প্রতিক্রিয়া
নিষেধাজ্ঞার ঘেরাটোপে বৃত্তবন্দি পয়লা বৈশাখ

নতুন প্রাণের জয়গান ও নতুন দিনের আহ্বানে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম উচ্চারণ করেছিলেন—তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ ঐ নূতনের কেতন ওড়ে/ কালবোশেখির ঝড়। এটা ছিল কবির শাশ্বত বৈশাখী-বন্দনা। কিন্তু এখন বেঁচে থাকলে এই সময় আমাদের সেই বিদ্রোহী কবি এমনভাবে কথাগুলো নিশ্চিত বলতে পারতেন না। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাঁকে বলা হতো, বৈশাখের বাতাস অনুভব করার পর থেকেই জবান বন্ধ করে দিয়ে আপনি ঘরে বসে থাকবেন। মন চাইলে পান্তা-ইলিশ খেতে চুপিচুপি রাষ্ট্র নির্ধারিত রেস্টুরেন্টে যেতে পারবেন বটে, তবে ভুলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় বৈশাখবিষয়ক কোনো পোস্ট দেবেন না; তাতে যুবাদের মাথায় বৈশাখী ভূত চাগাড় দিয়ে উঠতে পারে। যুবাদের যেই ভূত সুশৃঙ্খলভাবে নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য রাষ্ট্র রাখে না। অতএব, এসেছে বৈশাখ; খামোশ থাকুন কথকতার কবি!
১৪২১ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখে নারী নিপীড়নকে কেন্দ্র করে গেল এক বছরজুড়েই দেশে হাজারটা মেলোড্রামা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্ষবরণে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় হাইকোর্টের রুল থাকার পরও নৌমন্ত্রীর মতো কিছু শাসকশ্রেণির ব্যক্তিত্ব যৌন হয়রানিকে বিষয়ই না বলে উল্লেখ করে গেছেন। এমনকি পুলিশের দায়িত্বশীল আধিকারিকরা পর্যন্ত এমন একটু-আধটু ঘটতেই পারে বলে বাচনিক প্রহসন মঞ্চস্থ করে গেছেন। এ ছাড়া ওই বর্ষবরণের দিন যৌন হয়রানির ঘটনায় আট নিপীড়ক চিহ্নিত করার কথা জানিয়ে লাখ টাকা পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েও সরকারের তরফে শুভংকরের ফাঁকিটাই সারবত্তা হিসেবে দেখা গেছে।
এমন বাস্তবতায় ১৪২২ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখ সমাগত প্রায়। অসাম্প্রদায়িক বাংলার আকাশে-বাতাসে ধীরলয়ে ধ্বনিত হতে শুরু করেছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমর পঙ্ক্তিমালা—এসো হে বৈশাখ, এসো এসো/তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে/ বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।
কিন্তু আমাদের সেই স্বতঃস্ফূর্ত বৈশাখী আনন্দকেই কি-না রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকে দেওয়া হচ্ছে। উদযাপনে কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে!
সরকারি ঘোষণা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের জবানিতে এরই মধ্যে জানা হয়ে গেছে, বাংলা পঞ্জিকার নতুন বছরের প্রথম দিন সন্ধ্যা ৬টার পর রাস্তা পরিষ্কার করতে মাঠে নামানো হবে পুলিশ। সুতরাং ৫টার পর ঘরের বাইরে থাকা মানা। মুখোশে মুখ ঢেকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ এবং ভুভুজেলা বা বিকট আওয়াজের বাঁশি ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকবে। ইলিশের আকালের দিনে বাড়িতে পান্তা-ইলিশ নয়, ঢাকার অভিজাত হোটেলসহ জেলা পর্যায়ের হোটেলগুলোতেও ঐতিহ্যবাহী বাংলা খাবার পরিবেশনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। খানাপিনার পর্বটা সেখানেই সারতে হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাঙালি কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পরিচয়বাহী মুখোশ ব্যবহারেও কড়াকড়ি আরোপের কথা বলা হয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো, এইভাবে শাক দিয়ে মাছ ঢেকে অথবা মাথাব্যথায় মাথা কেটে ফেলার যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে কীভাবে যৌন নিপীড়কদের নিবৃত্ত করা হবে, তা কেউ বলছে না! বৈশাখে যদি নিজের স্বাধীনমতো কাঁচা-লঙ্কা-পেঁয়াজ, আলুভর্তা এবং ইদানীংকার ঐতিহ্য ইলিশ ভাজা দিয়ে পান্তাভাতই না খেতে পারে; যদি মনের আনন্দে বৈশাখী সাজে সজ্জিত হয়ে শোভাযাত্রায়ই অংশ নিতে না পারে, তবে ওই বর্ষবরণ দিয়ে আসলে বাঙালি মন কতটা ভরবে, তা কে জানে?
তবে চিরায়ত বৈশাখ উদযাপনে নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে আনন্দপিয়াসী মানুষকে হোটেল-রেস্তোরাঁর ঘুপচি ঘরে ঠেলে দিয়ে মুক্তচিন্তার দামামা আর কেউ বাজাতে পারবেন না; বরং মুখ ফুটে সরকার বাহাদুরের বলার সময় এসেছে, যে উগ্রবাদী গোষ্ঠী বৈশাখী উৎসবকে অনৈসলামিক বা বিজাতীয় সংস্কৃতি বলে দূরদূর ছাই ছাই করে গলা ফাটায়, দাবার ঘুঁটিটা তাদের ঘরে ঠেলে দিয়ে জাত গেল জাত গেল বলে এক মহারণ খেলার সুযোগই অবশেষে দেওয়া হলো। তার ওপর সরকারের এমন সিদ্ধান্তে গেল বাজেটে ঘোষিত সরকারি চাকুরেদের মূল বেতনের ২০ শতাংশ নববর্ষ ভাতা দেওয়ার সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বৈশাখকে যতটা তাৎপর্যমণ্ডিত করা হয়েছিল, তা পুরোমাত্রায় নস্যাৎই করা হলো বলে মনে করা যায়।
৫০০ বছর আগে ভারতবর্ষের শাসক আকবরের আমলে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য যে বর্ষগণনা পদ্ধতির প্রবর্তন করা হয়েছিল, কালক্রমে সেই বছরের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ বাঙালির সর্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। চার দশক ধরে রাজধানীতে বর্ষবরণের মূল আয়োজন হয়ে উঠেছে রমনা বটমূলে ছায়ানটের প্রভাতি অনুষ্ঠান। আর চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা এ উৎসবের অন্যতম প্রধান আয়োজন।
হাজার বছরের কষ্টিপাথরে নিখাদ হতে হতে যেকোনো জাতিগোষ্ঠীর আপন সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। বাঙালির বর্ষবরণও তেমনি একটি সাংস্কৃতিক উৎসব। সেই সর্বজনবিদিত স্বাজাত্য উৎসবের টুঁটি চেপে ধরে বাঙালি মানসিকতায় এক উন্নাসিক বিকারকে আহ্বান করা হচ্ছে না তো? যেখানকার মানুষ অসাম্প্রদায়িক বুদ্ধিবৃত্তিকে পরিত্যাগ করে হয়ে উঠতে পারে সাম্প্রদায়িক দাঁতাল। এর পরিণতি কতটা শুভ হতে পারে প্রিয় সরকার বাহাদুর? বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করার অসামর্থ্যকে নিবৃত্তের অন্ধকারে ঠেলা দেওয়া আপনাদের অধিকার নয়; বরং আমাদের ইচ্ছেঘুড়ির উড়বার মতো করে আনন্দ উৎসব আর হৈ-হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ, আবালবৃদ্ধবনিতা, নারী-পুরুষ বা শিশু নির্বিশেষে মুক্তপ্রাণ নিয়ে বর্ষবরণ আয়োজনে অংশ নিতে দিন। মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যবোধ জেগে ওঠার সুযোগ দিন। বৈশাখী চেতনায় বাঙালি মানুষকে একসূত্রে গেঁথে থাকার প্রেরণা দেওয়া হোক। চিহ্নিত কিছু অসভ্য অযাচারি মানুষের দূরাচারকে জুজু বানিয়ে, বর্ষবরণকে নিষেধাজ্ঞার বলি বানিয়ে আপন সংস্কৃতির মৃত্যুঘণ্টা বাজাবেন না।
মহান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সেই দুর্বিষহকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথিতযশা কণ্ঠশিল্পী আপেল মাহমুদ গেয়ে উঠতেন, বৈশাখেরই রুদ্র ঝড়ে/ আকাশ যখন ভেঙে পড়ে/ ছেঁড়া পাল আরও ছিঁড়ে যায়/ তবু তরী বাইতে হবে। শত প্রতিকূলতার মাঝেও তীরহারা ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিয়ে তাঁরা নিজেদের তরী পাড়ে ভেড়াতে ভোলেননি। আমরা এভাবেই একটা স্বাধীন সোনার দেশ পেয়েছিলাম। সে সময় মুক্তিযোদ্ধারা পেরেছিলেন। আর আমরা পারব না, পারি না ইত্যাদি বলে নানা বিধিনিষেধের ভয়ংকর জাল বুনে চলেছি। শকুন শ্বাপদের ভয়ে ভীত হয়ে পিছিয়ে গিয়ে আর কতটা অন্ধকার হাতড়ে আলোকিত পথের দিশা খুঁজব বলতে পারে শাসকগোষ্ঠী? আজ সময় এসেছে অন্ধকারের সারথিদের অকর্ম বা কুকথায় পাত্তা না দিয়ে ভয়কে জয় করার। আমাদের নবীন প্রজন্মকে বন্দিত্বের গুহাবাসের মধ্য দিয়ে ভীতি রাজ্যের গিনিপিগ বানাবেন না প্লিজ। তাদের মুক্তবিহঙ্গের মতো ডানা মেলতে দিন। তাদের হাত ধরেই আসুক অধিকতর বর্ণিল সোনালি দিন। নিষেধাজ্ঞার ঘেরাটোপে বৃত্তবন্দি পয়লা বৈশাখকে মুক্তি দিন। মানুষের স্বনির্ভরতায় দেশটা এগিয়ে যাক আর হাজার বছর বেঁচে থাকুক পয়লা বৈশাখ!
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।