মতান্তর
ইলিশের সঙ্গে পহেলা বৈশাখ সম্পর্ক

পহেলা বৈশাখ হলো বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যবাহী সাদামাটা একটি সর্বজনীন উৎসব। এর মধ্যে কোনো কৃত্রিমতা আগে কখনোই ছিল না বা থাকার কথাও নয়। কারণ সহজ-সরল বাঙালির গ্রামীণ জনপদের মানুষ তা যার যার সাধ্য ও প্রথাগতভাবে পালন করে থাকে। গ্রামীণ বাংলার ঐতিহ্য হলো তিন বেলা পেটপুরে ভাত খাওয়া এবং মাঠে-ঘাটে আচ্ছামত কাজ করা। সেখানে তাদের পেটভরাটাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। কী দিয়ে ভাত খেল সেটা এতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
চেপা-শুঁটকি ভর্তা, আলু ভর্তা, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, লবণ, সবজি কিংবা পুরাতন তরকারি ইত্যাদির যে কোনো একটি আইটেম হলেই যথেষ্ট। গ্রামাঞ্চলে নিজেদের ঘরের চাল দিয়ে ভাত রান্না করা হয় বিধায় সেই রান্নায় অতশত লোক বা মাথা গুণে কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব কষে তা করা হয় না। সে জন্য রাতের খাবারের পর দেখা যায় অনেক ভাত থেকে যায়। কিন্তু গ্রামে তো আর তখন ফ্রিজ ছিল না। তাই সেই বাড়তি ভাত থাকলে তা নষ্ট হয়ে খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সে জন্য রাতে খাবারের পর সেই ভাতে পানি দিয়ে রাখলে তা আর নষ্ট হয় না কিংবা রোগ-জীবাণু জন্মায় না। রাতে পানি দিয়ে রাখা ভাত সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠে যে যা পারে তাই দিয়ে কোনো রকমে খেয়ে মাঠে হাল-মই, মাঠ নিড়ানো, ফসল কাটা ইত্যাদিতে অংশগ্রহণের জন্য চলে যায়।
রাতে রাখা ভাতই হলো পান্তা বা বাসি ভাত এবং থেকে যাওয়া তরকারিই হলো বাসি তরকারি। শীত মৌসুম ছাড়া সারা বছরই এভাবে ভাত তরি-তরকারি রেখে খাওয়া গ্রাম বাংলার লোকায়ত ও চিরায়ত সংস্কৃতি। তবে চৈত্র-বৈশাখ মাসে মাঠে ময়দানে গ্রামীণ কৃষকের বেশি কাজকর্ম থাকে বিধায় এবং সে সময় গরমকাল শুরু হওয়াতে রাতে রেখে দেওয়া ভাত বেশি তাড়াতাড়ি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকার কারণে এ সময়ই তা বেশি প্র্যাকটিস হয়ে থাকে। তা ছাড়া তিনবেলা ভাত খাওয়ার অভ্যাসের কারণে সকালবেলার মেনুতে একটু বৈচিত্র্য আনা। অপরদিকে পান্তা ভাত খেতে কম তরকারি কিংবা স্বল্প ও সস্তা আইটেম দিয়ে খাওয়া যায় বলে তাতে অনেক খরচ বাঁচে। সেটি পেটে আবার থাকেও বেশিক্ষণ ধরে। সহজে কিংবা তাড়াতাড়ি হজম হয় না বিধায় একটানা দীর্ঘক্ষণ তারা তাদের মাঠে কাজ করতে পারে বলে মনে করে তারা। কিন্তু এতকিছুর মধ্যে ইলিশের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে এটা ঠিক যে, একসময় ইলিশ মাছ খুবই সস্তা ছিল এবং তা খুবই সহজপ্রাপ্যও ছিল।
ইলিশ মাছের স্বাদ ও গন্ধ এবং এর সহজপ্রাপ্যতার কারণেই জাতীয় মাছের স্বীকৃতি পেয়েছে। ইলিশ মাছ পছন্দ করে না এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। আমাদের ছোটবেলায় দেখা গেছে, যদি সারা দিন স্কুল শেষে প্রতিদিন বাড়িতে এসে ইলিশ মাছের তরকারি দেখতাম, রাগ করতাম। কারণ একটি খাবার যতই পছন্দের হোক না কেন সেটা প্রতিদিনই তিনবেলা খেতে নিশ্চয়ই ভালো লাগে না। তখন হয়তো আধিক্যের কারণে গ্রামাঞ্চলে রাতে রান্না করা ইলিশ মাছের বেঁচে যাওয়া তরকারি ওপরে উল্লেখিত আইটেমগুলোর সঙ্গে যোগ হতো। কিন্তু পান্তার সঙ্গে ইলিশ হতেই হবে এমন কোনো ঐতিহ্যের কথা ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না। অথচ কালের পরিক্রমায় এখন যেন পান্তা এবং ইলিশই একমাত্র পহেলা বৈশাখের উদযাপনীয় আইটেম হিসেবে এসে ঠেকেছে।
সাদা গরম ভাতে পানি ঢেলে জোর-জবরদস্তি করে পান্তা বানানো হচ্ছে। ইলিশ মাছের পেছনে পেছনে ছুটতে ছুটতে বাজার খালি হয়ে যাচ্ছে। আকারভেদে একেকটি ইলিশ মাছের মূল্য দাঁড়াচ্ছে এক হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। দামের সুযোগ নিয়ে কিছু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী মিয়ানমার থেকে স্বাদ-গন্ধহীন নিম্নমানের ইলিশ মাছ আমদানি করে তা গলাকাটা দামে হন্যে হয়ে খোঁজা খদ্দেরদের কাছে বিক্রি করছে। যেমন শায়েস্তা খানের আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত জনশ্রুতির বদলে এখন বলতে শোনা যায়, সাড়ে চার মণ ধানে এক কেজি ইলিশ মাছ, তাও আবার পাওয়া যাচ্ছে না।
সংস্কৃতিচর্চার নামে এগুলো আসলে এক ধরনের বিকৃত ও অসম প্রতিযোগিতা। কারণ পান্তা-ইলিশ ছাড়াও পহেলা বৈশাখে পালন করার মতো আরো অনেক কিছু আছে যা আমরা অনেকেই পালন করি না। পর্যবেক্ষকদের বিশ্লেষণমতে, এ উৎসবটি যখন গ্রাম থেকে শহুরে মানুষের দিকে ধাবিত হয়েছে, তখন থেকেই আসলে এর প্রকৃত তাৎপর্য মলিন হতে শুরু করেছে। এখন শহরের প্রতিটি বাড়িতে পহেলা বৈশাখে একটি ইলিশ মাছ জোগাড় করতে না পারা মানে সেটা তার অক্ষমতা ও ব্যর্থতা হিসেবে দেখা হচ্ছে। পহেলা বৈশাখের কমপক্ষে দু-তিন মাস আগে থেকেই এখন ইলিশ সংগ্রহের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যাচ্ছে।
ইলিশের এখন প্রজনন মৌসুম। এ সময় তাদের প্রজনন করতে না দিলে এ বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির মাছটি অদূর ভবিষ্যতে আরো হুমকির মধ্যে পড়বে। প্রতিটি হোটেল-মোটেল, পর্যটন কেন্দ্র, মেলা ইত্যাদিতে জোর করে বানানো পান্তা এবং একপ্রকার যুদ্ধের মাধ্যমে সংগৃহীত ইলিশ মাছের প্রতি প্লেট খাবার সহস্রাধিক টাকায় বিক্রি হয়। আর আমরাও তা পাগলের মতো করে কিনে খাচ্ছি। আরো অনেক দেশীয় মাছ রয়েছে যেগুলোর দিকে আমরা দৃষ্টি দিচ্ছি না। যে কোনো জিনিস এক্সট্রিম পর্যায়ে চলে গেলে সেখান থেকে বের হতে পারলে ভালো হয়। কাজেই সময় এসেছে আর্টিফিশিয়াল পান্তা-ইলিশের সংস্কৃতি থেকে দেশ ও জাতিকে বের করে আনা। সরকার এ বছর এ বিষয়ে বেশ প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে মিডিয়ারও অনেক ভূমিকা রয়েছে, যা এবার একটু ভালোভাবেই পালন করছে বলে মনে হয়।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়