শিশুর জন্য চাই একটু সতর্কতা আর দায়িত্ববোধ

শিশুদের ওপর সহিংসতা কিংবা তাদের সাথে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার কোনো খবর আমি পড়তে বা দেখতে পারি না। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শিশুদের ছবি অথবা কদিন আগে নাইজেরিয়ায় দুই বছরের যে শিশুটিকে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল স্বয়ং মা-বাপ, সেই ক্ষুধার্ত পিপাসার্ত শিশুর ছবির দিকেও আমি তাকাই নাই। পৃথিবীর যেকোনো শিশুকে দেখলেই আমার নিজের শিশু সন্তানের চেহারা মনে পড়ে যায়। আমি নিপীড়িত শিশুর জায়গায় নিজের সন্তানের মুখটা কল্পনা করে শিউরে উঠি।
রাজধানীর উত্তরায় রান্নাঘরের গ্যাস লাইন দুর্ঘটনায় মারা গেছে দুটি বাচ্চা। আরেকটি আহত। সেই শিশুদের বাবাও মারা গেছেন। আর মা এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে তুমুল লড়াই করছেন। নব্বই শতাংশ পুড়ে যাওয়া শরীর নিয়ে তাঁর ফিরে আসার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তবু সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রাণপণ প্রার্থনা করি, তিনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন। একটা মিরাকল হোক একবার। যে শিশুটি বেঁচে আছে, সেই শিশুটির জন্য অন্তত সৃষ্টিকর্তা ফিরিয়ে দিন তার মাকে। এসব খবর এড়াতে চাই। তবু এড়ানো কি যায়? গত দুই বছরে দেশে গ্যাসলাইনে বিস্ফোরণে অন্তত ৩০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। আর এসবের প্রধানতম কারণ সতর্কতার অভাব। এ ছাড়া গ্যাসলাইনে ত্রুটির বিষয়টা তো আছেই। কারণ যাই হোক, আগুনের লেলিহান শিখায় মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে গেছে হাসিখুশি একটি পরিবার, যে পরিবারের বড় সন্তানটি ছিল তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন উজ্জ্বল মেধাবী শিক্ষার্থী। আর আরেকটি, সে তো নেহাতই শিশু। আমার মন ভালো নেই। আমি বাচ্চাগুলোর ছবির দিকে তাকাইনি খবরগুলো পড়ার সময়। এ তো মানা যায় না! এ তো অসম্ভব মেনে নেওয়া!
সেদিন ফেইসবুকে একজন একটি ছবি পোস্ট করেছেন। মোটরসাইকেলে ছোট্ট মেয়েকে পিছনে বসিয়ে বাবা চলেছেন ঢাকার রাজপথ ধরে। বাচ্চাটির মাথায় হেলমেট নেই। সে তার ছোট ছোট দুটো হাত দিয়ে মোটাসোটা বাবাকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু এই প্রচণ্ড অনিয়ম আর ভিড়ভাট্টার শহরে যেকোনো মুহূর্তে ফসকে যেতে পারে শিশুটির হাত, ঘটতে পারে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। অথচ একটা সামান্য বাড়তি হেলমেট পরিয়ে শিশুটিকে আরো সতর্কতার সাথে বসিয়ে যদি পথে নামতেন বাবা, তবে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকটাই কমে যেত।
রাস্তায় চলতে ফিরতে প্রায়ই দেখি ছোট্ট বাচ্চার হাত ধরে হুড়মুড় করে রাস্তা পার হচ্ছেন বাবা মা, বাসে উঠছেন বেপরোয়াভাবে। রিকশায় বাচ্চা কোলে নিয়েছেন, বাচ্চার পা দুটো বাইরের দিকে ঝুলছে, এমন দৃশ্যও চোখে পড়ে হরহামেশা। আমি প্রায়ই গায়ে পড়ে এসব মা-বাবাকে সতর্ক করি। বলি, বাচ্চাকে সাবধানে নেন। অনেকেই সতর্ক হয়ে যান সাথে সাথে। কেউ কেউ এমনও আছেন, গায়েই মাখেন না, যেমন চলছিলেন চলতে থাকেন। আমার তবু বুক ধুকপুক করে। আমি ফিরে ফিরে দেখি বাচ্চাটার মুখ। সে তো পরম নির্ভরতায় বসে আছে মা-বাবার কোলে। অথচ বাপ মা এক অর্থহীন আত্মবিশ্বাস নিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে আছেন সিটে। বাচ্চা ঝুলছে। আমার ইচ্ছে হয় তাঁদের বলি, এই শহরে আত্মবিশ্বাস দিয়ে কিছু হয় না। এই শহরে চলতে হবে বাড়তি সতর্কতা নিয়ে। এই শহরে বাস করতে হবে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে। তা না হলে যেকোনো মুহূর্তে নেমে আসতে পারে বিপদ।
সামান্য একটা ম্যাচের কাঠি বাঁচাতে আমার অনেক আত্মীয় বন্ধুর বাসাতেও দেখেছি চুলা জ্বালিয়ে রাখতে। দেশের কোটি টাকার গ্যাস সম্পদ পুড়ে যাচ্ছে যাক, তাদের সব চিন্তা দশ পয়সার একটা কাঠি বাঁচানোকে ঘিরে। অনেকে দেখি রান্নাঘরে কাপড় শুকাতে দেন বর্ষাকালে, শীতে। নিচে চুলা জ্বলে। আমার অবাক লাগে। এই ২০১৬ সালে এসেও যদি এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে হয়, তবে আর কবে শিখব আমরা?
আমার সন্তানের জন্য আমি অনেক কিছুই করতে পারি না। হয়তো তাকে আরো ভালো রাখতে পারতাম, আরো আদর দিতে পারতাম, আরো সময় হয়তো তাকে দেওয়া উচিত। এসব কিছুই হয়তো তাকে ঠিকমতো দিতে পারি না। এ নিয়ে আত্মগ্লানিতেও ভুগি কখনো কখনো। কিন্তু কোনোদিন সন্তানের নিরাপত্তাহীনতা কিংবা তার বিপদে পড়ার সম্ভাবনা যেখানে, সেসব পরিস্থিতিতে আমি ছাড় দিতে রাজি নই। আমার দুই বছরের মেয়ে গাড়ির পিছনে সিটবেল্ট বেঁধে বসে। দূরপাল্লার যাত্রায় তো বটেই, এখন তার এমন অভ্যাস হয়েছে যে ঢাকার রাস্তাতেও সে সিটবেল্ট বেঁধে নেয়। এই সতর্কতায় দুর্ঘটনা কতটা এড়াতে পারব জানি না, কিন্তু এটা জানি, নিয়ম মেনে চলায় যে স্বস্তি আর শান্তি আছে, তা অন্য কিছুতে নেই। একটি শিশুকে পৃথিবীতে আনার চেয়ে বড় দায়িত্ব আর কিছু নয়। তাকে সুস্থ ও সুন্দর জীবন দেবার দায়িত্ব আমার। তাই কষ্ট হলেও আমাকে তাই-ই করতে হবে যা শিশুর জীবনের নিরাপত্তা দেবে। মাঝেমধ্যে আমারও ভুল হয়। বড় হওয়ার প্রক্রিয়ার কোনো কোনোদিন মেয়ে মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছে মার্বেল, কোনোদিন পড়ে গেছে খাট থেকে, রাস্তায় আমারই হাত ধরা অবস্থায় আছড়ে পড়েছে। এসব মুহূর্তে নিজেকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করতে পারি না। কিন্তু পরের মুহূর্তে আমি আরো সতর্ক হয়ে ওঠার শপথ নিই। এই সুন্দর পৃথিবীতে আমার সন্তান নিরাপদে বেড়ে ওঠার, চলাচলের শিক্ষা নেবে আমারই হাত ধরে। আর তার জন্য একটা নিরাপদ পৃথিবী গড়তে আমাকে মেনে চলতে হবে নিয়মকানুন আর চলতে হবে সতর্কতার সাথে। এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সাংবাদিক