শিক্ষা
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা চালু প্রসঙ্গে

বর্তমানে দেশে প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে ভর্তির জন্য সংশ্লিষ্ট ভর্তি-ইচ্ছুদের রীতিমতো যুদ্ধে অংশ নিতে হয়। আর এখন তা ভর্তিযুদ্ধ হিসেবে সমধিক পরিচিতি লাভ করেছে। কম খরচে মানসম্পন্ন লেখাপড়া করার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির জন্য যুদ্ধটাই বেশি হয়ে থাকে। তবে শুধু প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাইমারি স্কুলগুলোতে প্রাথমিক পর্যায়ে মানসম্পন্ন লেখাপড়া হয় না বলে মনে করেন অনেকে। সে জন্য প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় পুরোটাই বেসরকারি পর্যায়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত কিন্ডারগার্টেন স্কুলের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। সে জন্য শুধু সরকারি প্রাইমারি স্কুলগুলোতে ভর্তির এতটা প্রতিযোগিতা পরিলক্ষিত হতে দেখা যায় না।
কিন্তু যেসব সরকারি স্কুলের সঙ্গে প্রাইমারি স্কুলের কিছু অংশ, অর্থাৎ তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণি থেকে শুরু, সেসব স্কুলে একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকেই ভর্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সে জন্য এসব কোমলমতি শিক্ষার্থীকে ভর্তিযুদ্ধের ভেতরে না ফেলে এলাকাভিত্তিক কোটার মাধ্যমে এবং কোনো ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া লটারির মাধ্যমে ভর্তি করানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী নিজে গত বছর (২০১৫) থেকে ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন। আর সারা দেশে যখন একইভাবে ও একই পদ্ধতিতে সমন্বিত ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে, তখন বর্তমানে বিরাজিত সমস্যা অনেকাংশেই কমতে শুরু করবে।
তার পরে আসা যাক উচ্চ মাধ্যমিক কিংবা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা প্রসঙ্গে। মাধ্যমিক পাস করার পর উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে, অর্থাৎ কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য আগে শিক্ষার্থীদের তাদের পছন্দমতো কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য সারা দেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঘুরে বেড়াতে হতো। কিন্তু গত বছর, অর্থাৎ ২০১৫ সাল থেকে একাদশে ভর্তির বিষয়টিও সমন্বিতভাবে সারা দেশের জন্য অনলাইন পদ্ধতিতে সম্পন্ন করা হচ্ছে। সেখানে একজন শিক্ষার্থী ইচ্ছামাফিক তার পছন্দমতো ২০টি পর্যন্ত কলেজকে তাদের ভর্তি পছন্দের তালিকায় রাখার সুযোগ পাচ্ছে। গত বছর এ পদ্ধতি প্রথমবার শুরু হওয়ার কারণে সেখানে কিছু ত্রুটি দেখা দিলেও সেবারের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবারে (২০১৬) তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। সে জন্য এবারে একাদশের অনলাইনে ভর্তির প্রক্রিয়াটি বড় ধরনের কোনো অভিযোগ ছাড়াই সারা দেশে সফলভাবে সম্পন্ন হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় অনেক আগে থেকেই অনলাইন পদ্ধতিতে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছে। সেখানে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে বেশ কিছুদিন ধরে সব বিশ্ববিদ্যালয় একত্রে একই দিনে একই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়ার জন্য আলাপ-আলোচনা করা হচ্ছে। কিন্তু সেসব স্থানে কিছু সমস্যা রয়েছে, যার জন্য সেগুলো পুরোপুরি একসঙ্গে সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ সম্ভব হয়ে উঠছে না।
চাকরির ক্ষেত্রে ২৯টি বিসিএস ক্যাডারে কর্মকর্তা নিয়োগ করার জন্য পিএসসির মতো পরীক্ষা গ্রহণকারী সাংবিধানিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থাকার কারণে তা সফলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়। অন্যদিকে ব্যাংকার্স রিক্রুটমেন্ট কমিটিও তাদের চাকরির পরীক্ষা একসঙ্গে নিতে পারে। নিতে পারে দেশের সব মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা, সারা দেশের ক্যাডেট কলেজগুলোর জন্য একটি সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা। কিন্তু সমস্যা হয় দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালগুলোর ভর্তি পরীক্ষা একসঙ্গে নিতে এসে। কারণ, দেশে বর্তমানে ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যা মেডিকেল কলেজ কিংবা ক্যাডেট কলেজের মতো ইউনিফর্ম না। কোনোটি সাধারণ তো কোনোটি আবার বিশেষায়িত কিংবা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর।
অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয় ও ডিসিপ্লিনের সঙ্গে কোনোটির তেমন কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিটি তাদের নিজ নিজ স্বায়ত্তশাসিত আইন দ্বারা পরিচালিত। সে জন্য সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ একমত হয়ে একই প্রশ্নে একই দিনে একটি সমন্বিত পরীক্ষা গ্রহণ করা যেমন বাস্তবসম্মতও নয়, আবার কঠিনও। সে জন্য সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ফোরাম ‘বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ (এইউবি)’ প্রতিবছরই তাদের ভর্তি পরীক্ষাগুলো যথাসম্ভব সবাই একসঙ্গে বসে সমন্বয় করে থাকে, যাতে একই দিনে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হয়। সে জন্য এবারের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আসন্ন ফল প্রকাশের পর ভর্তি-ইচ্ছু শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে ২০১৬ সালের জন্যও একটি সমন্বিত পরীক্ষা শিডিউল গত ১৯ জুলাই ঢাকায় ফোরামটির নির্বাহী স্টিয়ারিং কমিটির এক সভায় নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাক্রমে সকালে ও বিকেলে ২৩, ২৪ ও ৩০ সেপ্টেম্বর এবং ২১ ও ২৮ অক্টোবরে তাদের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয়ে একে একে দেশের সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই অনুষ্ঠিত হতে হতে আগামী ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত তা পালাক্রমে চলতে থাকবে।
সেখানে বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা ২২ অক্টোবর, চুয়েট ৫ নভেম্বর, রুয়েট ২৬ অক্টোবর, কুয়েট ২৮ অক্টোবর, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় ১৮ নভেম্বর, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৯ ডিসেম্বর, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ২৯ অক্টোবর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ৮ নভেম্বর, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ২৫ নভেম্বর, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় ৩ ডিসেম্বর, শাবিপ্রিবি ২৬ নভেম্বর, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ১৮-২১ ডিসেম্বর, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ৪-৭ নভেম্বর, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ১০ ও ১১ ডিসেম্বর, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২ ডিসেম্বর, নোবিপ্রবি ১১ ও ১২ নভেম্বর, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ২৩ ডিসেম্বর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৭-১৯ নভেম্বর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ২৩-২৭ অক্টোবর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ২৩-৩১ অক্টোবর, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ৩-৫ নভেম্বর, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯-২৪ নভেম্বর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ২৪-২৮ নভেম্বর, বরিশাল ১৮-১৯ নভেম্বর, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ১৩-১৭ নভেম্বর, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস ১৪, ১৫, ২১ ও ২২ অক্টোবর, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ২, ৩ ও ৯ ডিসেম্বর ও ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ২৬ ডিসেম্বর এবং ৮-২০ জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে উপায়ান্তর না দেখে হয়তো তার পরও তারিখ নির্ধারণে কিছুটা ওভারলেপিং হয়েছে, যেগুলো আবার অভ্যন্তরীণভাবে বিজ্ঞান, কলা, বাণিজ্য ইত্যাদি বিভিন্নভাগে আলাদা করার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এখানে একটা বিষয় ঠিক যে, এখন সব একসঙ্গে মিলে হয়তো সমন্বয় করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু ভবিষ্যতে যে তা একেবারে কোনোদিনও সম্ভব নয়, এমনটি নয়। এমন সময় আসতে পারে, যখন সবাই মিলে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক কিংবা প্রতিষ্ঠানের প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে ক্লাস্টারে সজ্জিত করে হলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতে পারে। সে হিসেবে দেখতে গেলে যেমন সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একসঙ্গে, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একসঙ্গে, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একসঙ্গে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একসঙ্গে—এভাবে ভাগে ভাগে একসঙ্গে হয়েও পরীক্ষা নেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে।
নতুবা বর্তমানে আটটি বিভাগীয়ভাবে ভাগ করেও আলাদাভাবে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এতে কিছুটা হলেও সমন্বয় সাধিত হওয়ার কারণে এতে শিক্ষার্থীদের অর্থ, হয়রানি ও সময়—সবই কমবে।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।