পহেলা বৈশাখ উদযাপন প্রসঙ্গে

এবার থেকে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের জন্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উৎসবভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বৈশাখ মেলা বাঙালি জীবনে একটি ধর্মনিরপেক্ষ উৎসব।
বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতাপন্থী ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলামপন্থীদের মধ্যে যে অন্ধ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া চলে আসছে, তাতে পহেলা বৈশাখ উদযাপনের জন্য উৎসবভাতা দেওয়ার এই ব্যবস্থা রাষ্ট্রধর্ম-ইসলামপন্থীদের প্রতিক্রিয়ার কারণে হয়েছে। পহেলা বৈশাখে মুখোশ পরে প্রদর্শনীর যে আয়োজন ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে দেখা যাচ্ছে, এর বিরুদ্ধেও তারা বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে চলছে। ১৯৯৭ সাল থেকে কয়েক বছর পহেলা বৈশাখের উৎসব উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ... হরে রাম’ বলে নৃত্য করা হয়েছে। মুখোশ পরা ও নৃত্য করাকে বলা হয়েছে বাঙালি সংস্কৃতির প্রকাশ। এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে বলার কী আছে? স্বার্থান্ধ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে অনেক সময় কাণ্ডজ্ঞান লোপ পায়। অন্ধ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে কোনো পক্ষকেই আমি সমর্থন করতে পারি না। আমি সব মহলে কাণ্ডজ্ঞানের উদয় চাই, শুভবুদ্ধির উদয় চাই। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের থেকে আমি বেশি দায়িত্বশীলতা আশা করি। কারণ তাদের ক্রিয়া দ্বারাই প্রতিপক্ষের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।
কবি ঈশ্বরগুপ্ত দেড়শো বছর আগে বাঙালির রঙ্গপ্রিয়তা দেখে লিখেছিলেন, এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গভরা! অত্যুন্নত প্রযুক্তি নিয়ে বাঙালির রঙ্গপ্রিয়তা এখন কয়েকগুণ বেড়েছে। বাঙালিকে বলা হতো হুজুগে বাঙালি। এখন অত্যুন্নত প্রযুক্তি নিয়ে বাঙালির হুজুগপ্রিয়তাও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। রঙ্গবাজি ও হুজুগ থেকে গণজাগরণ ভিন্ন। গণজাগরণে জনগণের মহৎ মানবীয় গুণাবলির জাগরণ দেখা যায় এবং মহান নেতৃত্বের পরিচালনা দেখা যায়। গণজাগরণে জনগণের ভূমিকা থাকে সৃষ্টিশীল। সৃষ্টির পথ ও অপসৃষ্টির পথ ভিন্ন।
সরকার পহেলা বৈশাখ উদযাপনের জন্য যেমন উৎসবভাতার ব্যবস্থা করেছে, তেমনি ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর উদযাপনের জন্য উৎসবভাতার ব্যবস্থা করতে পারে। দুই ঈদ, দুর্গাপূজা ও সরস্বতী পূজা, বুদ্ধপূর্ণিমা ও চিবরদান উপলক্ষে উৎসবভাতা দেওয়ার যে ব্যবস্থা স্বৈরাচারী এরশাদ সরকার করে গিয়েছিল, তা এখনো বহাল আছে। এখন নতুন করে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জন্য উৎসবভাতা চালু করলে তা সব ধর্মাবলম্বীর জন্যই করা উচিত। তবে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি যাতে না হয়, সেদিকে সবারই প্রচেষ্টা দরকার।
অন্ধ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে যে সমস্যা দেখা দিচ্ছে, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় মত্ত উভয় মহলে কাণ্ডজ্ঞানের ও শুভবুদ্ধির উদয় হলে তার সমাধান কঠিন হতো না। সমস্যা এই জায়গায় যে, স্বার্থান্ধ লোকদের মত্ততার মধ্যে কাণ্ডজ্ঞান ও শুভবুদ্ধির লোপ পায়।
যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে পুলিশ ও র্যাব থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজন যে ঘোষণা দিয়েছে, তা মান্য করে চলা সবারই কর্তব্য।
অবস্থা এ রকম থাকবে না, কাণ্ডজ্ঞান ও শুভবুদ্ধির উদয় হবে। সেই উদয়ের প্রক্রিয়াকে বিকশিত করাই এখন আমাদের কর্তব্য। সভ্যতা, সংস্কৃতি, প্রগতি ইত্যাদি ধারণাকে পরিবর্তিত বাস্তবতা পুনর্গঠিত করতে হবে। মিথ্যার হাত থেকে রক্ষা পেতে হবে।
লেখক : সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।