ঈদ উৎসব
আলো ছড়িয়ে পড়ুক সব প্রাণে

মুসলিম সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা কড়া নাড়ছে দরজায়, আগামীকাল ঈদ। প্রাণে প্রাণে বাজছে মিলন সুর। এই সুর উৎসবের, এই সুর আনন্দের, এই সুর ভ্রাতৃত্বের, সৌহার্দের, সম্প্রীতির। ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে কাঁধে কাঁধ রেখে ঈদের নামাজ আদায় করবে যেমন, তেমনি কোরবানিকৃত পশুর মাংসও ভাগ বাটোয়ারা করে নেবে সবাই। মুখে মুখে থাকবে খুশির ঝিলিক। বাড়িতে বাড়িতে হাঁড়িতে হাঁড়িতে ছড়াবে গরু খাসির মাংসের সুঘ্রাণ। যাদের পাতে সারা বছরের কোনো দিনও মাংস ওঠে না এক টুকরা, তাদেরও এদিন মাংস উঠবে পাতে। গরম গরম ভাতের সাথে আগুন গরম মাংসের ঝোল মেখে মুখে দেবে পরম তৃপ্তিতে তারা। অনেক দরিদ্র লোকই জমানো মাংস বিক্রি করে দুটো পয়সা গোছাবে সামনের দিনের জন্য। নিছক ধর্মীয় আচারের বাইরেও কোরবানির ঈদের এই দিকটা সামাজিক বিচারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
ঈদ এই দেশে কেবলই একটি ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালিত হয় না। এখানকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাথে মিলেমিশে তৈরি করে চিরায়ত বাংলার এক মুগ্ধকর জীবনের জয়গান। লাখ লাখ নগরবাসী প্রিয়জনের সান্নিধ্য পেতে মা-মাটি-শেকড়ের টানে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চের ডেকে, বাস-ট্রাক-ট্রেনের ছাদে ঝুলোঝুলি করে ছুটে যায় গ্রামের বাড়িতে। যে মাটির পরশে জীবন পেয়েছিল পূর্ণতা ধাপে ধাপে, যেসব প্রিয়মুখের সান্নিধ্যে কেটেছে শৈশব কৈশোর, যাদের সাথে মিলেমিশে উদ্দামতায় ভরে উঠেছিল দূর্বার তারুণ্য, আরো একটি বার সেই সব মুখ, সেই নদীর পাড় বা মাথার ওপর চাঁদ ওঠা বাঁশ বাগান-বটবৃক্ষের সান্নিধ্যে পৌঁছে মানুষকে দিতে ঈদ এখানে অন্যতম প্রধান উপলক্ষ।
শুধু গ্রাম থেকে আসা নাগরিকরাই যে ছুটে যায়, তা নয়। নগরবাসীদেরও যারা শহরের বাইরে থাকে, তারাও ফিরে আসে শৈশবের স্মৃতি বিজরিত স্থানে ঈদ উৎসবে মিলিত হতে। এখানে ঈদের প্রতিটি মুহূর্ত পারস্পরিক ভাব বিনিময়, স্নেহ, প্রেম, মমতায় মাখামাখি এক অনিন্দ্য আবেশ তৈরিতে প্রয়াসী হয়। ঈদের এ আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সব প্রাণে। শুধু ঈদের দিনটি নয়, বছর ভরা জাগরুক থাকুক এদিনের মতো সম্প্রীতির মেলবন্ধন।
এই অঞ্চলের মানুষের রয়েছে বহুকালের মিলেমিশে চলার সংস্কৃতি। কী ঈদে, কী পূজায়, কী গ্রামের মেলায়, সব উপলক্ষ আয়োজনেই ধর্ম-মত নির্বিশেষে মানুষের উৎসবে মেতে ওঠার রীতি এখানে বহু প্রাচীন। বৈরিতাবিহীন সমাজ বিনির্মাণে এসব উৎসবের ভূমিকা বিরাট। তবে এটাও ঠিক যে, যে রকম বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত সমতার সমাজ কাম্য আমাদের, তা থেকে পেছনেই পড়ে আছি আমরা এখনো। ঈদের আনন্দে সবার সমান অংশগ্রহণ থাকার কথা থাকলেও তা হয়ে উঠছে না অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে। একদিকে মানুষের আয় বাড়ছে যেমন অন্যদিকে বাড়ছে ধনী-গরিবের বৈষম্য। এ ধরনের বৈষম্য যেকোনো সার্বজনীন উৎসবের আনন্দকে ম্লান করে দেয়।
তা ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে কতিপয় বিপথগামী তরুণের উগ্রবাদিতা ও জঙ্গিবাদী কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ার কারণে জনমনে অনেকাংশেই শংকা বেড়েছে, যা কোনোক্রমেই কাম্য নয়। জঙ্গিবাদ এই অঞ্চলে কোনো কালে ছিল না। বাইরে থেকে আমদানিকৃত এই ভ্রান্ত মতবাদের বিপক্ষে এরই মধ্যে ব্যাপক জনমত গঠিত হয়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীও এরই মধ্যে বেশ কিছু সফল অভিযান পরিচালনা করে কিছুটা স্বস্তিও ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। তবে ঝুঁকি যেখানে প্রাণের ওপর, হুমকি যেখানে মানবতার ওপর, সেখানে বেশি ভয় আর কম ভয়ের বিবেচনা করলে চলে না। জনগণের নিরাপত্তা হতে হবে সার্বজনীন। সবদিক থেকে নিরাপদ হতে হবে জীবন। জঙ্গিবাদী-সন্ত্রাসবাদীদের থেকে যেমন নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি করতে হবে ক্যাডার ও চাঁদাবাজদের হাত থেকেও। এই মাটি থেকে জঙ্গিবাদের শিকড় যেকোনো মূল্যে উৎখাত করতে হবে। রোজার ঈদের মতো এবারের ঈদে যেন উগ্রবাদিরা কোনো রকম বিঘ্ন ঘটাতে না পারে, সেজন্য সতর্ক-সজাগ দৃষ্টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে আশা করে দেশের জনগণ।
ছুটিতে যেসব নাগরিক শহরের আবাস ছেড়ে গ্রামে যাবে ঈদ করতে, তাদের জান মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। জনজীবনে স্বস্তি না থাকলে কোনো আনন্দই ঠিক পূর্ণতা পায় না। ঈদের আনন্দকে পূর্ণতা দিতে হলে অন্যায় খুন, গুম, অপহরণ, ধর্ষণকে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার বিকল্প নেই। অস্থিরতায়-আশংকায় থেকে উৎসব আয়োজন করা যায় বটে, তবে সে উৎসবে প্রাণ খুঁজে পাওয়া হয় দায়।
ঈদ একটি উপলক্ষ মাত্র, একটি দিনের সম্প্রীতির নজিরও বলা চলে। এখন প্রত্যাশা হলো এই নজিরকে প্রত্যক্ষ করেই সম্প্রীতির বিস্তৃতি ঘটুক। শুধু ঈদের দিন নয়, সারা বছরই লেগে থাকুক আনন্দ মনে মনে। প্রাণে প্রাণে বৈষম্যহীন সৌহার্দের যে গান বেজে ওঠে ঈদে, তা সারা বছর বাজুক। অন্যায় যত দূর হয়ে যাক। কেবল পশু কোরবানি নয় কোরবানি হোক মানুষের অন্তরে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বসতকরা পশুত্বের। স্রষ্টা পশুর রক্তমাংস পছন্দ করেন না। তিনি পছন্দ করেন নিষ্কলুষ, পশুত্বহীন, নিরহংকারী মানুষ। সভ্য সমাজেরও চাওয়া তাই।
ঈদকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় হোক। ভ্রাতৃত্ব-প্রেম-মমতা ছড়িয়ে পড়ুক হৃদয়ে হৃদয়ে। শোষণ-বঞ্চনাহীন, বৈষম্যহীন সমতার সমাজ বিনির্মিত হোক। দূর হোক অন্ধকার। উগ্রতা-জঙ্গিবাদিতা নিপাত যাক। জননিরাপত্তা নিশ্চিত হোক, স্বস্তি নেমে আসুক মানুষের প্রাণে। গণতন্ত্র বলিয়ান হোক, জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষিত হোক। ধনী-গরিবে ঘুঁচে যাক ভেদাভেদ। বছরের প্রতিটি দিনই মানুষের মনে লেগে থাকুক খুশির জোয়ার। ঈদ হোক কল্যাণের, ঈদ হোক মঙ্গলের।
সবাইকে ঈদুল আজহার অগ্রিম শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।
লেখক : শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ