দোলন-সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে। সেজন্য ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকেই আন্দোলন চলতে থাকে তবে ১০ আগস্ট থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ আন্দোলন-সংগ্রামে তৎকালীন বৃহৎ দুটি ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সিরাজুল আলম খান, রাশেদ খান মেনন, মহিউদ্দীন আহমেদ, হায়দার আকবর খান রনো, নুরুল ইসলাম নাহিদ, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, আইয়ুব রেজা চৌধুরী, কাজী ফারুক আহমদ, রেজা আলী প্রমুখ ছাত্র নেতার আহ্বানে চলতে থাকে।
অতঃপর এতেও সরকারের টনক না নড়াতে তখন চলতে থাকে হরতাল অবরোধের মতো কর্মসচিও। সেজন্য ১৭ সেপ্টেম্বর আহুত হরতালের সমর্থনে মিছিল চলাকালে পুলিশের গুলিতে সেদিন নিহত হন নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র বাবুল, বাস কন্ডাক্টার গোলাম মোস্তফা এবং গৃহকর্মী ওয়াজিউল্লাহ প্রমুখ। তখন শিক্ষা আন্দোলন আরো বেগবান হয়েছে যা ইতিহাসে ’৬২’র শিক্ষা আন্দোলন নামে পরিচিত। কথায় বলে, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল, কিন্তু ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন সেই চেতনায় বহুমাত্রিক সংস্কৃতি এনে দিয়েছিল। সেদিনের সেই শিক্ষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশে ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয়েছে ‘শিক্ষা অধিকার সমাধি’।
যে শিক্ষার দাবি আদায়ের জন্য আমাদের সেদিনের দামাল ছেলেরা যুদ্ধ করেছিল। এখনো কী এর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে? এর পরে পাকিস্তানি আমলে এমনকি বাংলাদেশ আমলেও হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন, ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন, মজিদ কমিশন ইত্যাদি বেশ কিছু কমিশন গঠন করা হলেও প্রকৃত অর্থে জনবান্ধব শিক্ষার রূপরেখা কোনোটাতেই পাওয়া যায়নি বলে মন্তব্য শিক্ষাবিদদের। কিন্তু শিক্ষাকে বারবারই পরীক্ষামূলকভাবে চালাতে চালাতে সবকিছুই যেন একটি জগা-খিচুরি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে যে যার মতো চেষ্টা করলেও এর ভিতর দিয়েই যতটুকু সম্ভব এগিয়েছে থর্ন ডাইকের ‘প্রচেষ্টা এবং ভ্রম সংশোধন (ট্রায়াল অ্যান্ড এরর)’ পদ্ধতির মাধ্যমে। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষাকে সার্বজনীন করে তাকে বর্তমানের পঞ্চম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। সেখানে নারী শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সেইসঙ্গে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কারিগরি শিক্ষাকে। স্নাতক পর্যন্ত নারী শিক্ষাকে অবৈতনিক করা হয়েছে। প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল ও মাদ্রাসা পর্যায়ে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হচ্ছে প্রতিবছরের পহেলা জানুয়ারিতে। সেটিকেই উৎসব হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। শিক্ষাকে সবচেয়ে অগ্রাধিকারে গুরুত্ব দিয়ে দেশে বর্তমানে ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং প্রতিটি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সরকারি পরিকল্পনা রয়েছে।
বর্তমানে প্রায় ১০০টির মতো অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিগত কয়েক মাসে প্রায় ৫ শতাধিক স্কুল ও কলেজকে জাতীয়করণ করা হয়েছে। সরকার থেকে ঘোষণা করা হয়েছে এটি একটি চলমান ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এখন আমাদের কাজ হলো সবাইকেই সুশিক্ষায় স্বশিক্ষিত করে তোলা। তাহলেই আমাদের শিক্ষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে। কারণ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কখনোই ফলপ্রসূ হতে পারে না তত দিন, যত দিন তাদের মনের শিক্ষায় শিক্ষিত করা না যায়। এবারের (২০১৬) শিক্ষা দিবসে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ এ নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠন দিবসটিকে ঘিরে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে যা পালন করা হচ্ছে।
১৯৬২ সাল থেকে সময়ের বিচারে এবারে ৫৪তম শিক্ষা দিবস পালন করা হচ্ছে। এরমধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে অনেক কিছু অর্জিত হয়েছে সত্য, কিন্তু তারপরও আরো অনেক কিছু অর্জন করতে হবে এখনো, যা মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ নিজেও তা মনে করেন। শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে বিবেচনা না করে একে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের জন্য একটি সহনশীল ও কার্যকর ভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। এটাই হোক এবারের শিক্ষা দিবসের প্রত্যাশা।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়