অভিমত
সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ রুখতে পারে অশুভ শক্তি

সাম্প্রতিক সময়ে পরপর ঘটে যাওয়া কয়েকটি জঙ্গিতৎপরতায় উদ্বিগ্ন দেশের সাধারণ মানুষ। প্রায় সবার মধ্যেই একটা বিশ্বাসহীনতা, অনিশ্চয়তা আর ভীতি বিরাজ করছে যেন। বহুদিন ধরে চেনা-জানা মানুষ, কাছের মানুষদের ভেতরে ভেতরে একটা অবিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ছে। কে যে মনের ভেতর কী উদ্দেশ্য লুকিয়ে রেখে চলাফেরা করছে তা বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। তরুণ সমাজ রয়েছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে।
কতিপয় বিপথগামী তরুণদের দেশবিরোধী জঙ্গি তৎপরতার নেতিবাচক প্রভাব এসে পড়ছে সাধারণ তরুণদের ওপর। নানাভাবে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন সাধারণরা। বিশেষ করে ভাড়া বাসায় থাকা ব্যাচেলর তরুণরা রয়েছেন বড় অস্বস্তিতে। এক দিকে বাড়িওয়ালারা যেমন বাসা ভাড়া দিতে চাচ্ছেন না, মেস বাসা ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দিচ্ছেন কেউ কেউ, অন্যদিকে প্রায় প্রতি রাতেই নগরের বিভিন্ন এলাকায় পরিচালিত পুলিশি অভিযানও তাদের বড় দুশ্চিন্তার কারণ। সব মিলিয়ে অস্থির একটা সময় পার করছে তরুণ প্রজন্ম।
বিভিন্ন মহল থেকে কথা উঠছে, তরুণরা বিশেষ করে স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, যাদের মেতে থাকার বয়স এখন নতুন জীবনের জয়গানে। উল্লাসে-উচ্ছ্বাসে মাতিয়ে দাপিয়ে বেড়ানোর কথা দেশের এ মাথা থেকে ও মাথা, নানা রকম সৃষ্টিশীল কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখে পতনোন্মুখ সমাজের হাল ধরার স্বপ্ন লেগে থাকার কথা যাদের চোখেমুখে, তাদেরই কতিপয় কেন পা বাড়াচ্ছে বিপথে? কেন আলোর পথ ছেড়ে অতল অন্ধকারের যাত্রী করছে নিজেকে? নিজের পরিবার, সমাজ ও দেশের চিন্তা না করে কেন তারা ভুল মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে সমাজের বন্ধন ছেড়ে? এসব এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
যে সময় তাদের চোখজুড়ে স্বপ্ন থাকবে নিজের দেশীয় সংস্কৃতিকে বিশ্বের বুকে আলোকিত করার, দেশীয় কৃষ্টিকালচারে ভর করে স্বমহিমায় বাঙালি জাতিসত্তার প্রাণ পতাকা তুলে ধরার কথা বিশ্বদরবারে, দীপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করার কথা- এই দেশ আমার। এই আমার ভাষা। বহু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের এই মাতৃভাষা। ৩০ লাখ প্রাণের বিসর্জনে এই ভূখণ্ডের বুকে লাল-সবুজের পতাকা উড়েছে, তারা কেন আজ অন্ধকারের অনুসারী? জঙ্গিবাদের সঙ্গে এই দেশের কোনো সম্পর্ক কোনোকালেই ছিল না। এই অঞ্চলের, এই মাটির ইতিহাসে এমন লাঞ্ছনার চিত্র আগে দৃশ্যমান হয়নি কোনোদিন। দোষটা আসলে কোথায়? কিসের ঘাটতি নতুন প্রজন্মের কতিপয়কে ঠেলে দিচ্ছে এই ভয়ঙ্কর পথে?
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন ব্যক্তিজীবনে প্রচণ্ড হতাশা থেকে এসব পথে পা বাড়াতে পারে তারা। রাজনৈতিক অস্থিরতাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রণোদনার কাজ করে থাকতে পারে। অনেকেই স্রেফ অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়, মৃত্যু মানুষের সম্মুখ লড়াইয়ের এই দুর্ধর্ষ পথে অগ্রসর হতে পারে। তবে সে সব যাই হোক না কেন, আসল ব্যাপার হলো সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ বিকাশের ঘাটতি। যে বয়সে যেসব কর্মকাণ্ডে তাদের যুক্ত থাকার কথা, তারা তা থাকছে না।
দেশীয় কৃষ্টি-কালচারে অভ্যস্ত না হওয়ায় দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি যে মমত্ববোধ ভেতরে থাকার কথা, তার ঘাটতি রয়ে যাচ্ছে। ফলে তারা কোনো টানই অনুভব করছে না দেশের জন্য। দেশের মানুষের জন্য। একটিবারের জন্যও ভাবছে না যাদের বুকে ছুরি চালাচ্ছে তারা সব এই মাটিরই সন্তান। একই আলোবাতাসে বেড়ে ওঠা একই রকম বাবা-মায়ের সন্তান। একই রকম মায়া-মমতা, প্রেম-ভালোবাসা তাদেরও ঘিরে রাখে। সুস্থ সংস্কৃতিচর্চায় যদি তারা নিয়োজিত রাখত নিজেদের, অশুভ শক্তি তাদের নাগালে সহজেই পৌঁছাতে পারত না বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বাঙালি জাতিসত্তার রয়েছে সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এই অঞ্চলের মানুষ জাতিগতভাবেই অতিথিপরায়ণ। একে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসার প্রবণতা এই মাটিতে বহু পুরোনো। এসব জানাতে হবে নতুন প্রজন্মের নাগরিকদের। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতে হবে পর্যাপ্ত সাংস্কৃতিক চর্চার পরিবেশ ও সুযোগ। দেশীয় সংস্কৃতিকে জানানোর ব্যবস্থা করে দিতে হবে। অযৌক্তিক অন্ধ অনুকরণের পরিবর্তে যুক্তিভিত্তিক বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।
স্কুল-কলেজের অল্প বয়স্ক শিক্ষার্থীদের দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা দিয়ে থাকতে হবে। নিজেদের কৃষ্টি-সভ্যতায় কী কী স্বীকৃত, কী করা যাবে না, কী করা যাবে সেই সম্পর্কেও সম্মক, ধারণা বাচ্চাদের বিদ্যালয়েই দিয়ে দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণাভিত্তিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের চর্চা বাড়াতে হবে। ছাত্ররা যাতে করে কোনোক্রমেই নিজেদের দেশীয় মূল্যবোধের বাইরে যায় এমন কোনো ক্রিয়াকলাপে আগ্রহী না হয়ে পড়ে। তা ছাড়া তারা যদি অধিকাংশ সময় সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে নিজেদের জড়িত রাখে, অন্যায়-অশুভ খুব সহজেই তাদের কাছে ভিড়তে পারবে না।
এ কথা পরিষ্কার যে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধসম্পন্ন একজন সাধারণ ছাত্রকে কাবু করতে উগ্রবাদীদের যে পরিমাণ কষ্ট করতে হবে, তার চেয়ে সহজেই যারা সংস্কৃতিকে জানে না, জীবনে হতাশা ছাড়া আশার আলো চোখে দেখে না তাদের দলে ভেড়াতে পারবে। মানুষ আসলে মুক্তি চায়। আপনি যদি সৃষ্টিশীল পথে তাদের মুক্তির দিশা দিতে না পারেন, তারা বিকল্প পথ খুঁজবেই। মানব মন স্থির হয়ে বসে থাকার নয়। নতুন নতুন ক্রিয়াকলাপে আগ্রহী তারা হবে- এটাই স্বাভাবিক। এখন সেই নতুন ক্রিয়াকলাপ সৃষ্টিশীল হবে নাকি ধ্বংসাত্মক হবে তা সমাজকেই ঠিক করতে হবে।
পর্যাপ্ত সাংস্কতিক মূল্যবোধের বিকাশের সুযোগ পেলে কোনো মানুষই বিপথে পা বাড়াবে বলে মনে হয় না। ধর্ম সম্পর্কেও সঠিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কোনো অন্ধকারের শক্তি যেন মানুষের ধর্ম বিশ্বাসকে পুঁজি করে তার ভুল বা ইচ্ছেমতো ব্যাখ্যা করে বিপথগামী করতে না পারে, সে দিকেও সমাজ অধিপতিদের সজাগ দৃষ্টি থাকতে হবে।
সুস্থ, সুন্দর, স্বাভাবিক, মননশীল, মানবিক ও সৃষ্টিশীল ক্রিয়াকলাপে তরুণ সমাজকে ব্যস্ত রাখতে পারলে বিপথগামিতার হার অবশ্যই কমবে। সাংস্কৃতিক মূল্যবোধসম্পন্ন যথার্থ শিক্ষাই পারে আগামীর প্রজন্মকে একটি অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনাসম্পন্ন সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার দক্ষ নাগরিক তৈরি করতে।
লেখক : শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ