অভিমত
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এমন আচরণ কেন?

বিশ্ববিদ্যালয় তো জ্ঞান অর্জনের জায়গা; তা যেকোনো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হোক না কেন। শিক্ষকরা যেভাবে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষা দেন, ঠিক তেমন বাইরেও। শিক্ষক সব সময় শিক্ষকই থাকেন। শিক্ষকের আচার-ব্যবহার শিক্ষার্থীদের জন্য অনুকরণীয়।
শিক্ষকদের দায়িত্ব স্কুলে যতটা, তার চেয়ে বেশি দায়বদ্ধ থাকতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। কারণ, তাঁদের সিদ্ধান্ত নিতে বেশি ভাবতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দিকনির্দেশনাই সারা জীবনের পাথেয় হয়ে থাকে শিক্ষার্থীদের কাছে। কেননা, এই সময়টায় সবকিছুই ধারণ করার মতো যুক্তি-বুদ্ধি সৃষ্টি হয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সমাজ থেকে যতটা শেখেন, তার চেয়েও বেশি শেখার কথা ছিল প্রতিষ্ঠান থেকে। কেননা, বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ সময় অবস্থান করেন একজন শিক্ষার্থী। যেখানে শ্রেণিকক্ষের বাইরে আবাসিক হলে কিংবা সংগঠনে শিক্ষকের সংস্পর্শ পান শিক্ষার্থীরা। তাই পাঁচ বা ছয় বছরের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে একজন শিক্ষার্থীর হয়ে ওঠার কথা ছিল ‘পূর্ণাঙ্গ মানুষ’। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ বোধ হয় সামগ্রিকভাবে সেই দায়িত্ব পালন করতে পারছে না।
গতকাল দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটি একটি উদাহরণ হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন করছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল, ছাত্র সংসদ তথা ডাকসু নির্বাচন দিয়ে তারপরই উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন করা হোক। তাই শিক্ষার্থীরা উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন।
শিক্ষার্থীরা ‘শান্তিপূর্ণ’ আন্দোলন করছিলেন। তাঁরা ধ্বংসাত্মক কোনো কর্মসূচি করেননি। শুধু তাঁরা চেয়েছেন, উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের আগে ডাকসু নির্বাচন দেওয়া হোক এবং সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধিদের অবস্থান নিশ্চিত করা হোক। কিন্তু শিক্ষকদের একটি অংশ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যে আচরণ করেছে, তা কখনই গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনের সামনে গতকাল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনার ছবি ও ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রগতি বর্মণ তমাকে বুকে জাপটে ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন সহকারী প্রক্টর মোহাম্মদ রবিউল ইসলাম। এ ঘটনা কারোরই কাম্য ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর সঙ্গে এমন আচরণ করে ওই শিক্ষক ফৌজদারি অপরাধ করেছেন। তিনি একজন ছাত্রী কিংবা ছাত্রের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারেন বলে মনে করি না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বা সহকারী প্রক্টর থাকেন শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও সম্মান রক্ষার জন্য। কিন্তু সেই শিক্ষকরাই যদি শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হোন, তাহলে তাঁদের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে! আমরা দেশের প্রথম শহীদ শিক্ষককে হয়তো চিনি। তিনি হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা, যিনি আন্দোলনরত ছাত্রদের বাঁচাতে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। আমরা সেই আত্মদান থেকে কোনো শিক্ষা নিতে পেরেছি কি!
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের এমন আচরণ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক শিক্ষার্থী বলছিলেন, ‘আমার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছিলাম, যেখানে ছাত্রীর সঙ্গে এমন আচরণ করা হয়! এই লজ্জা আমি রাখি কই।’ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কোনো অনুষ্ঠানে যাবেন না বলেও জানালেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট অধিবেশনে গতকাল উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ১০৫ সদস্যের সিনেটের অর্ধেকের মতো সদস্য ওই অধিবেশনে বসে ছিলেন। পরে নির্বাচন ছাড়াই উপাচার্য প্যানেল নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ সব সদস্যের উপস্থিতিতে উপাচার্য প্যানেল নির্ধারণ হওয়ার কথা ছিল।
ওই নির্বাচন প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে ফেসবুকে সাংবাদিক কামাল আহমেদ লিখেছেন, ‘দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কি নির্বাচনের নতুন মান নির্ধারণ করা হলো? ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন, শক্তিপ্রয়োগ সবই তো হলো। এটিকেই তাহলে আমাদের জাতীয় মান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে যাঁরা যাবেন, তাঁরা কমিশনের কাছে এই মডেলটি গ্রহণের সুপারিশ করতে পারেন।’
দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই এখন ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। তাহলে শিক্ষার্থীরা তাঁদের দাবি নিয়ে কথা বলবেন কার কাছে? তাঁদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করবেন কে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৯০ সালে সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন হয়েছে। এরপর একাধিক দাবি তোলা হলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এক ধরনের ‘ভয়ে’ তা বাস্তবায়ন করেনি। তাই শিক্ষার্থীরা নিজেদের দাবি আদায় নিয়ে কথা বলবেন, এটাই সংগত। কিন্তু শিক্ষার্থীদের সেই দাবিকে সমর্থন না করে উল্টো তাঁদের ওপর চড়াও হওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। এটা চলতে পারে না। শিক্ষকদের এমন আচরণ চলতে থাকলে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা-সম্মান কমতে থাকবে, যা কারো কামনা করা উচিত নয়। তাই দ্রুত এই অবস্থার নিরসন প্রয়োজন।
দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সঠিকভাবে বিদ্যাচর্চা হোক, সেই কামনা...।
লেখক : সাংবাদিক