অভিমত
রাকিব-রাজনের রায় ও এমপি লিটনের জামিন

সিলেট ও খুলনার দুই শিশু হত্যা মামলার রায়ে আদালত যেদিন অপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন, সেদিনই গাইবান্ধায় আরেক শিশুকে গুলি করার মামলায় জামিনে বের হয়ে গেছেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন।
টেলিভিশনের খবরে দেখা গেছে, গাইবান্ধা কারাগার থেকে বের হওয়ার পর ফুলের মালা দিয়ে এমপি লিটনকে বরণ করে নেওয়া হচ্ছে। সংসদ অধিবেশনে যোগদানের অজুহাতে তিনি জামিনের আবেদন করেন। আদালত তা মঞ্জুর করেন এবং ৮ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া সংসদের অষ্টম অধিবেশন চলাকালীন জামিন বহাল থাকবে বলে আদেশ দেন। ২৩ নভেম্বর পর পর্যন্ত অধিবেশন চলার কথা রয়েছে।
সিলেটের শিশু রাজন এবং খুলনার শিশু রাকিব হত্যা মামলায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে যে রায় দেওয়া হয়েছে, তাতে খুশি দুই পরিবার, স্থানীয় জনগণ এবং সারা দেশের আপামর জনসাধারণ। সংশ্লিষ্ট আইনজীবী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলেছেন, দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখবে এ দুটি রায়।
বিচারে নানা কারণেই দীর্ঘসূত্রতা হয়। এর প্রধান কারণ বিচারক সংকট। এই সংকটের কারণে দেশের আদালতগুলোয় মামলার জট লেগে আছে। জট ছাড়াতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি, গ্রাম আদালত কার্যকর করা এবং বিচারকদের অতিরিক্ত কাজ করার মতো উদ্যোগও আছে। তারপরও বছরের পর বছর ধরে সৃষ্ট এই জট কতটা খুলেছে, তা নিয়ে সংশয় আছে।
মামলার দীর্ঘসূত্রতার একটি বড় কারণ রাজনীতি। কেননা রাজনৈতিক মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হয় না। বিশেষ করে নাশকতার মামলোগুলো, যেখানে সংখ্যায় অনেক বেশি এবং রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আসামি করা হয়, সেসব মামলার চার্জশিট বা অভিযোগপত্রও দিতে বিলম্ব হয়। আবার রাজনৈতিক মামলার একটি বড় অংশই যেহেতু হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং বিরোধীপক্ষকে ফাঁসানোই যখন ক্ষমতাসীনদের মূল লক্ষ্য হয়, তখন এসব মামলায় বছরের পর বছর আসামিরা আদালতে হাজিরা দিতে থাকেন। আবার বাদি ও আসামি- উভয়পক্ষই বারবার সময় আবেদন জানায়। ফলে দেখা যায়, কোনো পক্ষই চায় না এসব মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হোক।
ডেইলি স্টারের খবরে বলা হয়েছে,দেশে বিচারকের অভাবেই প্রতিদিন এক হাজার ৫১টি মামলা জমা হচ্ছে। একই কারণে প্রতি বছর নতুন করে তিন লাখ ৮৪ হাজার মামলা ঝুলে যাচ্ছে নিষ্পত্তি না হয়ে।
আর কালের কণ্ঠের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশের আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি। সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালে যখন বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করা হয় তখন সারাদেশের আদালতগুলোয় ১৫ লাখ মামলা বিচারাধীন ছিল। মাত্র সাড়ে সাত বছরে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮ লাখের বেশি। এই হারে মামলা বাড়তে থাকলে বিচার বিভাগের পক্ষে এসব মামলা নিষ্পত্তি করতে হিমশিম খেতে হবে।
এ রকম বাস্তবতার মধ্যেও দেখা গেল, খুলনায় শিশু রাকিবকে হত্যার মাত্র তিন মাসের মাথায় মামলার রায় দিয়েছেন আদালত। যেখানে কার্যদিবস ছিল মাত্র ১১টি। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো চাঞ্চল্যকর মামলায় এত দ্রুত রায় দেওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম। সেইসাথে সিলেটের শিশু শেখ সামিউল আলম রাজন হত্যারও চার মাসের মাথায়,মামলার রায় দিয়েছেন আদালত। এই মামলায় কার্যদিবস ছিল মাত্র ১৯টি।
তাই সবশেষে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্যকেই উদ্ধৃত করে বলা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম,বিশেষ করে ফেসবুকের যে শক্তি, তারই বহিঃপ্রকাশ রাজন রাকিব হত্যা মামলার দ্রুত বিচার। কেননা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ দুটি নৃশংস ঘটনার বিষয়ে জনরোষ ছিল বলেই সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো অন্যান্য মামলার তুলনায় বেশি তৎপর ছিল। পুলিশের ওপরও হয়তো চাপ ছিল মামলা দুটির দ্রুত চার্জশিট দেওয়ার ব্যাপারে। তা ছাড়া সরকার চাইলে রাজন হত্যা মামলার প্রধান আসামি কামরুলকে সৌদি আরব থেকে ফেরত আনার ব্যাপারেও গড়িমসি বা বিলম্ব করতে পারত। কিন্তু তারা তা করেনি। বরং আমরা যদ্দুর জানি, স্বয়ং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের ব্যক্তিগত উদ্যোগে কামরুলকে দ্রুততম সময়ে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এখানেও পরোক্ষভাবে জনমতই কাজ করেছে।
একইভাবে গাইবান্ধার শিশু সৌরভকে গুলি করার পরও এ নিয়ে ফেসবুকে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে,বলা যায় যে তারই বহিঃপ্রকাশ ছিল গণমাধ্যমে অব্যাহত প্রতিবেদন এবং এক পর্যায়ে এমপি লিটন আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। কেননা দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যখন শক্তিশালী ছিল না, তখন ক্ষমতাবানরা এর চেয়ে বড় অপরাধ করেও আত্মসমর্পণ করেননি। কিন্তু এখন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
সর্বোপরী কথা হলো, জনমতের চাপ কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের শক্তি- যাই বলা হোক না কেন,আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বেশি জরুরি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতা। রাকিব রাজনের মামলায় দ্রুত বিচারে আমরা যে ধরনের আন্তরিকতা দেখেছি, শিশু সৌরভকে গুলি করার মামলায় বিচার সংশ্লিষ্ট এবং সরকারের সেই আন্তরিকতা দেখা যাবে কি না, এই মামলাটিও দ্রুত নিষ্পত্তি হবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে।
তবে রাজন ও রাকিব হত্যা মামলার দ্রুত বিচার যে দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করল, তা এখন দেশের চাঞ্চল্যকর অন্যান্য মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির ক্ষেত্রেও উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
লেখক : যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ও উপস্থাপক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।