আন্তনদী সংযোগ প্রকল্প : 'অব্যবহৃত' ও 'অপচয়িত' পানিতত্ত্ব

ভারতের কেরালা রাজ্য কথিত উদ্বৃত্ত পানির অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। তাই কেরালা থেকে পানি নিয়ে যাওয়া হবে পানি ঘাটতির তামিলনাড়ু রাজ্যে। যেমনটি অরুণাচলের মানস থেকে উদ্বৃত্ত ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে যাওয়া হবে গঙ্গার ঘাটতি বুকে। আর এতে নাকি দুইশ থেকে আড়াইশ বিলিয়ন ঘনমিটার জল 'গণতান্ত্রিক' বণ্টনের জন্য পাওয়া যাবে। ৩৫ মিলিয়ন হেক্টর অতিরিক্ত জমি সেচের আওতায় আসবে। এই বিশাল পরিমাণ জল ওপর-নিচ করে ৩৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ তৈরি হবে। ৪০ হাজার কিলোমিটার নৌপথ তৈরি হবে... ব্লা ব্লা ব্লা।
অথচ এ নিয়ে রাজ্যে রাজ্যে কলঙ্কের শেষ নেই। শেষ নেই রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে কলহের। বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির অবশ্য এ নিয়ে হেলদোল নেই। কর্ণাটকের সঙ্গে তামিলনাড়ুর কলহ কাবেরীর পানি নিয়ে, পাঞ্জাবের কাছে পানি চেয়ে পায় না হরিয়ানা, কৃষ্ণা নদীর পানি নিয়ে তামিলনাড়ুর সঙ্গে অন্ধ্রপ্রদেশের, গঙ্গার পানি বিহারে বইবার আগে উত্তর প্রদেশ 'হজম' করে নেয়। কার পানি কাকে দেবে? উড়িষ্যার জবাব, মহানদীতে পানি নেই। অন্ধ্রের জবাব, গোদাবরীতে বেশি নেই।
আর এ সম্পর্কে রামস্বামী আর আয়ার-এর ক্ষুব্ধ মন্তব্য, ‘রাজনীতিবিদ আর আমলাদের ভারতের ভূগোল পরিবর্তনের অধিকার কে দিয়েছে?’
(২)
অর্থমন্ত্রীর ভাষ্যমতে, যেহেতু বিশাল বিশাল প্রকল্পে বড় বড় দাও মারার সুযোগ থাকে, তাই এগুলোকে জাতীয় গর্ব হিসেবে প্রচার চালানো হয়।
পণ্ডিত নেহরুর কথা মনে পড়ে, 'বিশাল বাঁধগুলো আধুনিক ভারতের মন্দির।'
নর্মদা বাঁধ প্রকল্প এক বিশাল আয়োজন। এই প্রকল্পের কথা চিন্তা করেছিল ব্রিটিশ সরকার, যেমনটি চিন্তা করেছিল গঙ্গায় ও তিস্তা ব্যারাজ, কর্ণফুলী জলবিদ্যুতের প্রকল্পে। যা হোক, নর্মদা নদীতে বাঁধ দেওয়ার পাকা সিদ্ধান্ত হয় আশির দশকে। বাঁধ দিয়ে মধ্য প্রদেশ থেকে পানি নিয়ে যাওয়া হয় গুজরাটে, মহারাষ্ট্রে। এতে ৩০টি বড়, ১৩৫টি মাঝারি ও তিন হাজার ছোট বাঁধ তৈরি হয়। পরিণামে নর্মদা পরিণত হয় ছোট ছোট বিলে, যেভাবে তিস্তা ব্যারাজের ভাটিতে তিস্তা অনেক বিলে ভাগ হয়েছে।
আর এই তত্ত্ব মেনে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, ইয়েমেনসহ সব জায়গায় এ প্রকল্প বাস্তবায়নে হাত লাগিয়েছে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ। আর তাদের এসব অপকর্মকে 'মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ' বলেছেন তাদেরই একসময়ের কর্মকর্তা ডেভিসন বুধু।
(৩)
ফারাক্কা ব্যারাজসহ যাবতীয় ব্যারাজ ও আজকের আন্তনদী সংযোগ প্রকল্পের মূলেই আছে 'অব্যবহৃত' ও 'অপচায়িত' পানিতত্ত্বের অস্ত্র। আমাদের কথিত শিক্ষিত মগজকে এই তত্ত্বের আফিম দিয়েই বশ করা হয়েছে।
প্রচলিত উন্নয়ন ধারণা হচ্ছে, নদীর পানির যে অংশটুকু দিয়ে সেচ, পানীয় জল এবং কারখানার কাজ চালানো হয়, সে অংশটুকুই কাজের আর বাকি যে অংশটি সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে, তা এক নিদারুণ 'অপচয়'।
পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশই গড়ে উঠেছে অব্যবহৃত পলি দিয়ে। বাংলাদেশের মাটির উর্বরতাও এই 'অব্যবহৃত' পলির ফল। বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে, তখন ব-দ্বীপের নদ-নদীগুলোর 'অব্যবহৃত' পলিই উচ্চতা বাড়িয়ে বাংলাদেশকে রক্ষা করছে তলিয়ে যাওয়ার হাত থেকে। এই 'অব্যবহৃত' পানির দানেই গড়ে উঠেছিল পৃথিবীর প্রাচীনতম সবকটি সভ্যতা—সিন্ধু, মিসরীয়, মেসোপটেমিয়া, হোয়াংহো।
'অপচয়িত' পানি আমাদের ৮০ ভাগ মাছের জোগানদাতা। পদ্মায় বাহিত যে বিপুল পরিমাণ পানি বঙ্গোপসাগরে পড়ে 'অপচয়' হয়, তা রোধ করতে ফারাক্কা দিয়ে পানির প্রবাহকে সরানো হলো হুগলিতে, কলকাতায়। ফল দাঁড়াল, 'অব্যবহৃত' ও 'অপচায়িত' পানি না থাকায় তীব্র লবণাক্ততা গ্রাস করল দক্ষিণাঞ্চলকে, কোটি কোটি মানুষ আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত হওয়াসহ জীবন-জীবিকা হুমকিতে পড়ল, হৃৎপিণ্ড সুন্দরবন ধ্বংসের মুখে।
আর জোর করে কাঁঠাল পাকানোর ফলে পলি জমি কলকাতায়ও নাব্যতা নেই।
আজকের নদী সংযোগ প্রকল্প এই পানি তত্ত্বেরই ফল, যা আমলা-রাজনীতিবিদ-ইঞ্জিনিয়ারদের আঁতাত, দেশি-বিদেশি কোম্পানির লুটপাট এবং জনগণের মঙ্গলের কথা বলে দেশের ভূগোল ও পরিবেশের বারোটা বাজানো।
লেখক : প্রধান সমন্বয়ক, রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি।