দৃষ্টিপাত
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি

শিশুর গালের মতো লাল রোদের নরম রং নিয়ে নিত্যদিন চারদিকে সকাল হয়, সেই ভোরের রোদ যখন ধানের ওপরে মাথা পেতে শোয়, মাঠের ঘাসের পরে যখন শৈশবের ঘ্রাণ মেলে, তখন প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ ‘অবসরের গান’ শিরোনামে কাব্য করেন। পাড়া-গাঁয়ের এমন উৎসবের আহ্বানে কবি কি সাড়া না নিয়ে পারেন? আর নিজের ঠিকানা ছেড়ে দূরে কোনো এক নিভৃত গ্রামের সবুজ শ্যামলিমায় ফিরে গিয়ে কর্ম-কোলাহলমুখর এই জগৎ সংসারের একগুয়েমি ভুলে কবির সেই অবসরের গান শোনার সাধ কার না জাগে? হাজার বছর ধরে সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগর ঘুরে পৃথিবীর পথে হাঁটতে হাঁটতে মানুষের ক্লান্ত প্রাণ দুই দণ্ড শান্তি খোঁজে কোনো এক নাটোরের বনলতা সেনের কাছে। কিন্তু বনলতা সেনের কাছে পৌঁছানোর ফুরসৎ মেলে কখন কয়জনার? ছুটিটা যে ভীষণ করে চাই, অবসরের দেখা যেন মাঝে মাঝে পাই। কিন্তু কে দেয় ভরসা, কে দেয় ছুটি? তবে কাজপাগল এই মানুষের দেশে এবার ঈদের কথা একদমই আলাদা। এবারের ছুটির ঘণ্টা একটানা নয়দিনের! আহা, কী আনন্দধারা বহিছে ভুবনে!
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাহী আদেশে এবার টানা নয়দিন ছুটি কাটানোর সুযোগ পাচ্ছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দেশের প্রধান নির্বাহী বিচক্ষণ ও দূরদর্শী। তিনি একদিনের ছুটি এদিক-সেদিক করে দিয়েছেন, ফলে এবারের ঈদের ছুটি সরকারি কর্মীরা পাবেন টানা নয়দিন। ৪ জুলাইয়ের কাজের দিনটাকে সরকার ঘোষণা করেছে ছুটির দিন হিসেবে, আর ১৬ জুলাই শনিবারের ছুটির দিনটাকে ঘোষণা করা হয়েছে কর্মদিবস বলে। উন্নত বিশ্বে এমনটা হরহামেশাই করা হয়। জাপানে অবকাশ ছুটি কাটাতে রীতিমতো বাধ্য করা হয়। আমরা এই পথে নতুন, তাই প্রগলভতা একটু বেশি। দেখতে হবে তো আমরাও কিন্তু উন্নত হচ্ছি। আমেরিকার প্রেসিডেন্টদেরকে মাঝে মাঝেই দেখা যায় পরিবার-পরিজন নিয়ে কোনো নির্জন দ্বীপ বা ফার্ম হাউসে অবকাশ কাটাতে। আমাদের এখানে অবশ্য এমন চল এখন গড়ে ওঠেনি। তবে নয়দিনের ছুটি দিয়ে যাত্রাটা শুরু করা গেল।
নয়দিনের লম্বা ছুটি হলো, এবার তবে মন খারাপের মেঘের কোলে রোদ হাসুক। আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি বলে হর্ষ ও উচ্ছ্বাসের আহাহাহাহারা আনন্দের বাণ ডাকুক।
এতদিনকার অভ্যাস ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় বলে পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটি ঠাওরে কবিতার স্নিগ্ধতাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করে কাব্যকলাকে ছুটি দিয়ে রেখেছেন সেই কোন কালে। এবার নয়দিনের ছুটির হৈহল্লায় সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘হে মহাজীবন’-এর অমর পঙক্তিমালাকেই বরং উলটে দিয়ে ক্ষুধার রাজ্যকে বাই বাই বলে দিন না। কবিতার স্নিগ্ধতায় মাতুন, হাসুন, উল্লাস করুন, আনন্দে নেচে উঠুন। আপনি হাসলেই না তবে হাসবে বাংলাদেশ।
আপনাদের মনে থাকার কথা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্পে বিশ্বম্ভরবাবুর ভাগ্নে ফটিককে মামির অনাদরে বাধ্য হয়ে মায়ের কাছে ফেরার আগে স্কুল বা সময়ের কাছ থেকে ছুটি মেলেনি। ফলে চিরস্থায়ী ঠিকানায় ফিরে যাওয়ার জন্য চিরকালীন ছুটি পেয়ে যায় সে। কিন্তু যথাসময়ে সাধের ছুটি মিললে হয়তো মায়ের সন্তান মায়ের কোলে ফিরে যেতে পারত। তাহলে অবশ্য গল্পের ট্র্যাজেডি হতো না। তবু পথ হারিয়ে কোনো বনে যাওয়ার জন্য, কোনো মাঠে ছুটে বেড়ানোর জন্য ছুটি যে খুব দরকার-গুরুদেব এভাবেই আমাদেরকে তা শিখিয়েছেন।
কে না জানে ছোট শিশুদের পাঠশালার বন্দিজীবন ভালো লাগে না। সে চায় অবাধ স্বাধীনতা, খোলামেলা বন্ধনহীন জীবন- সেখানে থাকবে না কোনো বিধিনিষেধ, সেখানে থাকবে শুধু উন্মুক্ততা, থাকবে খোলা আকাশ, বাতাস আর প্রকৃতির ছন্দময় উচ্ছলতা। সে জন্য শিশু তার মাকে রাবীন্দ্রিক ভাষায় যেমনটা বলে :
মাগো আমায় ছুটি দিতে বল
কাল থেকে পড়ছি যে মেলা
এখন আমি তোমার ঘরে বসে
করব শুধু পড়া পড়া খেলা।
তেমনি আপনি বুড়ো খোকারও সারা বছর কাজ করে করে নিজের মানিব্যাগ ও ভুঁড়ির বারোটা বাজানোর পর খানিকটা যবনিকা, বিরতি বা বিশ্রামের দরকার আছে বটে। ডান হাতে, বাম হাতে, টেবিলের ওপরে বা নিচ দিয়ে যে টাকা-কড়ি আসে অবকাশে গিয়ে তাকে এহাত-ওহাত না করতে পারলে কি আয়-রোজগারে বরকত হবে? যদিও এই ছুটিটা সরকারি চাকুরেদের জন্য, তবে মনে রাখতে হবে এই চাকুরেদের লাখো পরিবারও এই ছুটিটার সমান বেনিফিশিয়ারি। অতএব নয়দিনের ছুটি পানেওয়ালাদের কোনো ঈর্ষা নয়, বাদ্য বাজুক, সুরের ঝড় উঠুক, নৃত্যে ছন্দ উঠুক, তা থা থৈ থৈ তা থৈ থৈ।
রাজধানী অথবা কর্মস্থলের নিত্যদিনের যানজট, বাড়িওয়ালার সেই একই ঘ্যানর ঘ্যানর, বিদ্যুতের অপেক্ষায় নিশিকালে দয়িতার সঙ্গে রোমাঞ্চের সময় পার, ওয়াসার বর্জ্যমিশ্রিত জলে স্নান বা পিপাসা নিবারণ, চোর ছ্যাঁছড়, ছিনতাইকারীর কাছে মোবাইল, ট্যাব, অর্থ বর্গা দেওয়ার হাপিত্যেশ, আন্ডার প্রেসারে কায়কারবারের নিয়ত গলদঘর্ম জ্বলুনি—এই নয়দিনে এসবের পুরোটাই মাফ। আহা যদি ঢাকার চোর-ডাকাতদেরও সমান সময় ছুটি দেওয়া যেত তবে টেনশন বা উচ্চ রক্তচাপকেও নবম দিবসের জন্য ছুটিতে পাঠানো যেত।
তবু এই ভালো যে, এই কদিন পত্রিকায় গুজবের ডালপালারা ডানা মেলবে না, ব্রেন ওয়াশড উগ্রবাদী কচি ভাইসোনারা কারো ঘাড়ে চাপাতি মারার জন্য মানুষ খুঁজে পাবে না, পুলিশ ভাইয়াদেরও একই স্ক্রিপ্টের এনকাউন্টার গপ্প বিশ্বাস করানোর পেরেশানি পোহাতে হবে না, পলিটিশিয়ানদের একে অপরকে দোষারোপের জন্য মঞ্চ সাজানো হবে না, বশংবদ টিভি ক্যামেরা বা সাংঘাতিক কলমের বাহাদুরিও দেখা যাবে না।
ছুটির আনন্দে আমরা আজ এমনটা কেন ভাবব না, জগতে দুঃখ নেই, পাপ নেই, রেষারেষি নেই। হিংসা, দ্বেষ, পরনিন্দা, পরশ্রীকাতরতা, লোভ এসবের কিচ্ছুটি নেই। আছে কেবল সত্য, সুন্দর আর আনন্দ। উপনিষদ যেমনটা বলে রেখেছে সেই হাজার বছর আগে, আনন্দই শেষ কথা বলিয়াই জগৎ দুঃখদ্বন্দ্ব সহিতে পারে। দুঃখ তো আছেই তাহার ওপরে আনন্দ আছে বলিয়াই সে আছে। নহিলে কিছুই থাকিত না। অতএব সারা বছরের জমানো দুঃখ-গ্লানির ওপর আনন্দ জয়যাত্রার রথ ছোটাবার এই তো সময়।
সেই যে ‘কবির কৈফিয়ত’ প্রবন্ধে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমনটা বলেছেন, আনন্দরূপ মানুষের মধ্যে একবার ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে তবে আপনার অখণ্ড পরিপূর্ণতা লাভ করিতে পারিবে। যতদিন তা না হয় ততদিন লড়াইয়ের মন্ত্র দিনরাত জপিতে হইবে; ততদিন লাগাম পরিয়া মুখ থুবড়িয়া মরিতে হইবে। ততদিন ইস্কুলে আপিসে আদালতে হাটে বাজারে কেবলই নরমেধযজ্ঞ চলিতে থাকিবে। সেই বলির পশুদের কানে বলিদানের ঢাক-ঢোলই খুব উচ্চৈঃস্বরে বাজাইয়া তাহাদের বুদ্ধিকে ঘুলাইয়া দেওয়া ভালো- বলা ভালো, এই হাড়কাঠই পরম দেবতা, এই খড়গাঘাতই আশীর্বাদ, আর জল্লাদই আমাদের ত্রাণকর্তা।
আমাদের অন্তরের আনন্দরূপ নিরন্তর ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে তবে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠি আমরা। তবেই দেশ ও দশের সমূহ শান্তি। তাই আমরা এবার ছুটির জয় বন্দনাই করব। সুকুমার রায় আমাদের গলায় তবে ধ্বনিত হোক-
এখন থেকে কেবল খেলা কেবল ছুটোছুটি
পাড়ার লোকের ঘুম ছুটিয়ে আয়রে সবাই জুটি।
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন