লম্বা ছুটিতে স্বস্তিদায়ক ঈদযাত্রা

এবারের ঈদে একটি বাড়তি পাওনা হলো টানা নয়দিনের ছুটি। কোনো ঈদে একসঙ্গে সরকার কর্তৃক বৈধভাবে একটানা এতদিনের ছুটি দেওয়ার নজির নেই। কারণ এবারের ঈদের ছুটিগুলো এমনভাবে পড়েছিল যে, সপ্তাহের প্রথমে শুক্র-শনি সাপ্তাহিক ছুটি, তারপর মাঝখানে লাইলাতুল কদরের একদিনের ছুটি, পরে তিনদিনের ঈদের ছুটি, তারপরে আবার শুক্র-শনি সাপ্তাহিক ছুটি। সে হিসেবে শুধু ৪ জুলাই একদিন অফিস খোলা ছিল। কারণ যেহেতু অনেকে দুটি ঈদ ছাড়া বছরে আর তেমন কোনো ছুটি ভোগ করার সুযোগ পান না, সে জন্য ঈদে কমপক্ষে একসঙ্গে এক সপ্তাহের ছুটি দিলে, ছুটি থেকে ফিরে আবার সবাই নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে পারেন। তাতে প্রতিষ্ঠানেরই ভালো হবে বলে অনেকে মনে করছেন। তবে এ ছুটি যে সকল পর্যায়ের চাকরিজীবীরাই ভোগ করতে পারছেন এমনটি নয়। যেমন গার্মেন্টস কারখানা, বিভিন্ন এনজিওকর্মী, বিভিন্ন দায়িত্বশীল গণমাধ্যমকর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যবৃন্দসহ আরো অনেক জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ- তাঁদের অনেকেই হয়তো এ নয়দিনের ছুটির আওতায় আসবেন না।
এবারের এ নয়দিন ছুটির কিছু সুবিধা লক্ষ করা যাচ্ছে। ঈদের আগে-পরে দীর্ঘদিনের ছুটি থাকার কারণে ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষের ঢল একবারে পরিলক্ষিত না হয়ে তা বেশ কয়েকদিন যাবৎ চলছে। এতে করে ঈদ এলেই যে চিরচেনা ভিড়ের চাপ কিছুটা কম মনে হচ্ছে। তা ছাড়া লঞ্চ, স্টিমার, ট্রেন, বাস, বিমান ইত্যাদিতে অগ্রিম যাতায়াতের টিকেট পেতে তেমন অসুবিধার কথা শোনা যায়নি, তাই ঈদযাত্রা খানিকটা স্বস্তিদায়ক বলেই মনে হচ্ছে। স্বস্তিদায়ক এ ঈদযাত্রার জন্য সরকারের তরফ থেকে এসব ক্ষেত্রে আগে থেকেই কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে সম্প্রতি ঈদের আগে ঢাকা-চট্টগ্রাম-ঢাকা একটি ননস্টপ দ্রুতগতির ইন্টারসিটি ট্রেন ‘সোনার বাংলা’ সার্ভিস উদ্বোধন করা হয়েছে। যার দ্বারা মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা সময়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে সড়ক যোগাযোগকে আরো প্রাণবন্ত করার জন্য তিনি ঢাক-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহের ফোর লেন সম্বলিত দুটি বড় রাস্তা উদ্বোধন করেছেন।
এতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম চার ঘণ্টায় এবং ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে মাত্র দুই ঘণ্টায় যাতায়াত কার সম্ভব। তা ছাড়া কয়েকশো বিআরটিসি বাস বিভিন্ন জেলায় যাত্রী পরিবহনের কাজ শুরু করেছে। রাজধানীর সঙ্গে বিভিন্ন বিভাগ, জেলা, উপজেলায় সংযোগ স্থাপনকারী অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোর যথাযথ সংস্কারকাজ এরই মধ্যে সেরে নিয়েছেন। ঈদে ঘরে ফেরা যাত্রী হয়রানির অংশ হিসেবে জাল টাকা ছড়ানো, বাড়িঘরে চুরি, রাস্তাঘাটে ছিনতাই, যেখানে সেখানে বখাটেদের দ্বারা খুন-ঘুম- রাহাজানি, রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ ও প্রভাবশালীদের চাঁদাবাজি, যানবাহনে অজ্ঞান ও মলম পার্টির দৌরাত্ম্য, ঢাকার প্রবেশপথ ও বাহির পথসহ রাস্তাঘাটে চলার পথে যানজট ইত্যাদি বন্ধে সরকার, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে কার্যকর ব্যবস্থা লক্ষণীয় ও দৃশ্যমান মনে হচ্ছে। কারণ এরই মধ্যে পুলিশের আইজি, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, র্যাব ডিজি সবাই একটি বিষয় খুব পরিষ্কারভাবেই ঘোষণা দিয়েছেন বারবার যে, এসব অপরাধের ক্ষেত্রে তারা জিরো টলারেন্স প্রদর্শন নীতি অবলম্বন করছেন এবং প্রয়োজনে অপরাধীকে লক্ষ করে গুলির নির্দেশ পর্যন্ত রয়েছে। এরই মধ্যে এসব বাহিনীর গোয়েন্দা দলগুলো মাঠে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আমরা জানি, রাজধানীর বর্তমান লোকসংখ্যা প্রায় দুই কোটি।
রমজানের ঈদে কমপক্ষে এক কোটি লোক ঢাকা ছাড়ছেন তাদের গ্রামের বাড়িতে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে স্বস্তির ঈদ উদযাপন করার জন্য। আর তাই গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ঈদ উদযাপনের জন্য ঢল নেমেছে এবার। রাজধানী শহর ছাড়াও অন্যান্য বিভাগীয়, জেলা ও মফস্বল শহর থেকেও মানুষজন শেকরের টানে গ্রামে থাকা তাদের বাবা-মা, দাদা-দাদি ও স্বজনদের সঙ্গে ঈদের খুশি ভাগাভাগি করতে চলে যাচ্ছেন। যারা শহরে তাদের ফাঁকা বাড়ি রেখে যাচ্ছেন তাদের একটি নিরাপত্তা অস্বস্তি কাজ করে সব সময়। কিন্তু নিজেদের বাড়িঘর যাতে একটু বেশি নিরাপদ রাখা যায় সেদিকে নিজেদেরই নজর দিতে হবে। পাশাপাশি সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর বেষ্টনী তো রয়েছেই। তবে এবারের লম্বা ছুটি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গত ১ জুলাই ২০১৬ তারিখ পবিত্র মাস রমজানে শুক্রবারের রাতে (পরের দিনই পবিত্র কোরআন নাজিলের রাত লাইলাতুল কদর) ইসলাম ধর্ম প্রচারের নামে ঢাকার অভিজাতপাড়া গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে একটি বর্বরোচিত জিম্মি সংকটে দেশি-বিদেশি ২৮টি তাজা প্রাণ নৃশংসভাবে কেড়ে নিয়ে সারা দেশে তো বটেই, সারা বিশ্বকেই স্তম্ভিত করে দিয়েছে একদল ধর্ম ব্যবসায়ী জঙ্গি।
তাই সবাই অপেক্ষার প্রহর গুনছেন কখন রেডিও-টেলিভিশনে বেজে উঠবে কবি নজরুলের সেই বিখ্যাত ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খশির ঈদ.....’ গানটি। তখনই শুরু হয়ে যাবে প্রিয়জনকে মোবাইলে মেসেজ পাঠানো, কোলাকুলি, বাড়িতে বাড়িতে শুরু হয়ে যাবে পিঠা-সেমাই-মাংস-পোলাউ রান্নার কাজ। ঈদের নামাজের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠছে দেশের সর্ববৃহৎ ঈদ জামাতের কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ ও রাজধানীর জাতীয় ঈদগাহ মাঠসহ সারা দেশের সব ঈদগাহ মাঠগুলো। একটাই বাঙালির চিরায়ত ঈদ আনন্দ। কোনো অপশক্তি যেন এ আনন্দে কোনো ধরনের ম্লান ও গ্লানি সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে আমাদের সবারই সচেতনভাবে সজাগ থাকতে হবে। আর দেশ ও বিশ্ববাসীর কল্যাণে মোনাজাতের মাধ্যমে দোয়া করতে হবে।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়