টঙ্গী ট্র্যাজেডি
অঙ্গার হওয়াই কি শ্রমিকের প্রাপ্য?

মালিক-শ্রমিক একতা উন্নয়নের মূল কথা- এমন কথা ধনতান্ত্রিক সমাজে হরহামেশাই শুনতে পাওয়া যায়। কিন্তু শ্রমিকের অকাল বা অসময় পরিণতি কেমন তা আমাদের দেশের চেয়ে আর কে বেশি জানে? এখানে রোজ ভয়ংকর কর্মপরিবেশে নিশ্চুপ মানবেতর কর্মজীবন যাপন করে যান শ্রমিকরা। যে শ্রমিকের শ্রম ও ঘামের নির্যাসে গড়ে ওঠে মালিকদের স্বপ্নসৌধ।
অথচ নিদারুণ বিপর্যয় আর বেদনাদায়ক দুর্বিপাকে যুগে যুগে প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের মর্মান্তিক মুক্তি ঘটে। যাদের জীবনে আনন্দ উৎসব বলে কিছু কোনোকালেই থাকে না, তাদের আগেভাগেই নানা দুর্বিপাকে ফেলে মহান ঈশ্বর তাঁর কাছে নিয়ে নেন। লোভী মালিকের হেফাজতে থেকে ধুঁকে ধুঁকে শ্রমিকের অঙ্গার হওয়ার চেয়ে একনিমিষে কয়লা হওয়াই ঈশ্বরের কাছে হয়তো অভিপ্রেত। তবু মুনাফালোভী অর্থপিপাসু মালিকরা শানশওকতে ভালো থাকুন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। বাংলাদেশে এর সর্বশেষ উদাহরণ টঙ্গীর বিসিক শিল্পনগরীর ট্যাম্পাকো অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল প্যাকেজিং কারখানা।
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ তারিখ শনিবার সকালে ওই কারখানার গ্যাসলাইনের প্রধান নিয়ন্ত্রণকক্ষে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর আগুন লেগে মানুষের প্রাণহানি ও দগ্ধের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণে পাঁচতলা কারখানা ভবন ও পাশের দুটি তিনতলা ভবন ধসে পড়ে। আরেকটি ছয়তলা ভবন মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ঈদ উপলক্ষে পরের দিন রোববার থেকে কারখানায় ছুটি শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অসহায় শ্রমিকদের ভাগ্যে ঈদের ছুটি আর জোটেনি। কয়েক ডজন শ্রমিক পুড়ে মারা যাওয়ার পর ধারণা করা হচ্ছে, ভেতরে বিপুল শ্রমিক আটকা পড়েছেন, তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটেছে তা সহজেই অনুমেয়। কারণ এরই মধ্যে কারখানাটি ভস্মীভূত হয়ে ধসে পড়েছে। এমন মানবিক বিপর্যয়ে নিখোঁজ শ্রমিকদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠছে কারখানা এলাকা।
ওই কারখানার বয়লার অপারেটর ইমাম উদ্দিন দাবি করেছেন, বেশ কিছুদিন ধরেই গ্যাস নিয়ন্ত্রণ কক্ষসহ কারখানার বিভিন্ন পয়েন্টে গ্যাস লিক হচ্ছিল। কারখানার মালিক ড. মকবুল ও কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানোর পরও তাঁরা এতে গা করেননি। যার ফল এই মানবিক বিপর্যয়।
এভাবেই মালিক বা আধিকারিকদের অবহেলায় বারবার পুড়ে যায় শ্রমিকের কপাল, দেহ, মন, স্বজন, সন্তান সব। আর পুড়ে যাওয়া শ্রমিকের ফসিলে বিনির্মাণ হয় মালিকদের সুবর্ণ ভাগ্য। শ্রমিক যে বড়ই ফেলনা! তাকে দেখলেই রাজ্যের ক্ষিধে পায় মালিকের বশংবদ আগুনের। তবে তাই হোক শ্রমিক খাবারই হতে থাক। আগুন মিইয়ে গেলে রাষ্ট্রও লেলিহান আগুনকে বাতাস বরাদ্দ করবে! শ্রমিক যাতে ভালো করে পোড়ে। ফ্রাই হয়। মনুষ্য ফ্রাই কি তবে লাটসাহেবের প্রিয় খাবার?
বারবার এমন আগুনে মানুষের চোখে জল আসে। দুঃখভারাক্রান্ত হয় তারা। কিন্তু অমানুষের কি কিছু আসে-যায়? বিগত কয়েক বছরে গাজীপুরের গরিব অ্যান্ড গরিব সোয়েটার কারখানা, পুরান ঢাকার নবাব কাটারার নিমতলী, রাজধানীর দোলাইর পাড় এলাকায় বেবি সলিউশন কেমিক্যাল কারখানা, আশুলিয়ার নরসিংহপুরে হা-মীম গ্রুপের দ্যাটস ইট নামের পোশাক কারখানা ও আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশন্স এবং ট্যাম্পাকোর মতো এমন ধারার ভয়াবহ কিছু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা যেমন ছিল বিপুল, তেমনি ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও ছিল ব্যাপক। ঘটনা ঘটলেই বরাবরে মতো গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। কমিটিগুলো তাদের প্রতিবেদনও পেশ করে। কিন্তু এ পর্যন্তই। তারপর কী হয় তা কেউ জানে না। যারা তদন্ত করে তাদের ইচ্ছেকৃত ভুলে যাওয়া বাতিকে সবকিছু চলে আগের মতোই। কারণ এই দেশে ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। তাজরীন, রানা প্লাজা বা সর্বশেষ ট্যাম্পাকোও সেই শিক্ষা দেবে এমনটা ভাববার কোনো কারণ নেই। দেশের ধনতান্ত্রিকদের কাছে এখনো শ্রমিকের জীবন পোকা-মাকড়ের চেয়ে খুব বেশি কিছু নয়। সস্তায় শ্রম পাওয়া যায় বলে অমানবিক, অনিরাপদ ও অসহায় জাতীয় সস্তার তিন অবস্থার যাতাকলে নিপতিত করে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য করা হয় শ্রমিকদের। বিপুল বিস্তারি রক্তপিপাসু পুঁজিবাদ শ্রমিককে সংগঠন, সংগ্রাম ও বিপ্লবের পথকে নিরন্তর বাধাগ্রস্ত করে চলে যার যার আপন স্বার্থে। কাজেই বারংবার ঘটে চলা হৃদয় বিদীর্ণ ট্র্যাজিক মৃত্যুর মিছিল আর নিরন্তর অঙ্গার হওয়াই বুঝি শ্রমিকের নিদারুণ নিয়তি।
আমাদের এখানকার পুঁজিবাদীরা অবতারণা চাল-চলনে ও কথায়-বলনে খুব সিদ্ধিপ্রাপ্ত ধর্মপুরুষ হিসেবে নিজেদের জাহির করবার প্রয়াস পান। কিন্তু সাম্যবাদের প্রাণপুরুষ মহানবী (সা.)-এর এই কথাটি কি তাঁরা জানেন অথবা মানেন, ‘মজুর, শ্রমিক ও অধীনস্ত বেতনভোগী কর্মচারীরা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদের দায়িত্ব তোমাদের ওপর অর্পণ করেছেন। অতএব, যার কোনো ভাইকে তার অধীন করে দেওয়া হয়েছে, সে যেন তাকে তাই আহার করতে দেয়, যা সে নিজে আহার করে। যেন সেই পরিধেয় পরিধান করতে দেয়, যা সে নিজে পরিধান করে থাকে। আর তাকে যেন এমন কাজ করতে বাধ্য না করে, যা করলে সে পর্যুদস্ত হবে। আর যদি এমন কাজ করতে তাকে বাধ্য করে, তাহলে যেন সে তাকে সহযোগিতা করে।’
আমাদের এখানে অধীনস্তদের নিজের ভাই সাব্যস্ত বা সহযোগিতা করা দূরে থাক, দিনের পর দিন এন্তার অভিযোগ থাকলেও সেসবে কর্ণপাত করার প্রয়োজন মনে করেন না মালিক মহাশয়রা।
দেশের শিল্প কারখানাগুলোতে অগ্নি-নিরাপত্তা বিধানে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। ফায়ার সার্ভিসকে দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষম করে তুলতেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। ট্যাম্পাকো কারখানার তিন-চারটে ভবনে ২৫টি ইউনিট ২৪ ঘণ্টা কাজ করেও আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। এমনকি আগুন লাগার কারণ জানাতে গিয়ে গোলমাল পাকিয়ে ফেলে তারা। ফায়ার সার্ভিস বলেছে, বয়লার বিস্ফোরণে আগুন, আর শিল্প মন্ত্রণালয়ের বয়লার পরিদর্শন টিম বলেছে গ্যাস কন্ট্রোল রুম বিস্ফোরণে আগুন। এই যদি হয় আমাদের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের বাস্তবতা, তবে দেশের হাজারকোটি টাকার সম্পদ বিনাশ ও শ্রমিকের বেঘোর প্রাণহানিতে আগুনকে দায় না দিয়ে মালিকের অবহেলা বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের অক্ষমতাকে দায়ী করাটা সমীচীন হবে।
যেকোনো ঘটনা ঘটলেই দিনরাত মিডিয়ার লাইভে হা-হুতাশ হয়, পত্রিকার কলাম ভর্তি হয়ে ওঠে বিদগ্ধ চিন্তায়, টিভি স্টেশনে রাতভর চলে আলাপ-আলোচনা। ঘটনাস্থলে খানিক পরপর এই মন্ত্রী, সেই মন্ত্রী টেলিভিশন ক্যামেরায় মুখ তাক করে এই করা হবে সেই করা হবে বলে ঘোষণার পর ঘোষণা দিয়ে যান। কিন্তু তাঁরা যা দেন না তা হলো সদিচ্ছা, ভালোবাসা ও কর্মনিষ্ঠা। বলার জন্য কিছু কথা বলেন, মারা যাওয়া শ্রমিকদের জন্য সামান্য টাকা বরাদ্দ করে রাজনীতির ঐতিহাসিক দায়িত্ব শেষ করেন।
তারপর আবার শ্রমিকের কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণ হয়, গ্যাস লাইন বা শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগে। কারখানা বিধ্বস্ত হয়। আগুনের চিতায় শ্রমিকের শবদেহের শ্মশান রচিত হয়। শত পরিবার পথে বসে আহাজারি করে, মায়েরা কাঁদেন, সন্তান একসময় ভুলে যায় তার বাবা বা মাকে। আর মালিক বা রাষ্ট্রের সাজিয়ে রাখা নরকের পথ ধরে আমরাও পৌঁছে যাই এক গভীর ভুলের আবর্তে।
শ্রমিক সব শেষ হয়ে যাক, ট্যাম্পাকোর নিখোঁজরা আজীবন নিখোঁজ থাকুক, তাজরীনের ১১১ আত্মা অভিশাপ দিক, তবু জানবেন কোনোদিন তাজরীনের দেলোয়ার বা ট্যাম্পাকোর মকবুলের বিচার হবে না। হাজার বছরের শোষণের মহাকাব্য একদিনে বদলাবেও না। দয়া-মায়াহীন এই সংসারে রবিঠাকুরের মতোই তো সবাই দেখে চলেছে, প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে/ বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে!
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন