ফেব্রুয়ারি মাসে ফুলের বাণিজ্য

ফুল নিয়ে জানা-অজানা অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। আবার ফুল যে কত অমূল্য তা বোঝার জন্য প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত সেই ফুলের মূল্য ছোটগল্প অনেকেই পড়ে থাকবেন। আবার ফুলের গুরুত্ব বোঝাতে জোটে যদি একটি পয়সা খাবার কিনিও ক্ষুধার লাগি, জোটে যদি দুটি পয়সা ফুল কিনে নিও হে অনুরাগী-এ রকম অনেক মজার মজার উক্তি প্রচলিত আছে। যে ফুল ভালোবাসে না এবং যে ফুল পছন্দ করে না তাকে ভালোবাসা যায় না, সে মানুষ খুন করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, ফুল ভালোবাসে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। বাংলাদশে ফেব্রুয়ারি মাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানের জন্য ফুল একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ দেখা দেয়।
ফেব্রুয়ারির সেই অনুষ্ঠানগুলো হলো ১৩ ফেব্রুয়ারিতে ১ ফাগুনে বসন্তবরণ, আবার একই দিনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের জন্য বিদ্যার দেবী-খ্যাত সরস্বতী পূজা উদযাপন। তার একদিন পরেই অর্থাৎ ১৪ ফেব্রুয়ারিতে উদযাপিত হয় ভ্যালেনটাইনস ডে অর্থাৎ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। আবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে (৮ ফাল্গুন) পালিত হয় ভাষাশহীদ দিবস যা এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রতিটি দিবস পালনের জন্য অন্যতম অনুষঙ্গীয় উপাদান হলো ফুল। ফুল ছাড়া এখন এসব অনুষ্ঠান উদযাপন করার কোনো অর্থই হয় না। তা ছাড়া ফেব্রুয়ারি মাসটি ভাষার মাস হওয়ার কারণে এমনিতেই পুরো মাসজুড়েই বাংলা একাডেমি চত্বরে উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় বইমেলা চলমান থাকে।
সে জন্য ভাষার মাসকে ঘিরে সারা মাসেই কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো অনুষ্ঠানাদি লেগেই থাকে। যেমন কোনো স্থানে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানসহ অন্যান্য সামাজিক কর্মকাণ্ড, অফিসে বিদায় ও শুভেচ্ছার অনুষ্ঠান, নবীনবরণ, স্টেজ সাজানো, গাড়ি-বাড়ি সাজানো, রাজনৈতিক মঞ্চ সেসব প্রতিটি অনুষ্ঠানের জন্য প্রচুর ফুলের প্রয়োজন হয়। সেই প্রয়োজনকে সামনে নিয়েই সারা বছরের তুলনায় এ সময় ফুলের ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি বিরাট অংশ সংঘটিত হয়ে থাকে। সারা বছরই কোনো না কোনো ফুল উৎপাদন হয়ে থাকে। কিন্তু মৌসুমি ফুলের মৌসুম হলো নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সময়কাল। রজনীগন্ধা, গোলাপ, জারবেরা, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জিপসি, রডস্টিক, কেলেনডোলা, চন্দ্রমল্লিকাসহ প্রায় ১১ ধরনের ফুল এ সময়ে সারা দেশের মানুষের ভালোবাসার মন জোগাচ্ছে। এসব ফুল সারা দেশেই কমবেশি উৎপন্ন হয়ে থাকে। তবে বাণিজ্যিকভাবে সবচেয়ে বেশি ফুল উৎপন্ন হয় যশোরে। সেখানকার ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ও পানিসারা ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে হাজারো কৃষক এ ফুল উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
ফুলের রাজ্যে গদখালীকে ফুলের সাম্রাজ্য বলা হয়ে থাকে। কারণ এবার দেশের রাজনৈতিক ও যোগাযোগ পরিস্থিতি ভালো থাকার কারণে বসন্ত উৎসব ও ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে মাত্র দুদিনে শুধু গদখালীতেই ১২ কোটি টাকার ফুলের বাণিজ্য হয়েছে। আবার একুশে ফেব্রুয়ারিতে আরো পাঁচ কোটি টাকার বাণিজ্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সারা দেশের ফুল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবদুর রহিম ও সাধারণ সম্পাদক বাবুল প্রসাদ। এ বছর অন্যান্য সময়ের তুলনায় ফুলের অনেক বেশি মূল্য ধরা হয়েছে। প্রতি হাজার গাঁদা ফুল ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, প্রতি পিস গোলাপ ১০-১৫ টাকা, প্রতি পিস গ্লাডিওলাস ১২-১৫ টাকায় পাইকারি হিসেবে বিক্রি হয়েছে।
উৎপাদিত ফুলের উপযুক্ত দাম পেয়ে সেখানকার কৃষকরাও যারপরনাই খুশি। চট্টগ্রামেও একই সময়ে আরো দেড় কোটি টাকার ফুলের বাণিজ্য হয়েছে বলে জানা গেছে সেখানকার ফুল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নাসের গনি চৌধুরীর মারফতে। সেখানেও ঢাকা, যশোর এমনকি চীন, সিঙ্গাপুর, ভারত, ব্যাংকক প্রভৃতি দেশ থেকে ফুল আমদানির খবর পাওয়া গেছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-চায়না রোজ, মাম, কার্নেশেন, জারবেরা, হোয়াইট রোজ, ইয়েলো রোজসহ আরো অনেক ধরনের ফুল। চট্টগ্রামে স্থানীয়ভাবে কিছু পাহাড়ি এলাকা যেমন- চকরিয়া, দেহাজারি, চন্দনাইশ, হাটহাজারী ও নাজিরহাট এলাকায় সামান্য কিছু ফুলের চাষ হয়ে থাকে যার দ্বারা সেখানকার পুরো চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয় না। সে কারণে দেশের অন্যান্য জায়গা থেকে চট্টগ্রামে দ্বিগুণ-তিনগুণ দামে ফুল বিক্রির খবর পাওয়া গেছে। এবারে চট্টগ্রামে পাইকারি ও খুচরা মিলে প্রায় ২৭০টির মতো ফুলের দোকান বসেছিল। দেশের সবচেয়ে বড় ফুলের বাজার ঢাকার শাহবাগ, ফার্মগেট, আগারগাঁও, মিরপুর এলাকায়। সেখানেও পাইকারি ও খুচরা মিলে প্রায় তিন শতাধিক ফুলের দোকান বসে থাকে। সারা দেশের প্রতি জেলা-উপজেলার জন্য প্রয়োজনীয় ফুল সেসব পাইকারি বাজার হতেই সংগৃহীত হয়ে থাকে।
ফুলের প্রতি মানুষের আসক্তির কারণে এবং একবারে চাহিদা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে ভালোবাসা দিবসের প্রথম প্রহরে একেকটি গোলাপের দাম ২০০ টাকা পর্যন্ত হাঁকা হয়েছে। তবে এবারে উৎপাদনকারী হিসেবে কৃষক এবং ফুলের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা সবাই দামের জন্য খুশি। কারণ বিগত দু-তিন বছর যাবৎ দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য ফুলে তেমন ব্যবসা করতে পারেনি তারা। সারা দেশের প্রায় পাঁচ লাখ লোক সরাসরি এ ফুল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হয়ে খেটে খাচ্ছে। যেহেতু দেখা যায়, ফুলপ্রেমীদের কাছে প্রতিনিয়তই ফুলের কদর বাড়ছে, সে জন্য এর চাহিদা দিনদিন বাড়তে থাকবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এখন যেহেতু অল্পদিনের ব্যবধানে প্রায় ১৮-২০ কোটি টাকার ফুলের ব্যবসা হতে দেখা যাচ্ছে, সে জন্য এ খাতে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। একটু উদ্যোগ নিলেই সম্ভাবনা এ খাতে কৃষকদের আরো বেশি আগ্রহী করা যেতে পারে। কারণ কৃষিতাত্ত্বিকভাবে শুধু যে যশোর কিংবা চট্টগ্রামই ফুল চাষের জন্য উপযোগী তা নয়। সারা দেশের যেকোনো উঁচু জমিতেই এসব ফুলের চাষাবাদ হতে পারে।
এর আগে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে অর্কিড-জাতীয় ফুলের চাষ হয়ে সেখান থেকে আবার বিদেশে রপ্তানিও করা হচ্ছে। কাজেই কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বাণিজ্যিকভাবে এর আবাদ সম্প্রসারণের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে আমাদের দেশে। ফুল সৃজনশীল। কাজেই এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সবাই সৃজনশীল কাজ করে মানুষের মনের খোরাক জুগিয়ে থাকেন। সে জন্য তাঁদেরও নিশ্চয়ই সঠিকভাবে তাদের উৎপাদিত এ ভালোবাসার পরশের পণ্যটির সঠিক ও উপযুক্ত মূল্য পাওয়া উচিত। আবার এটাও ঠিক যে, ফুলের মূল্য আসলে টাকার অঙ্কে হিসাব করা যায় না। কাজেই ফুলের প্রয়োজনের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে এ অমূল্য সম্পদ ফুলকে মূল্যবান সম্পদে পরিণত করে দেশের অর্থনীতির চাকাকে আরো সচল করতে হবে।
লেখক : কৃষিবিদ ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়