দৃষ্টিপাত
সংবাদশিল্পের শ্রমিকদের কথা কে বলবে?

বরাবরের মতো এবারো ঘটা করে পালিত হলো মহান মে দিবস। বিশ্বের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সাফল্যে ভাস্বর এই দিনটি মানব ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ আমাদের সংবাদকর্মীদের জন্যও। দিনটিকে উপলক্ষ করে অনেক সংবাদকর্মী আগে প্রকাশিত পুরাতন প্রতিবেদন দেখে নিজেকে একটু ঝালিয়ে নেন, তার পর নেমে পড়েন নতুন সংবাদের খোঁজে। অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতার সমন্বয়ে ওই ঝানু সংবাদকর্মী ঠিকই সংবাদের চমৎকার একটি সাবজেক্ট খুঁজে বের করে ফেলেন। তাঁর নির্বাচিত খবরে থাকে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করা সাধারণ শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে বঞ্চনার কথা, শারীরিক নির্যাতনের কথাসহ আরো কত ধরনের হয়রানি ও অধিকার হরণের কথা। ঝানু সংবাদকর্মীর যথোপযুক্ত শব্দ ও বাক্যের চমৎকার বুনন এবং ক্যামেরার কারিশমায় সংবাদটি হয়ে ওঠে জলজ্যান্ত, যা দেখে ও পড়ে নাড়া খায় পাঠক ও দর্শকের নরম হৃদয়। মিডিয়ার বসরা পিঠ চাপড়ে দেন ঝানু সংবাদকর্মীর, তার পর টক শো ও বিভিন্ন আলোচনায় গিয়ে তিনি এ নিয়ে বলেন হৃদয়বিদারক কথা। তা শুনে সাধারণ পাঠক ও দর্শক বলবেন, মিডিয়ার বস লোকটি নির্ঘাৎ মানবতার অবতার।
এ পর্যন্ত সব ঠিক আছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন, কর্মক্ষেত্রে বঞ্চনা শুধু কি নির্মাণ, গার্মেন্ট, চাতাল, ইটভাটা, পরিবহনসহ কয়েকটি সেক্টরে শ্রমিকদের মাঝেই সীমাবদ্ধ। প্রতিবারই ঘুরেফিরে তো এই কয়েকটি সেক্টরের কথাই আসে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এ নিয়ে সোচ্চার থাকে। আমার প্রশ্ন হলো, ওই ঝানু সংবাদকর্মী ও জাতির বিবেক মিডিয়ার বস কি বাতির নিচে অন্ধকার দেখেন না কিংবা নিজেদের চেহারা আয়নায় দেখেন না? বিষয়টি খোলাসা করে বলি। কোনো বিষয়ে অন্যকে বলার আগে তা নিজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা উচিত। মিডিয়া জগতেও এ বিষয়টি খুবই প্রযোজ্য।
প্রথমেই বলি সংবাদকর্মীদের পারিশ্রমিক নিয়ে। বর্তমানে রমরমা মিডিয়ার জগতে সংবাদকর্মীরা কত পারিশ্রমিক পান কিংবা আদৌ পান কি না? সৌভাগ্যবান মুষ্টিমেয় যে কয়েকজন ওয়েজ বোর্ড নামক সুধা পান করেন, তাঁদের বাইরের বিশাল সংখ্যার সংবাদকর্মীর অবস্থা কী? তাঁদের মাঝেও সৌভাগ্যবান যেসব সংবাদকর্মী পারিশ্রমিক পান, তা কি আইএলও কিংবা সরকারি কোনো মানদণ্ডে সামঞ্জস্যপূর্ণ? তা দিয়ে কি সংসারের ব্যয় নির্বাহ হয়? আবার কাগজে-কলমে বেতন থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে মাস ছাড়িয়ে বছরের পর বছর বকেয়া থাকা পারিশ্রমিকের জন্য মাথা কুটে মরেন অনেক সংবাদকর্মী। অনেক ক্ষেত্রে একজন সংবাদকর্মী জানেনও না যে আসলে তাঁর পারিশ্রমিক কত? তাঁকে জানতেও দেওয়া হয় না। আরো দুঃখজনক হলো, এঁদের বাইরে বিশাল সংখ্যার সংবাদকর্মীর কোনো পারিশ্রমিকই নেই। অথচ তাঁরা পূর্ণকালীন কাজ করে যাচ্ছেন।
তার পর আসে নিয়োগপত্রের প্রসঙ্গ। বড় বড় কয়েকটি মিডিয়ার কথা বাদ দিলে দিনের পর দিন কাজ করেও কোনো নিয়োগপত্র পাননি এমন সংবাদকর্মীর সংখ্যা অগণিত। অনেক ক্ষেত্রে শুধু একটি আইডি কার্ড দিয়ে ধন্য করে মিডিয়া কর্তৃপক্ষ। এমনও দেখা যায়, লাখ টাকা জামানত দিয়ে একজন সংবাদকর্মীকে নিয়োগ দেওয়া হলেও বিনিময়ে ন্যায্য পারিশ্রমিক ও নিয়োগপত্র থেকে বঞ্চিত করছে মিডিয়া কর্তৃপক্ষ। পূর্ণ সময়ের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে রোদ-বৃষ্টি-বন্যা মোকাবিলা করে সময় ও অর্থ ব্যয় করে সঠিক সময়ে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেও সংবাদকর্মীদের ভাগ্যে কিছুই জুটছে না। জাতির বিবেকের আধার মিডিয়া কর্তৃপক্ষ কি নিজেদের বেলায় অন্ধ?
পারিশ্রমিক ও নিয়োগপত্র দিতে অপারগ হলে শুধু নিজের মুনাফার জন্য মিডিয়া চালানোর দরকার কী? মুনাফার জন্য আরো অনেক ব্যবসা আছে, সংবাদকর্মীদের ঠকাতে হবে কেন? মিডিয়া ব্যবসার মাধ্যমে এর কর্ণধাররা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে বাস করেন, ঝা চকচকে দামি গাড়ি হাঁকিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করলেও সংবাদকর্মীদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিতে এত কার্পণ্য কেন? এর দ্বারা মিডিয়া কর্তৃপক্ষ কি সংবাদকর্মীদের অসৎ পথে পা বাড়াতে উৎসাহী করছে না? উপযুক্ত পারিশ্রমিক ও নিয়োগপত্র পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকার কেবলই কি কথার কথা? দেশের শ্রম আইন, আইএলও কিংবা ওয়েজ বোর্ড কোনো কিছুই কি মিডিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়?
সরকার কেন সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসছে না, তা-ও বোধগম্য নয়। নিয়োগপত্র ও পারিশ্রমিক সমস্যা ছাড়াও সংবাদকর্মীদের জন্য নেই অবসর-ভাতার ব্যবস্থা। সাংবাদিকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা নিয়ে নেই কোনো নীতিমালা। শিক্ষাগত ও পেশাগত যোগ্যতা থাক আর না থাক, শিক্ষিত হোক আর অর্ধশিক্ষিত, নিয়োগের বেলায় কোনো বাছবিচার নেই। অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যতার ভারসাম্যহীনতার কারণে এক সংবাদকর্মী আরেক সংবাদকর্মীকে দেখে লজ্জায় মুখ লুকাতে বাধ্য হন। সমাজে লোকমুখে তাই মিডিয়াজগৎ নিয়ে চলে নানা টিপ্পনী।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, অন্যান্য পেশাজীবীর মতো সংবাদকর্মীদের নেই কোনো কেন্দ্রীয় সংগঠন (যেমন—বার কাউন্সিল, বিএমডিসি)। এ সুযোগে গড়ে উঠছে ব্যাঙের ছাতার মতো ভুঁইফোড় শত শত সংগঠন। প্রতি জেলায় আছে একাধিক প্রেসক্লাব। কিন্তু প্রেসক্লাবসহ এসব সংগঠনে সদস্য হওয়ার নেই কোনো সঠিক নিয়মকানুন। সাংবাদিক হোক আর না হোক, যাকে যখন ইচ্ছা তাঁকে সদস্য করা হচ্ছে। প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এসব সংগঠনে সাংবাদিককের চেয়ে নামধারী ভুয়া সাংবাদিক ও অসাংবাদিক কয়েকগুণ বেশি থাকে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, জেলা প্রশাসকও প্রেসক্লাবের সভাপতির দায়িত্বে আছেন অনেক জায়গায়। এসব প্রেসক্লাব ও সংগঠন সংবাদকর্মীদের পেশাগত দায়িত্ব ও আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করতে কোনো কাজ না করে সর্বনাশটাই বেশি করে, এটা বললে অত্যুক্তি হবে না।
সংবাদকর্মীদের সমস্যা দেখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থাগুলোই বা কেন কার্যকর ভূমিকা রাখছে না কিংবা বেসরকারি সংস্থাগুলোও কেন এ ব্যাপরে চোখ বুজে আছে, তা বোঝা মুশকিল। শ্রমের উপযুক্ত প্রতিদান পাওয়া একজন সংবাদকর্মীর অধিকার, এটা কারো করুণার বিষয় হতে পারে না। মাঠ-ঘাট চষে দুনিয়ার সমস্যার কথা যাঁরা তুলে আনেন, জানিয়ে দেন সাধারণ মানুষকে—সেই সংবাদশিল্পের শ্রমিকদের সমস্যার কথা কে বলবে?
লেখক : কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি, এনটিভি