টঙ্গী ট্র্যাজেডি
টাকা দিয়েই কি ক্ষতিপূরণ সম্ভব?

দিনটি ছিল শনিবার। এ বছরের ১৬ জুলাই। সকাল সাড়ে ৬টার দিকে নওগাঁ শহরের লকরপুর এলাকায় কানাইলালের মালিকানাধীন রাম অটোমেটিক রাইস মিলে একটি অটোমেটিক রাইস মিলের চালকলের বয়লার বিস্ফোরণে দুই শ্রমিক নিহত হন। সেদিন আহত হন আরো অন্তত সাত শ্রমিক। কোনো তদন্ত কমিটি হয়নি, নিহত কোনো পরিবারও প্রশাসনের পক্ষ থেকে পায়নি আর্থিক কোনো সহায়তা।
আরেকদিনের ঘটনা, সেদিনও ছিল শনিবার, ২৩ জানুয়ারি ২০১৬। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের পুবাইলের কলেজ গেট এলাকায় স্মার্ট মেটাল অ্যান্ড কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কারখানার বয়লারে হঠাৎ ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে সৃষ্ট আগুনে দগ্ধ হয়ে পথচারী এক স্কুলশিক্ষিকাসহ ছয়জন নিহত এবং দুজন দগ্ধ হন। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যদ্দুর জানা যায়, দাফনের জন্য নিহত প্রত্যেক পরিবারকে ১০ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছিল।
গতকালও ছিল শনিবার। টঙ্গীর শিল্প নগরী এলাকার ট্যাম্পাকো ফয়েলস কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন ২৭ জন। আহত অর্ধশতেরও বেশি। নিহতের সংখ্যা আর না বাড়ুক সেটাই চাওয়া। এরই মধ্যে গঠিত হয়েছে দুটি তদন্ত কমিটি। ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
মূল ঘটনায় যাওয়ার আগে ইতিহাস পড়ানোর জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। তিনটি শনিবার একসঙ্গে করার কারণ, দেশে গত দুই বছরে (টঙ্গীর আগে) বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে একটিই, নওগাঁয়। লাইনটি আপনার বিশ্বাস হোক আর না হোক। এ তথ্য বয়লার পরিদর্শন কার্যালয়ের।
আরো একটু পেছনে যাই, ভারত উপমহাদেশে বয়লার আইনের শুরু ১৯২৩ সালে। পরের বছর কলকাতায় স্থাপিত হয় বয়লার অধিদপ্তর। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বয়লার অধিদপ্তর স্থানান্তরিত হয় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, আজকের বাংলাদেশে। এরপর ১৯৬১ সালে বয়লার অধিদপ্তর শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ শুরু করে। এখন দেশে বয়লার অধিদপ্তর শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।
দেশে নিবন্ধিত বয়লারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার। যদিও বাস্তবে বয়লারের সংখ্যা প্রায় তার দ্বিগুণ। প্রধান বয়লার পরিদর্শক আবদুল মান্নানের তথ্যমতে, ১০ জনের পদ থাকলেও মাত্র পাঁচজন বয়লার পরিদর্শক আছেন বর্তমানে। জনবলের অভাবে ঠিকমতো পরিদর্শন করা হয় না। একদিনে ৯-১০টি বয়লার পরিদর্শন করতে হয়। জনবল বাড়াতে অর্গানোগ্রাম সংশোধন করে ৩০০টি পরিদর্শকের পদ সৃষ্টির একটি প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে। তিনি জানান, আরো চারজন পরিদর্শক এ বছর নিয়োগ দেওয়া হবে। তাঁদের মধ্যে একজনের নিয়োগ চূড়ান্ত হয়েছে। তিনজনের লিখিত পরীক্ষা হয়েছে।
এসব তথ্য উপাত্ত টেনে আনার কারণ, খুঁজলেই হরহামেশা চোখে পড়বে বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনার খবর। অথচ ১৯২৩ সালের আইনে চলা অধিদপ্তর পাঁচজন লোক নিয়ে বসে আছে তা তদারকে। জানুয়ারি মাসে গাজীপুরে যেখানে ছয়জন মানুষ মারা গেছে একটি বয়লার বিস্ফোরণে, সেটি নিবন্ধিত নয়, এমন কী কারণে সেটি চোখে পড়েনি তাদের?
ছোট-বড় মিলিয়ে দেশে রাইস মিলের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। যদিও বাংলাদেশ হাস্কিং মিল অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হিসেবে আছেন ১৭ হাজার রাইস মিল মালিক। যেখানে বয়লার ব্যবহার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। দুর্ঘটনাও ঘটে প্রতিনিয়িত। খাদ্য নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে রাইস মিলগুলোর বয়লার নাকি পরিদর্শনের আওতায় আনা হচ্ছে না। বাংলাদেশে সত্তরের দশকের দুর্ভিক্ষের পরে কেউ না খেয়ে মারা গেছে এমন কোনো তথ্য জানা নেই। পরিদর্শনে গেলে এক বেলাই না হয় কাজ বন্ধ থাকবে একটি রাইস মিলের। সেখানে বছরের পর বছর বিস্ফোরণে যে শ্রমিকগুলো মারা যাচ্ছেন, তাঁদের পরিবারের তো জীবন-জীবিকারই নিরাপত্তা থাকছে না, খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ভাববে কে!
‘আমার হাতে ব্যাগ ছিল। টঙ্গী রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে উঠব। ট্রেনের আগাম টিকেটও কাটা ছিল। জানালার পাশেই দুজনের পাশাপাশি আসন। বাসা থেকে বেরিয়ে রিকশা না পেয়ে হাঁটা শুরু করি। কিছুক্ষণ হাঁটার পর ও পেছনে পড়ে যায়। আনুমানিক চার ফুট পেছনে। ও ট্যাম্পাকো ফয়েলস লিমিটেডের ভবন পার হচ্ছিল। এমন সময় বিকট শব্দ শুনতে পাই। পেছন ফিরে দেখি ভবনধসে আমার স্ত্রীর ওপর পড়েছে। ইট ছিটকে আমার গায়েও লেগেছে।’ ৩০ জুলাই বিয়ে হয়েছিল ওঁদের। শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার জন্য রওনা দেওয়া গার্মেন্টস শ্রমিক আসমা নিহত হন গতকাল। তাঁর স্বামী সুমনকে কী দিয়ে ক্ষতিপূরণ দেবেন আমাদের প্রশাসন কিংবা প্রতিষ্ঠানের মালিক? বেতন পেয়ে দাদির জন্য ঈদে জুতা কেনার অপেক্ষায় থাকা আশিকের দাকি কি আর কখনো নুতন জুতা পরবেন? কিংবা ধ্বংসস্তূপের নিচে বাবা রফিকুল ইসলামকে খুঁজতে আসা ১২ বছরের সাকিব কি জানবে দেশে অবৈধভাবে বয়লার চালানোর জন্য শুধু কয়টা টাকা খরচ করলেই হয়!
এসব দুঃসহ গল্প গণমাধ্যমের কল্যাণে চোখে পড়েছে এরই মধ্যে। কিন্তু বছরের পর বছর নিবন্ধিত নয় বলে হাজারো অবৈধ বয়লারের অস্তিত্ব ঘুষের টাকার স্রোতে ভুলে যাওয়া কর্মকর্তাদের গল্প কি সবার আসবে সামনে?
আজই বেতন হওয়ার কথা ছিল ওই কারখানার। কত স্বপ্ন বোনা ছিল নিহত-আহত মানুষগুলোর। হয়তো আশা ছিল একসঙ্গে কোরবানি দেবেন পরিবারের সবাই মিলে। নিজেরাই কোরবানি হলেন মালিকের ঈদের আগে শিপমেন্ট শেষ করার গতির নিচে।
আফসোস, ঈদটা যদি শনিবারেই হতো। আসমা চলে যেতেন শ্বশুরবাড়িতে, আশিক কিনে ফেলতেন দাদির জন্য চকচকে একজোড়া জুতা। আর সাকিব বাবার হাত ধরে হয়তো বেড়াতে যেত কোনো মেলায়।
লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর