হাইকোর্ট দেখা ও দেখানোর সংস্কৃতি

‘আপনি কথায় কথায় আমাকে হাইকোর্ট দেখাবেন না’— ঝগড়া বা তর্ক-বিতর্কের ফাঁকে ফাঁকে একজন আরেকজনকে ধমক বা বিদ্রূপের স্বরে উক্তিটি প্রায়ই করে থাকেন। তবে এটি কবে কোথা থেকে এসেছে তা আজও খুঁজে পাইনি। হাইকোর্টে প্রতিনিয়ত যাতায়াত করেন এমন অনেককে জিজ্ঞেস করেও এ সম্পর্কে জানতে পারিনি।
তবে পেশাগত কারণে হাইকোর্টে যাতায়াতের কারণে উক্তিটির মর্মার্থ বা বিষয়বস্তু উপলব্ধি করতে বেশি সময় লাগেনি। কেউ হাইকোর্ট দেখান আর না-ই দেখান, অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেকে নিয়মিত হাইকোর্ট দেখে থাকেন। হাইকোর্ট দর্শনার্থীদের তালিকা থেকে সাবেক রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সংসদ সদস্য, শীর্ষস্থানীয় আমলা, ডিসি-এসপি, ব্যবসায়ী-শিল্পপতি থেকে শুরু করে নেতা-পাতি নেতা কেউই বাদ যান না।
আবার দেখেছি শীর্ষ সন্ত্রাসী সুইডেন আসলাম, এরশাদ শিকদার, মুরগি মিলন, হাতকাটা সেলিম, কুত্তামারা মিজান ইত্যাদি থেকে শুরু করে ছিঁচকে চোরকেও। এদের পদচারণে একেক সময় হাইকোর্ট মুখরিত হয়ে ওঠে। সংবাদকর্মীরা দৌড়ে দৌড়ে আদালতে গিয়ে তাদের পক্ষে-বিপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তি-পাল্টা যুক্তি ও সওয়াল-জওয়াব নোট করেন। দৃশ্যগুলো সত্যিকার অর্থেই উপভোগ্য।
হাইকোর্টে ‘মাই লর্ড’, ‘লার্নেড’ এমন আরো কিছু পরিভাষা বহুল প্রচলিত। ইংরেজি এ শব্দ দুটির ওজন ও গুরুত্ব অনেক। একজন আসামি তিনি যত ক্ষমতাবানই হোন কিংবা যত ভয়ঙ্করই হোন অথবা যত সাহসীই হোন না কেন, আদালতে ঠিকই তাকে মাথা নত করে প্রবেশ করতে হয়। এজলাস বা আদালত কক্ষে ঢুকতে গেলে এমনিতেই মাথা নত হয়ে আসে। এটি একটি ‘পারসেপশন’-এর বিষয়। একজন আসামি বা সাক্ষীকে একের পর এক অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করতে করতে একপর্যায়ে তাকে হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে আসল ঘটনার সামনে হাজির করেন আইনজীবীরা। একজন আইনজীবী তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি ঢেলে দিয়ে গোটা এজলাসকে চমৎকারভাবে ১০-২০ এমনকি ৪০ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাস্থলে নিয়ে যান। চোখের সামনে তখন ঘটনাস্থলটি ভাসতে থাকে। আইনজীবীর ক্যারিশমাটিক উপস্থাপনায় একপর্যায়ে মনে হয় যেন ঘটনাটি আমার চোখের সামনে এখনই ঘটছে।
২.
২০০০ সালের দিকে বিএনপি নেতা মোরশেদ খানের বিরুদ্ধে জননিরাপত্তা আইনে চট্টগ্রামে একটা মামলা হয়। অভিযোগ, রমজান মাসে ইফতারির আগে তিনি এক কেজি জিলাপি ও এক বাটি হালিম কিনে দোকানদারকে টাকা দেননি। উল্টো দোকানদারকে মারধর করেছেন। বেচারা মোরশেদ খান কয়েকদিন পলাতক থাকার পর ওই সময় দেশের শীর্ষ আইনজীবী ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক আহমেদ, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদসহ বেশ কয়েকজন আইনজীবী নিয়ে হাইকোর্টে আত্মসমর্পণ করে আগাম জামিন আবেদন করেন। টানা তিনদিন শুনানির পর আদালত তাঁর জামিন দেন এবং আইনটি বাতিলের বিষয়ে রুল জারি করেন। পরবর্তীকালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর বিরুদ্ধে কাপ-পিরিচ চুরির মামলা করে। এ মামলায়ও তিনি হাইকোর্টে আত্মসমর্পণ করে জামিন লাভ করেন।
এই দুটি মামলার শুনানি থেকে কিছুটা বুঝতে পারলাম, যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁরা ‘হাইকোর্ট’ দেখান। আর যাঁরা ক্ষমতার বাইরে থাকেন, তাঁরা নিয়মিত হাইকোর্ট দেখে থাকেন। তবে ওয়ান ইলেভেনখ্যাত মইন-ফখরুদ্দীনের সরকারের সময় সব দলের নেতাদেরই একযোগে হাইকোর্ট পরিদর্শনে যেতে হয়েছে। দেশের শীর্ষ দুই নেত্রীসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দলের অধিকাংশ নেতাই বন্দি হয়েছেন। নিম্ন আদালত তাঁদের জামিন আবেদন মঞ্জুর করা দূরে থাক, আবেদন গ্রহণ করারই সাহস পাননি। শেষ পর্যন্ত হাইকোর্ট থেকেই তাঁরা জামিন পেয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়েছেন।
৩.
নেতানেত্রী আর আম-পাবলিকের ‘হাইকোর্ট দর্শনের’ পর এবার দেশের আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ নিজেরাই একে অপরকে ‘হাইকোর্ট দেখানো’র কাজটি শুরু করেন। হাইকোর্টের আলোচিত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক নির্বাহী বিভাগের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বেশ কিছু রায় দিয়ে দেশে রীতিমতো হুলুস্থুল ফেলে দিয়েছিলেন। তাঁকে নিয়েই মূলত জাতীয় সংসদে হাইকোর্ট নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত। বিচারপতি মানিককে ‘স্যাডিস্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁকে অবিলম্বে অপসারণের জন্য সংসদে সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস হয়। এ প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি মানিককে অপসারণের জন্য রুলিং দেন স্পিকার; এবং তা কার্যকর করার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। এ রুলিং এখনো আইন মন্ত্রণালয়ে নথিজাত অবস্থায় রয়েছে।
সংসদের রুলিং ও তীব্র আক্রমণের মুখে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকও গোটা সংসদের এ-সংক্রান্ত কার্যক্রমের বিরুদ্ধে স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি করে ফের আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ‘রুলিং’ আর ‘রুল’-এর পাল্টাপাল্টিতে শেষ পর্যন্ত জাতীয় সংসদ সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী এনে বিচারপতিদের অপসারণের এখতিয়ার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাত থেকে সংসদের হাতে নিয়ে বিচার বিভাগকে ‘হাইকোর্ট’ দেখিয়ে দেয়। ষোড়শ সংশোধনীকে সংবিধান পরিপন্থী ও ৭২-এর মূল সংবিধানের চেতনা পরিপন্থী ঘোষণা করে হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয়। হাইকোর্ট রুল জারি শেষে এ সংশোধনীকে বাতিল ও বেআইনি ঘোষণা করেন। সরকারও হাইকোর্টের এ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করে। আপিল বিভাগও সর্বনম্মতভাবে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন।
উচ্চ আদালতের এ সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘উচ্চ আদালত সামরিক সরকারের আমলের সিদ্ধান্ত আপহোল্ড করেছেন। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পরই সরকার এ নিয়ে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবে।’
৪.
আমার নিজের একটু হাইকোর্ট দর্শনের অভিজ্ঞতাও রয়েছে। আমার দূরসম্পর্কের একজন আত্মীয় হাইকোর্টের অনেক বড় মাপের আইনজীবী। এটা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি। রিপোর্টিংয়ের সুবাদে আদালতে যাওয়ার কিছুদিন পর একবার তাঁর চেম্বার খুঁজে বের করলাম। সালাম দিয়ে চেম্বারে প্রবেশ করতে চাইলে তিনি এগিয়ে এসে দরজার কাছ থেকে অভ্যর্থনা জানিয়ে চেয়ারে বসালেন। সহকারীকে চা-বিস্কুট দিতে বললেন। বললাম, স্যার আমি চা-বিস্কুট কিছুই খাব না। মাত্র খেয়ে এসেছি। তিনি বেশ হাসিমুখেই বললেন, তো আছেন কেমন? কী মামলা নিয়ে এসেছেন? বললাম, আমি আসলে মামলা নিয়ে আসিনি। বাবার পরিচয় দিয়ে বললাম, আমি আপনার অমুক আত্মীয়ের ছেলে। এমনিতেই দেখা করতে এসেছি। কথাটা তিনি শুনছেন বলে মনে হয়নি। চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে রীতিমতো ঘুম। বুঝলাম, মক্কেল না হওয়ায় তিনি বিরক্তই হয়েছেন। তবু তাঁর সহকারীকে বললাম, ‘স্যার মনে হয় অনেক দিন ঘুমাননি।’ বলেই বিদায়।
লেখক : সাংবাদিক