শিশু দিবস
নিষ্পাপ শিশুটির কী অপরাধ?

সামাজিক অসংগতির যে দিকগুলো আমাদের খুব বেশি তাড়িত করে তার মধ্যে শিশু নির্যাতন অন্যতম। উপরের তলার আর নিচের তলার শিশুদের মধ্যে বৈষম্য আজীবন বিদ্যমান। তবে, অতি সম্প্রতি শিশু নির্যাতন যে হারে বেড়ে চলেছে তা উদ্বেগের বিষয়। স্বয়ং নিজের মা তার শিশুকে হত্যা করছে! বিষয়টা খুব বেশি সাধারণ নয়। এটা আমাদের সমাজ ব্যবস্থার জন্য এক অশনি সংকেত। আদতে কোনো মা তার সন্তানকে হত্যা করতে পারে কি না- এটা এখনো সন্দেহের বিষয়। পৃথিবীতে মায়ের চেয়ে আপন যে কেউ নেই এ কথা সত্য প্রমাণ করতে যাওটা বেশ বোকামি।
এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, শিশু হত্যার পেছনে যদি কোনো মায়ের সংশ্লিষ্টতা আমলে নেওয়া হয়, সেখানে পরকীয়া নামক এক যন্ত্রণা উপস্থিত হয়ে বিবেকের প্রশ্নকেও হার মানায়। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে উপরের তলার একটা শিশুকে যখন জোর করে খাওয়ার খাওয়াতে হয়। পিছু নিতে হয় খাওয়ানোর জন্য। বেশ কয়েক ঘণ্টা সময়ও ব্যয় হয়। তখন একই বয়সী আরেকটা শিশু ডাস্টবিনে খাবার খুঁজতে থাকে। ক্ষুধা নিবারণের জন্য। উপরতলার ওই শিশুটির পঁচা-বাশি খাবারই কপালে জোটে রাস্তার সেই ছিন্নমূল শিশুটির। বিভাজনটা আরো স্পষ্ট হয়। যখন শহরের একটা শিশু রাস্তা দিয়ে এসি গাড়িতে চড়ে যাওয়ার সময় জ্যামে আটকে থাকে তখন একই বয়সী একটা শিশু ওই জ্যামের মধ্যে ফুল, পপকর্ন ইত্যাদি বিক্রি করতে থাকে পেটের দায়ে।
হাজার হাজার শিশু প্রতিবছর পাচারের শিকার হচ্ছে। রাস্তার ধারে পড়ে থাকা ওই শিশুগুলোই টার্গেট পাচারকারীদের। ন্যূনতম শিক্ষা থেকে এখনো বঞ্চিত এ দেশের হাজারও শিশু। গ্রামে গঞ্জে ছাড়িয়ে থাকা এসব শিশুদের অধিকাংশই অল্প বয়সেই বেছে নেয় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। খুব বেশি দিনে আগের নয় সিলেটের রাজন হত্যাকাণ্ড আমাদের দেখিয়েছে মানুষ কতটা নিষ্ঠুর হয়। এক অমানবিকতা যে এ পৃথিবীতে বিদ্যমান তা ভাষার প্রকাশ করার নয়। তিন বছরের কন্যা শিশুকে যখন ধর্ষণ করা হয় তখন দায়টা আসলে কার উপর বর্তায়, যে মেয়েটার মুখে এখনো মায়ের বুকের দুধের গন্ধ। তাকে হতে হয় ধর্ষণের শিকার। অপরাধীর বিবেক বলে কিছু আছে বলে গণ্য করাটাও বড় ভন্ডামি বলে মনে হয়। ওই যে শিশুটা সে যদি হয় পরিবারের কেউ তখন কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমাদের সমাজের প্রায় অধিকাংশ শিশু শারীরিক অথবা মানুষিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এর সংখ্যাটা দিন দিন ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে চলেছে।
হালের একটা প্ররিক্রমা আরো অবাক করার মতো। শিশুদের দিয়ে ভিক্ষা করিয়ে রোজগার করে এক শ্রেণীর কাপুরুষ। এটা তাদের ব্যবসা। বলতে কষ্ট হয়। এসব শিশুদের আবার কৃত্রিম পঙ্গু করানো হয় যাতে রোজগার বাড়ে। এটা কোনো সভ্য সমাজ মেনে নিতে পারে না। শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে হর হামেশাই দেখা যায়। এ ক্ষেত্রে দরিদ্র এক শ্রেণীর মানুষকে বাধ্য করছে ভেবেও সচেতন বিবেকবানরা এখনো কিছু করার চেষ্টা করে না। দেখেও দেখে না এসব। ঘুরে ফিরে আপনার আমার পাশের বাড়ির ওই শিশুটাকেই যে নির্যাতন করতে হবে। আর গৃহকর্মীর কাজ করা মেয়ে শিশুগুলো যেন ইজারা দেওয়া হয় ওই বাড়িওয়ালাদের কাছে। তাদের ওপর চলে অকথ্য নির্যাতন। আজকাল তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের খরবটাও খুব স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আপনার শিশুটি যখন আদর, যত্ন আর সোহাগে বড় হয় তখন আপনারই কাছে একটা শিশু হাজারও বঞ্চনার শিকার।
যখনই শিশু নির্যাতন। তখনই একটা প্রশ্ন, ওরা কি সাধারণ মানুষের মতো বাঁচতে পারে না? ওরাও তো চায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে। কিন্তু প্রায়ই সে আপনার কিংবা আমার দ্বারা বঞ্চনার শিকার হয়। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ।
এ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তুলতে গেলে পাঁচ তলার শিশুটিকে যেমন শিক্ষা-দীক্ষা দেওয়া প্রয়োজন তেমনি গাছ তলার শিশুটির জন্যও কিছু সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন?
হয়তো মায়ের হাতে তুলে প্রতিবেলা খাবার সে পাবে না কিন্তু তাকে কেন না খেয়ে মরতে হবে? আপনি-আমি তাহলে সারাবেলা ভূরিভোজ করব কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন। যে দেশে ওয়ার্কশপে কাজ করা একটা ছেলের পায়ুপথ দিয়ে বাতাস প্রবেশ করিয়ে হত্যা করা হয়, সে দেশে খুব বেশি আশা করাটা ঠিক নয়। কিন্তু আজকের জন্ম নেওয়া শিশুটা কী পাপ নিয়ে জন্ম নিল যে তাকে অভুক্ত থাকতে হবে? অন্যদিকে খাবার অপচয়ে ডাস্টবিন ভরে যাবে। খাওয়া হবে রাজকীয় সব খাবার। নিষ্ঠুর এই দুনিয়ায় ছিন্নমূল এসব শিশুর জন্মই যেন আজন্ম পাপ।
আজকাল ক্ষুদ্র কিংবা বৃহৎ পরিসর সরকারি ও বেসরকারি কিছু উদ্যোগ দেখা যায়। কোনোভাবেই সেটা প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত বলা যাবে না। ব্যক্তি পর্যায়ে ছোট ছোট উদ্যোগ আর মানসিকতার পরিবর্তনে একটু সহায়তা পেতে পারে আপনার পাশে ভেসে বেড়ানো শিশুটি। যে আগামী দিনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে পরিবর্তনের।
লেখক : রিপোর্টার, দ্য সান।