জঙ্গি দমন
গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই

গুলশানের 'অপারেশন থান্ডারবোল্ট', কল্যাণপুরের 'অপারেশন স্টর্ম-২৬' এবং গত ২৭ আগস্টের ‘অপারেশন হিট স্ট্রং-২৭' থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, নিরীহ ব্যাচেলর ছাত্র কিংবা চাকরিজীবীদের বাসা ভাড়া পেতে সমস্যা থাকলেও জঙ্গিদের বাসা ভাড়া পেতে কোনোই অসুবিধা হয় না। ১৯৭১ সাল থেকে অদ্যাবধি সব দুর্ঘটনার একটাই শিক্ষণীয় বিষয় ছিল, গোয়েন্দা দুর্বলতা। নারায়ণগঞ্জের এ ঘটনায় বাড়ির মালিকের ভাষ্য অনুযায়ী গত রমজান মাস থেকেই জঙ্গিরা এই বাড়িতে থাকত। বাড়ির মালিক নুরুদ্দিন দেওয়ান পুলিশকে জানিয়েছেন, ওষুধ ব্যবসায়ী পরিচয়ে রোজার শেষে তাঁর বাড়ির তৃতীয় তলার দুটি ইউনিট ভাড়া নেন কয়েকজন ব্যক্তি। পুলিশের ধারণা, এই বাসা থেকে মূলত জঙ্গিরা আদমজী ইপিজেডে কর্মরত বিদেশিদের টার্গেট করেছিল। তার মানে আরো বড় ধরনের ঘটনা ঘটে যেতে পারত।
গত রমজানে ভাড়াটিয়ারা উঠেছে, এরই মধ্যে জঙ্গি নিয়ে অনেক কিছুই ঘটে গেল, কিন্তু বাড়ির মালিক বুঝতে পারেননি কিংবা তিনি এই তিনজন ব্যাচেলরকে বোঝার চেষ্টা করেননি, তা মেনে নেওয়া যায় না। অধিকন্তু তিনি যদি স্থানীয় পুলিশকে তাদের সম্পর্কে নিয়ম অনুযায়ী জানিয়ে থাকেন, তাহলে পুলিশ কী করেছে, তা-ও আমাদের জানতে ইচ্ছা করে।
সুতরাং প্রতিটি মহল্লায়, প্রতিটি ফ্ল্যাটে কারা বাস করে, তা জানার সব উপায় উদ্ভাবন করা পুলিশ কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার জন্য কঠিন কোনো কাজ নয়। আমাদের ধারণা, বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্যারা-মিলিটারি এবং সশস্ত্র বাহিনী, সবারই নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনী আছে। এমনকি র্যাবেরও নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনী আছে। জাতীয় পর্যায়ে গোয়েন্দা বাহিনী আছে এনএসআই এবং ডিজিএফআইর। এত গোয়েন্দা সংস্থা থাকা সত্ত্বেও অতীতে যত মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে, সব সময়েই কিন্তু গোয়েন্দা ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হয়েছে।
১৯৭৫ সালে জাতির জনককে হত্যার সময় খুনিরা যে ষড়যন্ত্র করেছিল, ইতিহাস থেকে জানা যায়, তারা তা গোয়েন্দা ইউনিটের পাশে বসেই করেছিল। ১৯৮১ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, বিডিআর হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি সব ঘটনাই গোয়েন্দা ব্যর্থতা ছিল। সম্প্রতি গুলশানের এক রেস্তোরাঁয় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের আগেও কেউ জানত না এমন ভয়াবহ কিছু একটা ঘটবে। সুতরাং বারবার এমন গোয়েন্দা ব্যর্থতা এটাই প্রমাণ করে, আমাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো শুধু সাধারণ গোয়েন্দা তৎপরতার জন্যই পরিকল্পিত এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
আপাতদৃষ্টিতে গোয়েন্দা ব্যর্থতার জন্য যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি প্রকট তা হলো গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা। সমন্বয়হীনতার প্রধান কারণ তাদের প্রশিক্ষণের ভিন্নতা। একেক বাহিনীর গোয়েন্দা প্রয়োজন ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অবশ্য এক থাকতে পারে। যেমন হালের দেশব্যাপী জঙ্গি তৎপরতা। প্রতিটি গোয়েন্দা তৎপরতায় চারটি সাধারণ এবং সর্বজনীন চক্র রয়েছে। এগুলো হলো—১. প্রয়োজন, ২. সংগ্রহ, ৩. বিশ্লেষণ ও ৪. বিকীর্ণতা। এগুলো নির্ভর করে গোয়েন্দা প্রয়োজনীয়তার ওপর। গোয়েন্দা প্রয়োজনীয়তা আবার নির্ভর করে হুমকির মাত্রার ওপর। এটা হতে পারে প্রাথমিক ইন্টেলিজেন্স আবশ্যকতা এবং গোয়েন্দা আবশ্যকতা। প্রাথমিক ইন্টেলিজেন্স আবশ্যিক হয় অতিশয় সংকটপূর্ণ মুহূর্তে, আর গোয়েন্দাদের প্রয়োজনীয়তা হলো সাধারণ হুমকি আছে এমন পরিবেশে। এগুলো গোয়েন্দারা ভালো করেই জানেন। শুধু সমন্বয়ের অভাবেই ব্যর্থতাগুলো আসে।
তবে আশার কথা হলো, নারায়ণগঞ্জের ঘটনা থেকে আমাদের গোয়েন্দারা তৎপরতা কিছুটা বাড়িয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এখন দরকার—১. একসঙ্গে প্রশিক্ষণ, ২. কেন্দ্রীয় সমন্বয় সেল গঠন, ৩. প্রতিটি অঞ্চলকে বিভিন্ন সেক্টরে ভাগ করে গোয়েন্দা এলাকা গঠন এবং দায়িত্বপূর্ণ এলাকা বণ্টন করা, ৪. গোয়েন্দা জনবল বৃদ্ধি করা এবং ৫. বর্তমান সরকারের আমলে জঙ্গিবিরোধী যে সংগঠন করা হয়েছে এগুলো কীভাবে কার্যকরভাবে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করবে, তা নির্ধারণ করা।
লেখক : মেজর (অব.) পিএসসি, জি (অব.), আর্মি ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিট্রেশনে কর্মরত।