স্মৃতির মিনার
একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন ও বইমেলা

আমার ধারণা, বাংলা একাডেমির ফেব্রুয়ারি মাসের বইমেলা যদি না থাকত তাহলে এত দিনে সরকারি অফিসে ও শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলা অল্পই খাটত এবং ইংরেজি বাংলার স্থলাভিষিক্ত হতো। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূলধারায় ইংলিশ ভার্সন নামে যে শাখা চালু করা হয়েছে তার পেছনে দেশটির শাসকশ্রেণির মনোভাবের পরিচয় রয়েছে। এ নিয়ে জনগণের ওপর অভিভাবকত্বকারী বিশিষ্ট নাগরিকদের কোনো উচ্চবাচ্য নেই। আসলে তাঁদের অদৃশ্য আগ্রহ ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই এটা চালু হয়েছে এবং চলছে। তাঁদের ভূমিকা কি ভালো? ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক পরিচালিত ইংলিশ মিডিয়ামের ‘এ’ লেভেল ‘ও’ লেভেল বাংলাদেশে ভালো ভাবেই চলছে এবং সে ধারা ক্রমবর্ধমান। তা ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত ইংলিশ মিডিয়ামের স্কুলও বাংলাদেশে চলছে। বাংলাদেশের যোগ্যতর ছেলেমেয়েরা এখন বাংলাদেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রিটেন, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে নাগরিকত্ব গ্রহণের জন্য উদগ্রীব। শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা এমন যে, আর বছর দশেক গেলে দেখা যাবে দেশের সচিবালয় চালিয়ে নেওয়ার মতো যোগ্য শিক্ষিত লোকের জোগান বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েগুলো দিতে পারছে না। বইমেলার মধ্যে ভালো ও মন্দ দুই-ই আছে। বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য বইমেলার একটা চাপ বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির ওপর কার্যকর আছে।
সংস্কৃতির ধারণাকে এখন অনেকটাই নাচ-গান-বিনোদনে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। দর্শন ও বিজ্ঞান গুরুত্ব পায় না। গণতন্ত্রের ধারাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন ও নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে দেশ পরিচালনায়। নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যর্থ। রাষ্ট্র ও রাজনীতি বিচারে বাংলাদেশ সফল না ব্যর্থ? মুক্তবাজার অর্থনীতি, অবাধ-প্রতিযোগিতাবাদ ও বহুত্ববাদ গ্রহণ করার ফলে রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশ গড়ে উঠতে পারছে না। ধনী-গরিবের বৈষম্য বাড়ছে, অন্যায়-অবিচার ও জুলুম-জবরদস্তি বাড়ছে, অপব্যবস্থা দুর্নীতি হিংসা-প্রতিহিংসা, হত্যা-আত্মহত্যা বাড়ছে। সহিংসতা, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। মানুষ মনোবলহারা, নিস্তেজ-প্রতিবাদহীন-জুলুম-জবরদস্তি ও অন্যায়-অবিচারের কাছে আত্মসমর্পণ পরায়ণ। জাতীয় ঐক্য, রাষ্ট্রীয় সংহতি নেই।
যে চেতনা নিয়ে পাকিস্তানকালে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপিত হতো তাতে সৃষ্টিশীলতা ও প্রগতিচেতনা ছিল। এখন বইমেলার মাস হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাস যেভাবে উদযাপিত হয়, তাতে সৃষ্টিশীলতা ও প্রগতিচেতনা দুর্লভ। কয়েক বছর ধরেই বইমেলার মাস উপলক্ষে প্রতি বছর হাজার দুই নতুন বই প্রকাশিত হলেও বইয়ের কোনো মূল্যবিচার নেই। বিনোদনমূলক বই, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে রচিত বই, উত্তেজনাকর বই, উস্কানিমূলক বই, চমকসৃষ্টিকারী বই অনেক আছে, প্রগতিমূলক বই কমই আছে। প্রগতির চেতনাই হারিয়ে গেছে। যেসব বই খুব বিক্রি হয় সেগুলোতে কী থাকে? পাকিস্তানকালে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে সরকারের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিবাদ থাকত, জনজীবনের নতুন নতুন সমস্যা সমাধানের ও সম্ভাবনা বাস্তবায়নের দাবি থাকত; উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন-কল্পনা থাকত, বাংলা ভাষার উন্নতির লক্ষ্যে নতুন নতুন কর্মসূচি ঘোষিত হতো, সব কিছুর মর্মে থাকত বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা ও গণতন্ত্র-প্রতিষ্ঠার চেতনা, সর্বোপরি থাকত উন্নততর ভবিষ্যতের আশা। এখন ফেব্রুয়ারির বইমেলার উৎসবের আমেজ ও ভোগবাদী চেতনার পরিচয় থাকে। প্রগতিবোধ, সন্ধিৎসা ও শ্রমশীলতার সন্ধান কমই পাওয়া যায়। তখনকার আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতা আজকের থেকে ভিন্ন ছিল। তখনকার বিশ্বব্যবস্থায় ওয়াশিংটন, মস্কো ও বেইজিংয়ের অবস্থান ছিল পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী আলাদা আলাদা কেন্দ্র রূপে। আজকের বিশ্বব্যবস্থাকে কেউ কেউ বহুকেন্দ্রিক বলছেন বটে, কিন্তু আসলে তা এককেন্দ্রিক- ওয়াশিংটন কেন্দ্রিক। তখনকার আন্তর্জাতিকতাবাদ আর আজকের বিশ্বায়ন এক নয়। আন্তর্জাতিকতাবাদে জাতিরাষ্ট্রগুলোকে রক্ষা করায়, তাদের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির ও বিরোধ মীমাংসার লক্ষ্য ছিল। বিশ্বায়ন সাম্রাজ্যবাদেরই নামান্তর মাত্র।
আসলে কিছুই এক অবস্থায় থাকে না। প্রকৃতি পরিবর্তনশীল, বিকাশমান, মানবস্পদও পরিবর্তনশীল, বিকাশমান। এখনকার বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, উৎপাদন ও সম্পদ এখনকার চেয়ে অনেক অগ্রসর ও বেশি। এখন বৈষয়িক প্রাচুর্যের মধ্যে মানসিক রিক্ততা আছে। মানুষের মূল্যবোধ ও নৈতিক চেতনা উন্নত হয়নি, অবনত হয়েছে। ন্যায় কমেছে, অন্যায় বেড়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও জীবপ্রযুক্তির বিপ্লব এবং অন্যান্য প্রযুক্তির বিপুল উন্নতির ফলে উৎপাদন ও সম্পদ অনেক বেড়েছে এবং মানুষ বৈষয়িক জীবনে অনেক কিছু ভোগ করতে পারছে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি উন্নতিশীল আছে, কিন্তু সভ্যতা-সংস্কৃতির দিক দিয়ে মানুষ অবনতিশীল। সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ ক্রমবর্ধমান। সভ্যতা-সংস্কৃতি ও প্রগতিবিচারে ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে ঘুরছে। ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরাও এখন ধর্মের দিকে ঝুঁকছে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, জাতীয়তাবাদ কোনটার অবস্থা কেমন? ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর থেকেই দেখা যাচ্ছে, আন্দোলন-সংগ্রাম ও নয় মাসের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মীমাংসিত বিতর্ক পুনরুজ্জীবিত ও বিকশিত হয়ে চলছে। আমাদের বোঝা দরকার যে, এক হাতে তালি বাজে না। ইহিতাসের পশ্চাৎগতির জন্য কেবল ধর্মপন্থীরাই দায়ী- এ কথা ঠিক নয়। দীর্ঘ সংগ্রামের ও নয় মাসের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মীমাংসিত বিতর্ক যে আজ পুনরুজ্জীবিত ও বিকাশমান, তার কারণ বুঝতে হলে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে চার দশকের ইতিহাসের সত্যসন্ধ, সত্যনিষ্ঠ, পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার দরকার। সব হারানোর জন্য একমাত্র পাকিস্তানপন্থীরা দায়ী এ কথা অবশ্যই ঠিক নয়। প্রগতির জন্য ধারণার মৌলিক পুনর্বিচার দরকার। কখনো কখনো মনে হয় গোটা জাতি যেন বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছে।
কোনো ঘটনা উপলক্ষে অনুষ্ঠানাদির পার্বনিক উদযাপন দিয়ে প্রগতি হয় না। প্রগতির জন্য সৃষ্টিশীলতা লাগে। আমাদের জাতীয় জীবনে আজ সৃষ্টিশীলতার চর্চা দরকার। তরুণরা আরম্ভ করতে পারে। রেনেসাঁস ছিল, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে রেনেসাঁস লোপ পেয়েছে। এ অবস্থায় দরকার নতুন রেনেসাঁস। আগেকার রেনেসাঁস ছিল মধ্যযুগের গর্ভ থেকে আধুনিক যুগকে মুক্ত করার এবং নতুন সৃষ্টির লক্ষ্যে সাধনা ও সংগ্রাম। সে সাধনা ও সংগ্রামের ধারাবাহিকতাকে রক্ষা না করার ফলে মধ্যযুগের পরাজিত ধ্যান-ধারণা পুনরুজ্জীবিত হয়ে চলছে। আজ নতুন রেনেসাঁসের জন্য দরকার, আধুনিক যুগের অবক্ষয়ক্লিষ্ট বিকারপ্রাপ্ত ধ্যান-ধারণার ও মধ্যযুগের পুনরুজ্জীবিত ধ্যান-ধারণার কবল থেকে মুক্তি ও নবযুগের সৃষ্টিশীলতা। রাজনীতি-অর্থনীতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য সব ক্ষেত্রে নবযুগের সৃষ্টিশীলতা সূচিত হলে, নতুন চরিত্রবল ও শুভবুদ্ধি দেখা দিলে মধ্যযুগের পরাজিত সংস্কার-বিশ্বাসের পুনরুজ্জীবনের সুযোগ থাকবে না। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, আন্তর্জাতিকতাবাদ-ইত্যাদি আজ বিকারপ্রাপ্ত। নতুন রেনেসাঁসের জন্য এসবের আমূল পুনর্বিচার ও স্বাভাবিক সৃষ্টিশীল বিকাশ দরকার। সাধারণ মানুষের-শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, সাধনা ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, নতুন রেনেসাঁসের চেতনার মধ্য দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা বিকশিত হতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।