দৃষ্টিপাত
ঈদের আগে দ্রব্যমূল্যে আগুন!

যখন যে পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে তখন সে পণ্যের আকস্মিক মূল্যবৃদ্ধি, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন কোনো ঘটনা নয়। কোরবানি ঈদে দেশে একদিনে প্রায় এক কোটি পশু কোরবানি করা হয়ে থাকে। সে বিপুল পরিমাণ মাংস রান্না করার মূল রসদ উপাদান হলো বিভিন্ন রকমের বাহারি মসলা। মাংসের মধ্যে রান্নায় সুঘ্রাণ ও সুগন্ধি ছড়াতে মসলার কোনো বিকল্প নেই। মাংস সিদ্ধ করতেও যেমন মসলার প্রয়োজন, আবার মাংস সংরক্ষণের জন্যও মসলা অপরিহার্য। তা ছাড়া রেসিপি অনুযায়ী নানা রুচিশীল আইটেম প্রস্তুতেও বিভিন্ন মসলার জুড়ি নেই।
কোনো মসলার কাজ হলো খাবারের স্বাদ বাড়ানো, কোনো মসলার কাজ হলো খাবারকে নরম করা, কোনো মসলার কাজ হলো খাবারকে সিদ্ধ করা, আবার কোনোটার কাজ হলো গন্ধ, রং ইত্যাদির উন্নয়ন করা। সেগুলো মসলার মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, মরিচ, তেজপাতা, এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, জিরা, গোলমরিচ, জায়ফল (খোসা ও বিচি), সরিষা, পাঁচফোড়ন ইত্যাদি। তার মধ্যে তেজপাতা, এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, জিরা, গোলমরিচ, জায়ফল ইত্যাদি মসলাকে একত্রে গড়মসলা বলা হয়ে থাকে। এ মসলাগুলো সারা বছরই কমবেশি দরকার হয়। কিন্তু কোরবানির ঈদে তা ব্যাপক হারে প্রয়োজন হয় বিধায় যত সমস্যা। সে জন্য একশ্রেণির মুনাফালোভী অসৎ ব্যবসায়ী অযাচিত, অন্যায় ও অবৈধভাবে এসব মসলার দাম বাড়িয়ে দেয়। ব্যবসায়ীরা যেন এমন একটি সময়ের জন্য দাও মারতে অপেক্ষা করতে থাকেন।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে প্রকাশিত তথ্যমতে জানা যায়, কোনো রকমে রমজানের ঈদটা পার করতে পারলেই হলো। রমজানের ঈদের পর থেকেই কোরবানি ঈদকে উপলক্ষ করে আস্তে আস্তে এসব নিত্যব্যবহার্য মসলার দাম বাড়তে থাকে। আর কোরবানির ঈদ যত এগিয়ে আসতে থাকে, ততই যেন এসব মসলার মূল্যের ঝাঁঝ সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাসে এসে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দেয়। অথচ চেতনাটা হওয়া উচিত ছিল ঠিক উল্টো। কারণ যখন যে পণ্যের চাহিদা বেশি থাকবে এবং এর বিক্রি-বাট্টাও বেশি হবে তখন স্বাভাবিকভাবে এর মূল্য কম হওয়া উচিত। কম লাভে বেশি বিক্রি করে লাভের খাতায় বেশি অর্থ যোগ করা যায়। যারা বেশি লাভের আশায় মানুষকে এমন কষ্ট দেয়, তারা কোনো অবস্থাতেই সৎ ব্যবসায়ী হতে পারেন না। আর যেখানে অসততা সেখানেই সমস্যা।
ঈদুল ফিতরের আগে রমজানের মধ্যে যেমন তখনকার নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি যেমন পেঁয়াজ, রসুন, তেল, চিনি, বেসন, ছোলা, খেজুর, শসা, কাঁচামরিচ, ডাল, বেগুনসহ সব ধরনের সবজি, অন্যান্য ফল-মূল ইত্যাদির মূল্য বৃদ্ধির নজির রয়েছে। সেগুলোর মূল্য কখনো-সখনো যে শুধু একটু-আধটু বাড়ে তা নয়, অনেক সময় হু-হু করে ডাবল ট্রিপল বেড়ে যায়। তখনো দেখা যায় শেষ বিচারে অসাধু ব্যবসায়ীদেরই কারসাজি থাকে সেখানে। এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষের। কারণ তাদের আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি যখন থাকে না, তখন তারা পারিবারিক ব্যয়ের হিসাব মেলাতে হিমশিম খায়।
কষ্টের বিষয় হলো, এবারও তার কোনো ব্যতিক্রম হচ্ছে না। ঈদ আসছে, বেড়ে চলেছে ঈদের অন্যতম উপকরণ মাংসের মসলার দাম। অথচ সারা দেশের বিভিন্ন সংবাদ ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সরেজমিন প্রতিবেদনে প্রকাশ, কোথাও চাহিদার সঙ্গে মজুদের কোনো ঘাটতির কথা শোনা যায়নি। এ কথা এখন পর্যন্ত কেউ বলতে পারছে না যে, সরবরাহ কম, চাহিদা বেশি, মজুদ কম সে জন্য দাম বেশি। বরং প্রতিটি অনুসন্ধানেই বেরিয়ে আসছে ব্যবসায়ীদের ঠকবাজির করুণ চিত্র। উপরন্তু প্রতিটি মসলার দামই কেজিপ্রতি দেড় থেকে দুইশো টাকা বেড়ে গিয়েছে। এবং তা কখনোই একটি জায়গায় স্থির থাকছে না। আজ এ দামে আছে তো কাল আবার বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। জাত, উৎস, আমদানির দেশ ও প্রকারভেদে এলাচি, দারুচিনি, তেজপাতা, আদা, হলুদ, মরিচ, গোলমরিচ, লবঙ্গ প্রতিটি মসলার দামই ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। আর পেঁয়াজ, রসুন, তেল, ডাল-চাল তো রয়েছেই।
সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনেক আগে থেকেই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েও অসাধু ব্যবসায়ীদের ধূর্ততার সঙ্গে যেন পেরে উঠতে পারছে না। তবে ঈদের আগে এসব পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি যে এবারই প্রথম হয়েছে তা নয়। এটি একটি সাংবাৎসরিক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মূল্য যাচাই করে যৌক্তিক মুনাফা ধরে ব্যবসায়ীদের বাধ্য করতে হবে নির্ধারিত মূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রি করতে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের ডেকে মিটিং করে ঈদের আগে যৌক্তিক মূল্যে বিক্রি করছে কি না তা মনিটরিং করার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
এখানে খুব সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হবে যাতে এ নিয়ে আবার কোনো পেনিক সৃষ্টি না হয়। কারণ বিগত এক-এগারোর বিশেষ সরকারের আমলে দ্রব্যমূল্য কমানোর জন্য সামরিক কৌশল ব্যবহার যে হিতে বিপরীত হয়েছিল, সেটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। বাংলাদেশে একবার কোনো পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেলে তা আবার কমার খুব একটা ইতিহাস নেই কিনা! ফলস্বরূপ তখনকার বাড়তি মূল্য কমিয়ে এখনো যৌক্তিক করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আবার এটাও একটা চিন্তার বিষয় যে, ঈদের সময় বাড়তি মূল্যে কোনো মসলা কিনে খেলেও ঈদ চলে গেলই যে তা আবার কমে আসবে তা নয়। ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয় না। কাজেই মসলার মূল্য কমানোর জন্য এখনই আমাদের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এবার না হলেও আগামী যে কোনো সময়েও যেন এমনটি হতে না পারে সেদিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি দিতে হবে। এমনিতেই কোরবানি ঈদ এলেই কাঁচা চামড়ার জন্য প্রয়োজনীয় লবণের দাম বৃদ্ধি পায় এবং কিন্তু গরিবের হক চামড়ার মূল্য কমে যায়। সেগুলোর কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। এর সবগুলোকেই অনুসন্ধানের মাধ্যমে বের করে আনতে হবে। তদানুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
লেখক : কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়