ইউপি নির্বাচন
নারীর ক্ষমতায়নের অন্তঃসারশূন্যতা

‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’। সুন্দর ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অবদান রয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পৃথিবীর অর্ধেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অংশীদার নারী। এ কথাটি আজ থেকে প্রায় ৮০ বছর আগে অনুধাবন করেছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নারীকে বাদ দিয়ে কোনো কল্যাণকর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্ভব নয়। যে দেশের কবি এই চিরন্তর বাণী অকপটে স্বীকার করেছেন, সেই দেশে নারীর অবস্থা ও অবস্থান কেমন? পৃথিবীর পঞ্চাশ শতাংশ মহান সৃষ্টির কারিগর এই নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কতটুকু হয়েছে? বলতে গেলে হতাশ হওয়া ছাড়া উপায় নেই। এ দেশের রাজনীতিতে বিশেষ করে স্থানীয় সরকার কাঠামোয় নারীর অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়ন নামে মাত্র। অথচ রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ছাড়া উন্নয়ন অন্তঃসারশূন্য।
২০১৫ সালে নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘নারীর ক্ষমতায়ন মানবতার উন্নয়ন’। মানবতার উন্নয়নে নারীর ক্ষমতায়ন অনস্বীকার্য। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়নে কতটুক এগিয়েছে বাংলাদেশ? স্বাধীনতার জন্য দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি হয়েছে। অথচ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও নারীর ক্ষমতায়ন আশানুরূপ হয়নি। রাজনীতিতে এখনো নারীর প্রান্তিক অবস্থান দিবালোকের মতো স্পষ্ট। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর প্রবেশ খুবই সামান্য। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। নারী নেতৃত্ব সেখানে অমাবস্যার চাঁদের মতো। স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে নারীদের নির্বাচিত হওয়া তো দূরে থাক, মনোনয়ন পাওয়াটাও দুষ্কর।
বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে মনে হবে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। যে দেশে গত ২৫ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রীর পদ ও বিরোধীদলীয় প্রধানের পদ নারীর দখলে, সে দেশের চেয়ে কোন দেশে নারীর ক্ষমতায়ন বেশি! নবম জাতীয় সংসদের হিসাব করলে তো বলতে হবে, বাংলাদেশ নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে পৃথিবীর অনন্য দৃষ্টান্ত। সেখানে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন নারী। বর্তমান সংসদও সেই হিসেবে কম নয়। প্রধানমন্ত্রী, সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা, সাবেক বিরোধীদলীয় নেতা ও স্পিকার সবাই হচ্ছেন নারী। এসব দেখে যে কেউ নির্দ্বিধায় বলতে পারে, এখানে নারীর ক্ষমতায় ও অংশগ্রহণ অন্য সব দেশের চেয়ে বেশি।
কিন্তু সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র পাওয়া যায়। গুটিকয়েক পদ ছাড়া বাকি জায়গাগুলোতে নারী নেতৃত্ব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। রাজনৈতিক দলসহ পুরো সরকারব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণের হার নেহাতই কম। রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে শুরু করে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত এই চিত্র আরো ভয়াবহ। উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও ইউনিয়ন পরিষদে নারীর প্রতিনিধিত্ব (সংরক্ষিত ছাড়া) খুঁজে পেতে হলে অনুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রয়োজন হতে পারে। এগারোটি সিটি করপোরেশনের মধ্যে মাত্র একটি সিটি করপোরেশনের মেয়র হলেন নারী।
স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান অবধি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনের ইতিহাস নারীর ক্ষমতানের কোনো ইতিবাচক সংবাদ দেয় না। উদাহরণ হিসেবে, ২০১১ সালের পৌর নির্বাচনের কথা বলা যেতে পারে। মোট এক হাজার ৩২৬ জন মেয়র পদপ্রার্থীর মধ্যে মাত্র ১১ জন ছিলেন নারী প্রার্থী, যা নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য কোনোভাবেই ইতিবাচক দৃষ্টান্ত নয়। আর নির্বাচিত হওয়ার সংখ্যা আরো ভয়াবহ। মাত্র একজন নারী প্রার্থী মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হতে পেরেছেন। নবম জাতীয় সংসদের আগে ‘দিনবদলের সনদে’ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩৩ শতাংশে উন্নীত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল। কিন্তু ২০১১ সালের পৌর নির্বাচনে এই দলের পক্ষ থেকে একজন নারী মেয়র প্রার্থীকেও সমর্থন দেওয়া হয়নি। বিএনপি মাত্র একজনকে সমর্থন দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো মুখে মুখে হর-হামেশাই নারীর ক্ষমতায়নের কথা বলে। কিন্তু নারীর প্রতি এ আচরণ নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের বিষয়ে তাদের অঙ্গীকারের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
ছয় দফায় অনুষ্ঠেয় চলমান ইউপি নির্বাচনেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। এবারই প্রথমবারের মতো দলের ভিত্তিতে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বরাবরের মতো এবারও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নারীদের প্রার্থী করার ক্ষেত্রে অনীহা লক্ষ করা গেছে। প্রথম দুই দফার নির্বাচনের তথ্যই এর প্রমাণ। এক হাজার ২৫১টি ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মাত্র ৭২ জন নারী প্রার্থী ছিলেন। সরকারি দলের প্রার্থী ছিল মাত্র ১২ জন আর বিএনপি প্রার্থী দিয়েছে মাত্র ছয়জন। শতাংশের হিসেবে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে নারীদের প্রার্থী করার হার এক শতাংশেরও কম। আর এই দুই দফার নির্বাচনে মাত্র ১২ জন প্রার্থী চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
এবারের নির্বাচনটি দলের পরিচয়ের ভিত্তিতে হওয়ায় অধিক পরিমাণে নারীদের প্রার্থী ও জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কারণ, দল থেকে যাঁকেই মনোনয়ন দেওয়া হতো, দলের নেতাকর্মীরা তাঁর হয়েই কাজ করত। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো সে সুযোগ গ্রহণ করল না। প্রার্থী হিসেবে নারীদের বাদ রাখার ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলের অবস্থান অভিন্ন। এটা সুস্পষ্ট, নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নটি রাজনৈতিক দলগুলোর কাজে এখনো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। এতে প্রমাণিত হয় নারীরা রাজনীতি ও নির্বাচনে কতটা বৈষম্যের শিকার।
রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে নারীর তুলনায় পুরুষের মূল্য অনেক বেশি। ক্ষমতা ধরে রাখা ও প্রভাব বিস্তার করার ক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকা বিস্তর। চর দখলের মতো ভোটকেন্দ্র দখল করা আর পার্টির ফান্ডে টাকা জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে নারী যে পুরুষের চেয়ে কম পারঙ্গম।
নারীদের মনোনয়ন কম পাওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। অনেকে এ ক্ষেত্রে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে দায়ী করে থাকেন। কিন্তু এর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো পেশিশক্তি ও অর্থশক্তি। সাম্প্রতিক সময়ের নির্বাচনগুলোতে টাকা ও পেশিশক্তি মূল ক্রীড়নক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, টাকা আর পেশিশক্তির জোরে পুরুষরা মনোনয়নের দৌড়ে নারীদের চেয়ে এগিয়ে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে, নারী প্রার্থীরা প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারবেন না। ফলে পুরুষরাই মনোনয়ন পেয়ে থাকেন। মনোনয়নের ক্ষেত্রে জনমর্থনের তুলনায় পেশিশক্তি, অর্থশক্তি আর প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়।
ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রশ্নে নারীর ক্ষমতায়ন ধোপে টিকে না। ‘সারভাইবাল ফর দ্য ফিটেস্ট’। কিংবা জোর যার মুল্লুক তার। এই তত্ত্বে যে নারী কম শক্তিশালী। ক্ষমতা যেখানে মুখ্য, নারীর ক্ষমতায়ন সেখানে গৌণ। কারণ ক্ষমতার জন্য চাই অস্ত্র আর টাকা। যারা কেন্দ্র দখল করতে পারবে, ব্যালট বাক্স ছিনতাই করতে পারবে, তারাই মনোনয়নের জন্য অধিকতর যোগ্য। ‘আমার ভোট আমি দেব, তোমার ভোটও আমি দেব’ এই স্লোগানকে যারা বাস্তবে রূপ দিতে পারবে তারাই তো যোগ্য! আর এসব জোগান দিতে পুরুষরা নারীর তুলনায় বেশি সক্ষম।
সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণ ছাড়া কখনোই নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় নির্বাচনগুলো নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে যথাযথ স্থান দিতে ব্যর্থ হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ একজন চেয়ারম্যান ও ১২ সদস্যসহ মোট ১৩ সদস্য নিয়ে গঠিত হয়। সেখানে তিনজন নারী সদস্য থাকেন। যারা নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন থেকে নির্বাচিত হয়। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় এই সংরক্ষিত নারী সদস্যদের ভূমিকা খুবই কম। মাত্র ১-২ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব (সংরক্ষিত ছাড়া) কখনোই নারীর পরিপূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নির্দেশ করে না।
সংবিধানের ২৮ (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার লাভ করিবেন’। এ ছাড়া ১৯, ২৭, ২৮(১), ২৮(৩), ২৮(৪) ও ২৯ নং অনুচ্ছেদে নারীর ক্ষমতায়ন ও সকল পর্যায়ে নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে জোরালো বক্তব্য আছে। রাষ্ট্রের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০বি ধারায় বলা হয়েছে, ২০২০ সালের মধ্যে রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সব স্তরে কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো ‘কাজির গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নাই’। এই ইউপি নির্বাচনই সেটার জ্বলন্ত প্রমাণ।
লেখক : গবেষক ও শিক্ষক, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ