দাঁত আর নখ দিয়ে টিকে থাকার লড়াইকাল

রাজীব হায়দার থেকে শুরু করে শেষটা এখন পর্যন্ত পাবনার আশ্রমের সাধক। তারপর কে? আমরা এখনো জানি না। তবে ঘটনার পরিক্রমায় নিশ্চিত অনুমান করা যায়, কেউ একজন মৃত্যুর তালিকায় আছেনই।
হত্যার পদ্ধতি একই- চাপাতি, কখনো পিস্তল। হালে কিছুটা পাল্টালেও প্রায় একই পুলিশের ব্রিফিং পদ্ধতিও। আবার একরকমই হত্যাকাণ্ডগুলোর প্রতিবাদের ধরন। শাহবাগে মোমবাতির সঙ্গে স্লোগান। টেলিভিশনে লাইভ। এক ডজন টকশো। তারপর আবারও নৈমিত্তিক কর্মকাণ্ডে সবই ভুলে যাওয়া।
চলমান হত্যাকাণ্ডের প্রথম দিকে নিহত ব্লগারদের বক্তব্যের সঙ্গে হয়তো অনেকেই একমত নন। কিন্তু স্বাধীন মতপ্রকাশের কারণে কারো ওপর চাপাতির আঘাত নেমে আসবে- এটি কিসের আলামত? অন্যদিকে এখন যাঁরা খুন হচ্ছেন, তাঁরা তো কোনো মত প্রকাশই করেননি। নিতান্তই ছাপোষা, কোনোমতে বেঁচে থাকা সমাজের প্রান্তিক মানুষ এঁরা। আর তাঁদের এই হত্যাকাণ্ডগুলো তো কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতার জের ধরে নয়! তাহলে কেন এই হত্যা?
মনে পড়ছে, নিলয় হত্যাকাণ্ডের পর আমরা জানতে পেরেছিলাম, আগেই পুলিশের কাছে গিয়েছিলেন তিনি জিডি করতে, নিরাপত্তা চাইতে। পুলিশ সেই জিডি নেয়নি। নেয়নি শুধু এটুকুই নয়, পরামর্শ দিয়েছে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য। আমি জানি না এই ধরনের পরামর্শের এখতিয়ার পুলিশের আছে কি নেই? আমি জানি না, এই পরামর্শের জন্য সেই পুলিশ কর্মকর্তাকে শেষ পর্যন্ত প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে হয়েছিল কি না? নাকি তদন্ত শেষে খুন হয়ে যাওয়া নিলয়কেই মিথ্যাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে?
গত কয়েক মাসে আমি নিজেও কয়েক দফা হুমকির মুখে পড়েছি। প্রথমে গোলাম আযমের ছেলে সামাজিক মাধ্যমে আমাকে হুমকি দিল। আমি নিজেও থানায় গেলাম জিডি করতে। আমি ভাগ্যবান, আমার জিডিটি পুলিশ গ্রহণ করল। আমার সামনেই একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো জিডির তদন্তের। সেই শুরু আর সেখানেই শেষ। আজ এই লেখা লেখার সময় পর্যন্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমাকে দু-তিন দফা ফোন করেই তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। তদন্ত শেষ হয়েছে কি না জানি না। জানার আগ্রহ বা রুচিও এখন আমার নেই।
কয়েক মাস আগে পেলাম আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের চিঠি এবং হত্যার হুমকি। আমি আবারও শাহবাগ থানায় গিয়েছিলাম, যথারীতি জিডিও করেছিলাম। এবারও একজন কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল- সেই দায়িত্ব প্রদানের মধ্য দিয়েই শেষ হলো শাহবাগ থানার ভূমিকা। বাসায় এসেছিলেন স্থানীয় থানার কর্মকর্তা, বাসার দারোয়ানদের নাম-ঠিকানা লিখেই তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব শেষ করেছেন। যাওয়ার আগে দারোয়ানদের বলে গেছেন, ‘যদি কিছু ঘটে আমরা কিন্তু নাম-ঠিকানা লিখে নিয়ে গেলাম!’
কী হাস্যকর বিষয়; পুলিশ দায়িত্ব নেবে না, সেই দায়িত্ব নিতে হবে বাসার সামান্য বেতনের দারোয়ানদের। যাঁরা পেটের দায়ে সামান্য বেতনের চাকরি করে বেঁচে থাকেন, তাঁদের ওপর দায় চাপিয়ে পাশ কাটানোটা আমাদের পুলিশের পক্ষেই হয়তো সম্ভব। সম্ভব এতকিছুর পরও নিজেদের ‘সফলতায়’ আত্মতুষ্টিতে ভোগা।
আমরা সাধারণ মানুষ নিরাপত্তা খুঁজি পুলিশের কাছে, সেই জন্য রাষ্ট্রকে খাজনা-ট্যাক্সও দিই নিয়মিত। আর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে নিরাপত্তা দেওয়ার বিষয়টি পুলিশের নৈমিত্তিক কাজেরই অংশ। বিপন্ন কাউকে নিরাপত্তা দেওয়া মানে পুলিশের তাঁকে কোনো বিশেষ সুবিধা দেওয়া নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের পুলিশ বাহিনী সেটাই মনে করে।
পরপর দুটি জিডি করে পাওয়া অভিজ্ঞতার পর একসময় আমার নিজেরই মনে হয়েছে আমি নিরাপত্তা চেয়ে কিছু ভুল করেছি। কারণ আমি বা হুমকিপ্রাপ্ত অধিকাংশ মানুষই হয়তো সেই শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করি না- যাদের গুরুত্ব না দিলে পুলিশের সমস্যা হবে। আমরা খবরের কাগজে বা টেলিভিশনে যে পুলিশের সফলতা দেখি, তার সঙ্গে আমার গত দুই মাসের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সাংঘর্ষিক। মেলানো কঠিন।
আমি আশা করি না আমাকে বা বিপন্ন কাউকে প্রহরা দেওয়ার জন্য পুলিশ পেছনে পেছনে ঘুরবে। গানম্যান পাওয়ার আশা করি না। কারণ একজন ছাপোষা সংবাদকর্মীর জন্য এটি কোনো সমাধান নয়। শোভনও নয়। কিন্তু রাষ্ট্রের মনোযোগের সামান্য ভাগ আশা করাটা নিশ্চয়ই বাতুলতা নয়।
একজন সংবাদকর্মী হিসেবে এইটুকু তো জানি, কারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ‘শরীর খারাপের’ কথা বলে নিরাপদে ভাগেন। মনে পড়ে যায়, হেফাজতের তাণ্ডবের রাতে কারা পেছনের দরজা খুঁজেছিলেন। আমরা এটাও জানি, যদি বিমানবন্দরে বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে-পরের যাওয়া-আসার তালিকা খোঁজ করা হয়, তাহলে অনেকেরই মুখোশ খুলে যাবে। পরিষ্কার হয়ে যাবে, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে কারা শেষ পর্যন্ত থাকবেন? আর এরই মধ্যে আখের গুছিয়ে নেওয়া কারা সামান্য ঝড়েই পাততাড়ি গোটাবেন।
বাংলাদেশে এই সময়ে এসে গণমাধ্যমকর্মীর মানে দুই রকমের- একটা হলো উচ্ছিষ্টের সমঝদার হয়ে জীবন কাটানো, অন্যটি নিত্য চলমান লড়াইয়ে মানুষের সঙ্গে থাকা। একদিকে সুবিধাভোগী আর অন্যদিকে লড়াকু মানুষ। রাজনীতিতে এখন অনেকটাই একপেশে। ক্লাবকেন্দ্রিক এলিট আর সদ্যজাত হাইব্রিডদের লাফালাফিতে ত্যাগী নেতাকর্মীরা বিব্রত। ঠিক একই চিত্র আছে সাংবাদিকসহ সমাজের অন্য পেশাতেও।
আর বাস্তবতাটি হলো সুবিধাভোগীদের ভিড়ে লড়াকু মানুষগুলো এখন বেশ কষ্টেই আছেন। ভাই কেন্দ্রিকতা বা আত্মীয়করণ এখন আর শুধু রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। এখন এটি অন্য পেশাতেও এসেছে। আর সে কারণেই যাদের ওপর ‘ভাইয়ের ছায়া’ নেই, তাঁদের জন্য সময়টা বড্ড কঠিন। অনেকটাই দাঁত আর নখ দিয়ে লড়াই করে টিকে থাকার মতো। এ লড়াইটা করছি, করতে হবে তাতে আপত্তি নেই। অন্তর থেকে একটা কথা জানি এবং মানি, নিজের বিশ্বাসের যায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে মৃত্যু অনেকটাই মহত্ত্বর, অন্তত ছুঁড়ে দেওয়া পাউরুটি খেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে।
লেখক : অঞ্জন রায়, গণমাধ্যমকর্মী। ইমেইল : anjanroy.dhaka@gmail.com