রানা প্লাজা
কান্না থামেনি, বিচারে দীর্ঘসূত্রতা

গাহি তাহাদের গান-
ধরণীর হাতে দিল যারা আনি' ফসলের ফরমান।
শ্রম-কিণাঙ্ক-কঠিন যাদের নির্দয় মুঠি-তলে
ত্রস্তা ধরণী নজরানা দেয় ডালি ভ'রে ফুলে-ফলে!
ঠিক সেই অর্থে এ দেশের পোশাক শ্রমিকদের গান গাওয়া যায় কি? কেন নয়! যাদের হাতে বদলে যেতে শুরু করেছিল আমাদের দেশের অর্থনীতি! অবাক হওয়ার কারণ নেই, লাখ লাখ পোশাক শ্রমিকের ঘামের ওপর একটা সময় এ দেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে ছিল। আজকের দিনে চিত্র কিছুটা বদলালেও এমন বৈপ্লবিক কোনো পরিবর্তন আসেনি যে, পোশাক শ্রমিকরা কোন কারণে উপেক্ষিত হতে পারে। আর সেটা হবেও বা কেন? আমাদের দেশে বিভিন্ন দুর্যোগের পরও এই খাত যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তাতে এ দেশের নীতি নির্ধারকদের চেয়ে খেটে খাওয়া ওই শ্রমিকদের অবদান যে অনেক বেশি তা বলাই বাহুল্য।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে সাভারে একটি বহুতল ভবন ধসে পড়ে এ দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় শিল্প বিপর্যয় ঘটেছিল। রানা প্লাজা ধস নামের এই শিল্প বিপর্যয় যে বিশ্বে ঘটে যাওয়া শীর্ষ তিন শিল্প বিপর্যয়ে একটি! ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। দুর্ঘটনা অবশ্য বলে কয়ে আসে না। তবে ভবনটি যে ধসে পড়তে পারে তার লক্ষণ কিন্তু আগেই পাওয়া গিয়েছিল। আগের দিন ২৩ এপ্রিল ভবনটির ফাটল নিশ্চিত হওয়ার পর ভবন ছেড়ে চলে যেতে বলা সত্ত্বেও, গার্মেন্টস সুপারভাইজাররা ভবনটিকে নিরাপদ ঘোষণা করে শ্রমিকদের পরের দিন কাজে ফিরতে চাপ দেন। ভবনটিতে থাকা গার্মেন্টস কারখানায় প্রায় ৫০০০ কর্মী কাজ করত। বাংলাদেশ শ্রম ইনস্টিটিউট (বাশি)-এর দেওয়া তথ্য মতে, এই ঘটনায় প্রাণ হারায় এক হাজার ১৩৬ জন। আর উদ্ধার হওয়া আহত ২৪৩৮ জনের মধ্যে ৪০০ অধিক শ্রমিক শরীরের কোনো না অঙ্গ হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। কিন্তু আজও অবধি এ ঘটনার কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি তো হয়নি বরং একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতেও গড়িমসি করা হচ্ছে। বিচারের এই দীর্ঘসূত্রতা কোনো প্রহসনের ইঙ্গিত বহন করে কি না জানা নেই।
ঘটনটির জন্য আপনি কাকে দায়ী করবেন? শ্রমিক, মালিক না অন্য কোনো পক্ষকে? ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ জেনে শ্রমিকরা কাজে না যাইতে চাইলে তাদের বাধ্য করা হয় কাজে যোগদানের জন্য। জীবনের মায়া সবারই আছে সুতরাং জীবন ঝুঁকিতে এমন কথা শোনার পরও যদি কেউ যেতে চায় সে সংখ্যাটা নিতান্তই খুব বেশি হওয়ার কথা নয়, অথবা তারা সচেতন নয়। আর মালিকপক্ষ তাদের কাজে যোগদানের জন্য চাপ দেওয়া কিংবা ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও উদাসীনতার পরিচয় দেওয়ার বিষয়টি বিভিন্নভাবে প্রমাণ পাওয়া যায়। এ জন্যই যদি তাদের বিচারের মুখোমুখি না হতে হয়। তাহলে ১১৩৬টি লাশ আর ২৪৩৮ জন আহত শ্রমিকের দায়ভার কার ওপর বর্তাবে? মালিকপক্ষ প্রভাবশালী বলে পার পেয়ে যাচ্ছে কি? আর যাই হোক এ ঘটনার জন্য আপনি কিংবা আমি যে কেউ বলব না যে, কয়েকজন মিলে ধাক্কা-ধাক্কি করার কারণে ভবনটি ধসে পড়েছিল!
ভবনটিতে পোশাক কারখানা, একটি ব্যাংক এবং একাধিক দোকানও ছিল, সকালে ব্যস্ত সময়ে এই ধসের ঘটনাটি ঘটে। ভবনটিতে ফাটল থাকার কারণে ভবন না ব্যবহারের সতর্কবার্তা থাকলেও তা উপেক্ষা করা হয়েছিল। সাভার বাসস্ট্যান্ডের কাছে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশেই নয়তলা এই ভবনটি রানা প্লাজা হিসেবে পরিচিত এবং এর মালিক সোহেল রানা একটি রাজনৈতিক দলের সাভার পৌরসভার যুগ্ম আহ্বায়ক। ২০০৭ সালে রানা প্লাজা নির্মাণ করার আগে জায়গাটি পরিত্যক্ত ডোবা ছিল। ভবন নির্মাণ করার আগে বালু ফেলে এটি ভরাট করা হয়। বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্যমতে ভবনের ওপরের চারতলা অনুমতি ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছিল। এতে ভূগর্ভস্থ তলায় গাড়ি রাখার জায়গা এবং দ্বিতীয় তলার বিপণিকেন্দ্রে বহু দোকান ছিল। তৃতীয় থেকে সপ্তম তলা পর্যন্ত পোশাক কারখানা ছাড়াও এর ওপরের দুটি তলা খালি ছিল। ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় ছিল প্রথম তলায়।
নির্দেশমতো শ্রমিকরা যথাসময়ে কাজে যোগ দিলে ওই দিন সকালের দিকে নয়তলা ভবনটির প্রথম তলা বাদে বাকি সবগুলো তলা ধসে পড়ে। কিছু অংশ পাশের একটি ভবনের ওপর পড়ে। ধসে পড়ার সময় ভবনটিকে প্রায় ৩০০০ কর্মী ছিল। কর্মরত শ্রমিকদের মধ্যে বেশির ভাগ ছিল নারী যাদের সঙ্গে তাদের শিশুসন্তানও সেখানে নার্সারি সুবিধায় ছিল। প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা মতে, সকাল ৯টার দিকে হঠাৎ করে বিকট শব্দ এবং কাঁপনে তারা ভূমিকম্পের আশঙ্কা করেন। পরে বেরিয়ে দেখেন বিরাট এলাকা ধুলাবালিতে ধোঁয়াটে হয়ে পড়েছে। দুর্ঘটনার পর সাধারণ জনগণ, সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধারকাজ চালান। সেদিনের সেই কান্না আজও থামেনি। আজও হতাহতদের পরিবারের আর্তনাদ আর আহাজারিতে সাভারের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।
স্মরণকালের ইতিহাসের অন্যতম এ ট্র্যাজেডির পরদিন অর্থাৎ ২৫ এপ্রিল একদিনের জাতীয় শোক পালন করা হয়। এ ঘটনার পর উত্তেজিত পোশাক শ্রমিকরা দোষীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবিতে ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক আন্দোলন, গাড়ি ও বিভিন্ন ভবনে ভাঙচুর চালায়। ২৫ এপ্রিল ঢাকা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ভবন ও ওই ভবনের গার্মেন্টস মালিকদের অভিযুক্ত করে একটি মামলা দায়ের করেন। এই দুর্ঘটনার কারণ তদন্ত করতে সরকারিভাবে আলাদা কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এদের সাতদিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়। ২৭ এপ্রিল এই ভবনের দুটি গার্মেন্টসের মালিককে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া সাভার পৌরসভার দুজন প্রকৌশলীকেও গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেওয়া হয়। ২৮ এপ্রিল এই ঘটনায় দায়ী ভবন মালিক সোহেল রানাকে বেনাপোল সীমান্ত থেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় র্যাব গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনার পর অনেক কিছু ঘটে গেলেও যে জায়গাটিতে সবচেয়ে বেশি গড়িমসি করা হয় তা হলো পুনর্বাসন প্রক্রিয়া আহত নিহত কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। অনেক দেশি ও বিদেশি সংস্থা এটা নিয়ে কাজ করলেও দুর্নীতি আর বিভিন্ন ছলচাতুরিতে সাহায্য ঠিকমতো পৌঁছায়নি। যারা প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত, তারা বঞ্চিত। সরকারের তরফ থেকে যে সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া গেছে, তা পর্যাপ্ত নয়। অনেক ক্ষেত্রে এটা বণ্টনের কাজও সুষ্ঠুভাবে হয়নি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো তাই আজও অসহায় হয়ে বিভিন্ন দ্বারে দ্বারে ঘোরে। এই ঘটনার পর আমাদের পোশাক খাতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আমাদের আরো বেশ সময় লাগবে। বিশেষ করে বিশ্ববাজারে আমাদের পোশাকের যে গ্রহণযোগ্যতা ছিল, তা এসব ঘটনার কারণে দিনে দিনে কমতে শুরু করে।
রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের অবিলম্বে ক্ষতিপূরণ প্রদান, খুনিদের বিচার, আহতদের পুনর্বাসন ও তৈরি পোশাকশিল্পে ২৪ এপ্রিল শোক দিবস পালনের দাবি জানিয়েছে পোশাকশ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন। রানা প্লাজায় নিহতদের স্মরণে শোক দিবস পালন করে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিটিএমএর সদস্যভুক্ত সব কারখানা। মর্মান্তিক রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় হতাহতদের পরিবারের সবার প্রতি সমবেদনা ও সহমর্মিতা প্রকাশ করছি।
লেখক : দ্য ডেইলি সান পত্রিকার শাহাজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি।