ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
সংশয়ের নতুন মাত্রা

তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ নম্বর ধারা বাতিল হয়েছে বলে আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই। দুই বছর আগেই এনটিভি অনলাইনে (কী থাকছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে? এনটিভি অনলাইন, ২৬ জানুয়ারি, ২০১৬) লিখেছিলাম, জনদাবির মুখে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল হলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামে এমন একটি আইন আসছে, যেখানে এই ৫৭ ধারার মতো বা এর চেয়েও ভয়াবহ বিধান থাকবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রথম খসড়াটি আমার হাতে আসে ২০১৬ সালের মধ্য জানুয়ারিতে। তখন এটি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পড়ার পরে এই বিল তৈরির সঙ্গে যুক্ত সরকারের একটি সিনিয়র কর্মকর্তাকে বলেছিলাম, ‘আপনারা তো নতুন বোতলে সেই পুরোনো মদই রাখছেন।’ তিনি আমার সঙ্গে একমত না হয়ে বলেছিলেন, ‘৫৭ ধারা নিয়ে যে ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অন্তত সেই আতঙ্ক দূর করবে।’ কিন্তু বিস্ময়করভাবে লক্ষ করছি, সোমবার মন্ত্রিসভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, সেখানে এমন একটি বিধান রাখা হয়েছে, যেটি প্রথম দফার তিনটি খসড়ায় ছিল না। নতুন এই খসড়ার ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সরকারি, আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে ঢুকে কেউ কোনো কিছু রেকর্ড করলে, তা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে।’ এর জন্য ১৪ বছরের জেল এবং ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
ফলে মন্ত্রিসভায় বিলটি অনুমোদিত হওয়ার পর এ নিয়ে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষ যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন, তাতে মনে হচ্ছে তারা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার চেয়েও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা নিয়ে আরো বেশি উদ্বিগ্ন। অনেকেই মনে করেন, এ ধারার প্রয়োগের ফলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা একটি বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে। কারণ, অনুসন্ধানী বা অপরাধমূলক সাংবাদিকতার একটা বড় শক্তিই হলো গোপনীয় জিনিস। সাংবাদিকরা নানাভাবেই গোপন জিনিস অনুসন্ধান করে বের করেন। কিন্তু এখন যদি ৩২ ধারার ফলে সাংবাদিকদের মধ্যে ভীতি তৈরি হয়, তখন সরকারি-আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা এবং বেআইনি কাজের সুযোগ বাড়বে।
প্রসঙ্গত, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে আইনের যে তৃতীয় খসড়াটি দেওয়া আছে, সেখানে এই বিধান নেই। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্ম সচিব আমাকে বলেছেন, তারা আইনের যে খসড়া করে দিয়েছিলেন, কেবিনেট তার অনেক জায়গায় পরিবর্তন করেছে।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, ‘সংসদ সদস্যদের মান-ইজ্জত রক্ষা করতেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকরা গণমাধ্যমে যেভাবে বিভিন্ন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করেন, তাতে তাঁদের মান-ইজ্জত থাকে না। তাঁদের সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়। তাঁরা তো জনপ্রতিনিধি। তাই এগুলো ঠেকাতেই এ আইন করা হয়েছে।’
তোফায়েল আহমেদের কথায় এটি স্পষ্ট যে, সাধারণ মানুষ বা দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কিংবা বাকস্বাধীনতা কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়; বরং সংসদ সদস্যদের মান-ইজ্জতই এই আইনের মূল উদ্দেশ্য। এখন দেখা যাক, বিলটি যখন সংসদে উঠবে, তখন এর উদ্দেশ্যে কী লেখা থাকে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অবশ্য ৩২ ধারা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘যদি সাংবাদিকরা কোনো অবৈধ ঘটনা বা সত্য প্রকাশ করেন, তাহলে সেটি গুপ্তচরবৃত্তি বা অপরাধ হবে না। তার দাবি, এ আইনে কারো বাকস্বাধীনতা হরণ করা হয়নি, ফলে বাকস্বাধীনতা ক্ষুণ্ণও হবে না।
এখন কথা হচ্ছে, সত্যের মানদণ্ড কী? কোনটি সত্য অথবা সত্য নয়, কোনটি অনুসন্ধান আর কোনটি গুপ্তচরবৃত্তি, সেটি কে নির্ধারণ করবেন? ধরা যাক, একজন সরকারি কর্মকর্তার ঘুষ খাওয়া বা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের কোনো তথ্য কোনো সাংবাদিক অথবা কোনো একজন নাগরিক ইন্টারনেটে প্রকাশ করলেন, অভিযুক্ত সরকারি কর্মককর্তা কি কখনো তার অপরাধ স্বীকার করবেন বা তিনি যদি ভিডিও ধারণ ও প্রকাশকারীর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনেন, তাহলে এই আইনের আলোকে কি তার শাস্তি হবে?
আমাদের সব আইনের প্রধান দুর্বলতাই যেখানে ‘সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধের’ মার্জনা, অর্থাৎ কোনো অপরাধ এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যদি কোনো নাগরিককে গুলি করে মেরেও ফেলে, তারপরও তারা এটিকে সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধের কাতারে ফেলে পার পেয়ে যেতে পারে এবং এটি আইনসিদ্ধ। এ রকম একটি ভয়াবহ বাস্তবতায় প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এই ৩২ ধারা তাদের (সরকারি কর্মচারী) আরো বেশি বেপরোয়া এবং দুর্নীতিতে উৎসাহী করবে কি না, তা নিয়ে ভাবতে হবে।
তবে শুধু ৩২ ধারা নয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৯ ধারা নিয়েও উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা, অশ্লীল এবং যা মানুষের মনকে বিকৃত ও দূষিত করে, মর্যাদাহানি ঘটায় বা সামাজিকভাব হেয়প্রতিপন্ন করে; অথবা কেউ যদি স্বেচ্ছায় কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার উদ্দেশ্যে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পাঠ করলে বা দেখলে বা শুনলে তা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে, তাহলে তিনি অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন অথবা দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন।
অর্থাৎ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারার সঙ্গে নতুন আইনের এই ১৯ ধারায় খুব বেশি অমিল নেই। পার্থক্য হলো, ৫৭ ধারার তুলনায় ১৯ ধারায় শাস্তির পরিমাণ কম। ৫৭ ধারায় কেউ অপরাধ করলে তার অনধিক ১৪ বছর এবং অন্যূন সাত বছর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। পাশাপাশি এটি জামিন অযোগ্য। পক্ষান্তরে, নতুন আইনের ১৯ ধারায় কেউ অপরাধ করলেও সেটি জামিনযোগ্য।
প্রশ্ন উঠছে, তথ্যপ্রযুক্তি আইন বাতিল হলেও ৫৭ ধারায় দায়েরকৃত মামলাগুলোর কী হবে? মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাংবাদিকদের বলেছেন, যেহেতু ধারাটি থাকবে না, বিচারকের রায়ই এখানে চূড়ান্ত। তবে আদালতকে মনে করতে হবে, এ-সংক্রান্ত কোনো আইন নেই। তিনি যে রায় দেবেন, সেটাই চূড়ান্ত। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় বলা হয়েছিল, আইনটি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ধারা রহিত হবে এবং এই ধারাগুলোর অধীনে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা নতুন এই আইনের অধীনে নেওয়া হয়েছে বলে গণ্য হবে।
এটা ঠিক যে, আইনটি এখনই চূড়ান্ত নয়। এটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে মানেই যে কাল থেকে কার্যকর তা নয়; বরং এটি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মন্ত্রী এটি সংসদে উত্থাপন করবেন। এরপর স্পিকার অনুমতি দিলে এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটিতে যাবে। কমিটির সভাপতি বিলটি সংসদে রিপোর্ট আকারে পেশ করবেন। এরপর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী আবার এটি পাসের জন্য সংসদে তুলবেন। তখন এটির ওপরে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ পাবেন সংসদ সদস্যরা।
এমনকি সংসদ চাইলে বিলটি আটকেও যেতে পারে। যদিও তার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। কারণ, কোনো মন্ত্রী বিল উত্থাপনের পরে সেটি সংসদ সদস্যদের বাধার মুখে পাস হয়নি, এ রকম নজির আমাদের জাতীয় সংসদে নেই। কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা সব সময়ই বিলের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ বলেন এবং যত গুরুত্বপূর্ণ বিলই হোক, অধিকাংশ সময়ই সেটি কোনো ধরনের বিতর্ক ছাড়াই পাস হয়ে যায়। ঢাকা সিটি করপোরেশন দুই ভাগ করা সম্পর্কিত বিলটি পাস হয়েছিল মাত্র চার মিনিটে।
তারপরও আমরা আশা করতে পারি যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি নিয়ে সংসদ সদস্যরা বিতর্ক করবেন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাধারণ মানুষে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন, সেই জনমতগুলো আমলে নিয়ে তারা এরকম একটি গণবিরোধী বিধান যাতে পাস না হয়, সে বিষয়ে চেষ্টা করবেন। সংসদ চাইলে এই আইনটি উত্থাপনের পরে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। তাদের মতামত নিতে পারে।
আমীন আল রশীদ : লেখক ও সাংবাদিক।