নদী অধিকার দিবস
অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকার কতদূর?

হাজার হাজার বছর পূর্বে বন্য জীবন ছেড়ে মানুষ যখন স্থানিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়, তখন তারা বেছে নিয়েছিল নদীতীরবর্তী স্থান। প্রাচীন জনপদগুলো তাই নদীতীরবর্তী। দেশে যত পুরোনো গঞ্জ আছে, সেগুলোর অস্তিত্বের সঙ্গে নদীর সম্পর্কই প্রধান। অথচ নদীকে আশ্রয় করে গড়ে ওঠা জনপদে ‘অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকার’ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা দূরবর্তী হয়ে উঠেছে। সভ্যতার মোড়কে, উত্তর-আধুনিকতার চাদরে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতির মধ্যেই আছে অনেক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র।
বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের চেয়ে ভাটিতে। সঙ্গত কারণে বাংলাদেশের উজানে রয়েছে প্রধান প্রধান নদীগুলোর উৎস। আমাদের ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদী রয়েছে। এর মধ্যে ৫৪টি ভারতের সঙ্গে। তার মধ্যে ৫৩টিরই উৎস ভারতে। আপাতদৃষ্টিতে ভারতকে বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র বলে বিবেচনা করা হলেও নদী প্রশ্নে সেই বন্ধুভাবাপন্ন অবস্থার কণা মাত্রও দৃশ্যমান নয়। বরং শুষ্ক মৌসুমে উজানের নদীগুলোর পানি একতরফা প্রত্যাহার করার কারণে বাংলাদেশ পানিশূন্য হলেও ভারতের যেন কোনো মাথাব্যথাই নেই।
বিশ্বব্যাপী অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘে ১০৬টি দেশের সমর্থনে ‘আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ কনভেনশন’-এর খসড়া গৃহীত হয়। ১০৬টি দেশ সমর্থন দিলেও ভারত-চীন-পাকিস্তান এই সমর্থন দেওয়া থেকে বিরত থাকে। তাদের এই বিরত থাকার মধ্যে অবন্ধুসুলভ চিত্রটি আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে। কনভেনশনটিতে বলা হয়েছিল, ৩৫টি দেশের অনুসমর্থনের ৯০দিন পর তা আইনে পরিণত হবে। ৩৪টি দেশ অনুসমর্থন করার পর দীর্ঘদিন ৩৫তম দেশের অনুসমর্থন না থাকার কারণে সেটি আইনে পরিণত হচ্ছিল না। ৩৫তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অনুসমর্থন করলে অনেক আগেই এটি আইনে পরিণত হতো। নদী ও পরিবেশকবিষয়ক সংগঠনগুলো সরকারের কাছে বহুভাবে চেষ্টা করলেও বাংলাদেশ সরকার আজ পর্যন্ত কনভেনশনটিতে অনুসমর্থন করেনি। কেন অনুসমর্থন করছে না তার কারণও অজ্ঞাত।
পৃথিবীতে যতগুলো দেশ রয়েছে, তার মধ্যে এই আইন সবচেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য। কারণ বাংলাদেশই এমন একটি দেশ, যাকে পানির জন্য সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতে হয় উজানের দেশের ওপর। ৩৫তম দেশ হিসেবে ভিয়েতনাম ২০১৪ সালে কনভেনশনটিতে অনুসমর্থন করে এবং ১৭ আগস্ট ২০১৪ সালে তা আইনে পরিণত হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ আগস্টকে নদী অধিকার দিবস হিসেবে ঘোষণা করে রিভারাইন পিপল। ২০১৪ সাল থেকে তা বাস্তবায়িত হয়ে আসছে। এ বছরেও ‘আমাদের নদী আমাদের অধিকার’ স্লোগান নিয়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ অনুসমর্থন না করলেও এখন জাতিসংঘ প্রণীত আইন বিদ্যমান। জাতিসংঘে প্রতিকার চেয়ে বাংলাদেশ সমুদ্র জয় করেছে। আমরা মনে করি ভারত যদি পানি নিয়ে তাদের শোষণনীতি বজায় রাখে, তাহলে জাতিসংঘে এর প্রতিকার চাওয়ার আইনি সুযোগ আমাদের রয়েছে।
পদ্মা নদীতে বাংলাদেশ ভারতের কাছে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। তিস্তার পানি ভারত একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের সমগ্র উত্তর জনপদে জীববৈচিত্র্য অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। তিস্তা সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে লাখ লাখ কৃষক কৃষিতে যে বিশাল সুবিধা পেত, পানি না থাকার কারণে সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে উত্তরের সেচ সুবিধাভোগীরা। বাংলাদেশের উজানে ভারত আরো অনেকগুলো নদীতে বাঁধ দিয়েছে। বাংলাদেশ যদি ভারত থেকে নেমে আসা নদীগুলোতে এখনই আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়, তাহলে নিকট ভবিষ্যতে ভারত সবগুলো নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার করবে।
ভারত ব্রহ্মপুত্র নিয়ে স্ববিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ভারতের উজানে চীন ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ পরিবর্তন করবে বলে শোনা যাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের পানিরপ্রবাহ ঠিক না থাকলে শুধু বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, ভারতও অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সে জন্য ভারত বাংলাদেশকেও আহ্বান জানিয়েছে ব্রহ্মপুত্রের পানিপ্রবাহ ঠিক রাখার দাবিতে একসঙ্গে কাজ করার জন্য। ভারত যে ঘটনায় বাধা দিতে চায়, চীনকে তারা এই কাজটি করে চলেছে বাংলাদেশের সঙ্গে।
শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকার কারণে তিস্তায় অনেক অসুবিধা দেখা দিচ্ছে। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় প্রায় পাঁচ হাজার কিউসেক পানি থাকার কথা। কিন্তু ভারতের আগ্রাসী ভূমিকার কারণে গত ২০১৫ সালে ১০০ কিউসেক পানিও আসেনি। ২০১৬ সালেও প্রায় তদ্রূপ। পানি না থাকার কারণে হাজার হাজার জেলে এবং মাঝি পরিবার বেকার হয়ে পড়েছে। নদীতে পানি না থাকার কারণে সেখানে মাছ থাকছে না। তিস্তায় পানি না থাকলে তিস্তাসংলগ্ন অনেকগুলো নদীই শুকিয়ে যায়। পানির স্বাভাবিক স্তর নেমে যায় অনেক নিচে। বোরো মৌসুমে মাটির নিচ থেকে পানি উত্তোলন করে চাষাবাদের কারণে সেই স্তর আরো নিচে নেমে যাচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, অবস্থার পরিবর্তন করা না গেলে উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হবে। তার কিছু কিছু লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করেছে। যেমন গ্রীষ্ম মৌসুমে রাতের বেলা অনেক স্থানে ঘন কুয়াশা দেখা দেয়। রংপুর-দিনাজপুরে এই দৃশ্য ইদানীং দেখা দিতে শুরু করেছে।
বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতের কাছে বাংলাদেশের অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি তুলে ধরা জরুরি। ভারত যদি বাংলাদেশের জলহীন ভয়াবহতার কথায় গুরুত্ব না দিয়ে পানি নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকায় অটল থাকে, তাহলে বাংলাদেশ এর আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। আমরা বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন জানাই যেন দ্রুত আন্তর্জাতিক পানিপ্রবাহ কনভেনশনে অনুসমর্থন জানানো হয়। দুর্বলের শেষ ভরসা হচ্ছে আইন। বাংলাদেশকে শেষ পর্যন্ত হয়তো সেই আইনেরই আশ্রয় নিতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর