উৎসব
গভীর বেদনায় হাসিখুশির ঈদ

সুরের জাদুকর ও প্রেমের কবি কাজী নজরুল ইসলাম যখন আপনাকে বিলিয়ে দেওয়ার তাগিদ দেন আমরা জেনে যাই রমজানের ওই রোজার শেষে খুশির ঈদ এসেছে। আর আমাদের গলা ছেড়ে চারপাশে জানিয়ে দেওয়ারও সময় হয়েছে যে-
‘তোরে মারল' ছুঁড়ে জীবন জুড়ে ইট পাথর যারা
সেই পাথর দিয়ে তোলরে গড়ে প্রেমেরই মসজিদ।
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ।
এভাবেই নজরুলের সুর সুধায় ভর করে জীবনের সব শোক ভুলানিয়া মহানন্দের ঈদ প্রতিবছর আনন্দ আর উল্লাসের আহ্লাদ নিয়েই হাজির হয় আমাদের ঘরে ঘরে। কিন্তু এবারের ঈদটা শুধু হাজার বিষাদের বাঁধভাঙ্গা কান্নাটাই যেন নিয়ে এসেছে। আমাদের সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়ে সর্বোচ্চ আদর,সোহাগ আর স্নেহে গড়ে তোলা সন্তানদের কীভাবে যে এতটা ভয়াল অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছি আমরা,তার হিসেব মিলছে না কিছুতেই। আমাদের উত্তরাধিকাররা কোনোকালে এতটা বিকারগ্রস্ত,এতটা নির্মম,নির্দয় আর দূরাচার হয়ে ওঠবে তা কারো কল্পনাতেও ছিল কি? বাবা-মায়ের কোন বেখেয়াল আর অস্বাভাবিক আশকারায় মানুষ সব এমন দুর্মর অমানুষ হয়ে উঠল-অতল শোকের সাগরে ডুবতে ডুবতে তা আমাদের ভাবতে হবে বৈকি! আর সেই ভাবনা ভাবতে ভাবতেই জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা হাজার দুঃখবোধ থেকে বিযুক্ত বা বিচ্ছিন্ন হওয়ার মন্ত্রটাও এবার ভালো করে রপ্ত করে ফেলতে হবে। আর কতবার তীরহারা দুঃখের সাগর পারি দিতে হবে-কে জানে?
সভ্যতা, সৌন্দর্য আর সত্যের অমৃতরসে উথলে গিয়ে জীবনের সত্যিকারের ভালোবাসার কিরণে পৃথিবী পূর্ণ করতে হবে। দুঃখ জাগানিয়ারা যতই জাগিয়ে রাখুক তাকে আজ ঈদের দিন থেকেই সুখের গান শোনাতে হবে। তবেই হয়তো আবার আমাদের শোকস্তব্ধ বাঙালি ভুবনে আনন্দধারা বইয়ে যাবে। আজ ঈদের দিনে স্বার্থনিমগ্ন হয়ে আপন মনে বসে না থেকে কবিগুরুর গীতবিতানে চোখ বুলাতে পারি আরেকবার :
চারি দিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি,
ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি
প্রেম ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে॥
হাজার বেদনাতেও আপনার মনে যদি আনন্দরা ডাক দেয়। তবে সেই ডাকে সাড়া দেবেন নিশ্চয়। অঘটনের ডামাঢোলে পৃথিবী স্তম্ভিত হয়, থমকে দাঁড়ায় তবে নিরাশার পাখির পানে দুই হাত বাড়িয়ে চিরতরে অচল হয়ে পড়ে না। কাজেই আপনার আনন্দ আর উল্লাসেরাই বরং আকাশে ডানা মেলুক। স্বজনের সান্নিধ্যে বা পরার্থে সুখ বিলিয়ে আপনার অবসরের দিন কাটুক হৈহোল্লোড়ে। আবাল্যে বড় হওয়া সেই শখের গ্রামে আত্মীয়র আতিথেয়তা ও রসনা তৃপ্তকর নানা পদ আর বাহারি ব্যঞ্জনায় না হয় দেদার ভোজন বিলাসও হলো।
কিন্তু প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের ওপর থেকে চোখ সরাবেন না প্লিজ। দায়িত্ব সবার আগে আপনার। কোমল ব্রেনের বাচ্চাটি কী খায়, কোথায় যায়, কার সাথে ঘোরে, কী কথা বলে সবটাই খেয়াল রাখা চাই। কোনো কিছুতেই হতাশা বা নৈরাশ্যের বীজ রোপন করতে দেওয়া যাবে না। অনুধাবন করতে হবে, কোনো কারণে সন্তান যেন জীবন সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে বিষণ্ণ না হয়ে পড়ে। অন্ধ আবেগ, সোহাগ, অহংকার আর ওর পেছনে অগণন বেহিসেবি খরচে যেন প্রিয় সন্তানকে উচ্ছন্নে যেতে না দেই। এজন্য সবার আগে দরকার নিজের আদর্শের পতাকাটা সমুন্নত রাখা। পিতা বা মাতার বাজে স্বভাব বা ভুল আদর্শ লালনে পুত্র-কন্যাটি আপনাদের কাছ থেকে বিমুখ হয়ে ভিন্নতর আদর্শের অনুসন্ধানে নেমে পড়তে পারে। ওই যে কথায় বলে না, আপনা ভালো তো জগৎ ভালো।
কাজেই সন্তানের দোষ খোঁজবার আগে দয়া করে নিজেকে শোধরান। সময় এখনো বেহাত হয়ে যায়নি। আমাদের মনে রাখতেই হবে বানের জলের মতো বিপথে আসা অর্থের গরমে যেন আদরের সন্তানকে বেপথো না করে বসি। মনে রাখতে হবেই যে, আমার-আপনার ক্রমাগত ভুলে ভরা জীবনের অভিশাপ বিষবাষ্পে ছেলেমেয়েদের মূল্যবোধ ছাড়খার হয়ে গিয়ে সে বিলীন হতে পারে চরম অন্ধকারে। শেষ পর্যন্ত এর খেসারত মিলতে পারে মানুষের ঘৃণা আর অভিশাপে। আর সেই অভিশাপে পুড়ে যাবে মানুষে মানুষে অভেদ আত্মার বন্ধন। ভালোবাসা নির্বাপিত হতে পারে চিরতরে। তেমন কুৎসিত দিন, অস্পৃশ্য সময় আর ভয়াল অবস্থা কারো কাম্য হতে পারে না। অন্ধকার হাতড়ে সেদিন দেশ জনতার কাছে ক্ষমা চাইবেন ঠিকই- কিন্তু আপনাকে ক্ষমা করবার যে কেউই থাকবে না!
লাটাই ছেড়ে দিয়ে ঘুড়ি উড়ানোর মতো অমনোযোগী আপনার আমার মতো সো কল্ড গার্জিয়ানের মুখে কিউট কিউট বাবুসোনা করে সুন্দর সুন্দর গল্প বড়ই বেমানান। নিজের মহানুভবতার শেকড়টা সন্তানকে চেনান। নজরদারি ছাড়া শুধু বহু ব্যয় করে ইংলিশ মিডিয়ামে স্কলাস্টিকা, নর্থসাউথ বা বিদেশি মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি মাড়ানোটাই শিক্ষার বড়ত্ব নয়। বরং মাতৃছায়ায় পাড়ার খাঁটি বাংলা বিদ্যায়তনটাও হতে পারে প্রকৃত শিক্ষার শ্রেষ্ঠ আঁতুড়ঘর। তিন মাসে সন্তানেরা এমন হন্তারক হয়ে উঠতে পারে না। ব্রেন ওয়াশ গল্পের ভুতুরে ভাঙ্গা রেকর্ড তাই আর বাজাবেন না দয়া করে। স্রেফ নিজেদের বখে যাওয়া জিনটাকেই সবার আগে সংশোধনীতে আনতে হবে। তবেই না সেই জিনের রক্তবাহিকারাও সোনার মানুষ হবে!
একালের সন্তানরা শুধু পিচ টিভিকেই ধর্মের একচ্ছত্র ঠিকাদার মানবে কেন? এবার ঈদে আসমানি তাগিদ মনে করে আপনি নিজেই সন্তানকে মহানবীর অমৃত বাণী শিক্ষা দেন না :
‘যে মুসলিম ব্যক্তি মুসলমান রাষ্ট্রে বসবাসকারী একজন অমুসলিমকে হত্যা করবে সে জান্নাত তো দূরে থাক তার সুগন্ধও পাবে না যদিও জান্নাতের সুগন্ধ ৪০ বছর সমপরিমাণ দূরত্ব থেকে পাওয়া যায়'।(সহীহ্ বুখারী সংখ্যা-৩, হাদিস নং-২৯৯৫)।
অথবা ‘মুসলমান রাষ্ট্রে কোনো মুসলমান দ্বারা কোনো অমুসলিমের অধিকার ক্ষুণ্ণ বা নির্যাতনের শিকার হয় যা সে সহ্য করতে পারে না রোজ কিয়ামতের দিনে আমি স্বয়ং ওই মুসলমান ব্যক্তির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেব’।(সুন্নান আবু দাউদ সংখ্যা নং-৩, হাদিস নং-৩০৫২)।
সন্তানের মধ্যে আদর্শের বীজ রোপণ করি। পারস্পরিক ঘৃণায় গোটা ইসলামী দুনিয়া টুকরো টুকরো হয়ে গেলে কার কী লাভ হবে? ইসলামি স্বল্প জ্ঞান নয় বরং ধর্মতত্ত্বের বিশাল ভাণ্ডার আত্মস্থ করে তাদের মানুষ হওয়ার ছবক দেই। সহস্র শাতাব্দীর আরবের অন্ধ কবি আবুল আলা আল মাআরীর মানবীয় বিভক্তির ভাবরেখাটাও সন্তানকে জানিয়ে দেই-
পৃথিবীর মানুষেরা দুই দলে বিভক্ত :
এক দল যারা ধর্মহীন ঘিলুময়
অন্য দল ঘিলুহীন ধর্মময়।'
এই রকম কোনো বিভক্তির ফাঁদেই যেন সন্তানের পা না পড়ে। নিজের জীবন ও মানুষকে ভালোবাসবার তরিকাটা জানবার সদিচ্ছা হোক সন্তানের আরাধ্য। আর ছেলেমেয়েদের অন্তরে সেই ইচ্ছা জাগ্রত করবার ধূপকাঠি স্বয়ং আপনি। আর কেউ নয়।
আমাদের অগ্রগতি ও উন্নয়নের অংশীদার যারা,সেই বিদেশি বন্ধু ও দেশের প্রতিভাবান সুকন্যা ও সুবর্ণপুত্রদের অকাল প্রয়াণে এবার ঈদে নিশ্চয় আমরা কাঁদব। সেই ট্র্যাজিক হিরোদের জন্য চোখের জল ফেলব। তাদের চির শান্তির জন্য প্রার্থনাও করব।
সেইসাথে ভালোবাসার অটুট বন্ধনে যার যার পরিবারিক সম্পর্ককে এক নতুন সুতোয় গাঁথব। ঘৃণা বা অন্যায়ের ঘুণপোকারা কস্মীনকালেও যাতে সেই সুতো কাটবার পথ না পায়। এবার ঈদে এই হোক পণ-আমাদের বোধকে কড়া প্রহরা দেব। বোধহীনতার ইবলিশেরা যাতে দেয়াল ডিঙ্গিয়ে সেই বোধের ঘরে উঁকি না দিতে পারে কখনো। কাছে দূরে জলে স্থলে ভালোবাসার বাঁশি বাজুক। গভীর বেদনাতেও ঈদ হোক হাসি খুশির। ভালো থাকুক দেশ। জয় হোক মানুষের।
লেখক : সংবাদকর্মী,মাছরাঙা টেলিভিশন