ইতিহাস
লালবাগের দেয়াল ও দুর্গের ইতিকথা

ইতিহাস ও ঐতিহ্য চর্চায় আমরা অতটা সচেতন নই। তবে ঐতিহ্য রক্ষায় আমাদের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে। সম্প্রতি লালবাগ দুর্গের উত্তর-পূর্বদিকের দেয়াল ভেঙে গাড়ি পার্কিংয়ের আয়োজন করেছিল সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। এতে বিক্ষুব্ধ হয় ঐতিহ্য সচেতন মানুষ ও পরিবেশবাদী কয়েকটি সংগঠন। এমন সচেতনতা আমাদের আশাবাদী করে তোলে। এই ঘটনায় আদালতে রিটও হয়। মহামান্য আদালত গাড়িপার্কিংয়ের কার্যক্রম বন্ধ করার আদেশ দেন। সেই মতো আদেশ কার্যকর হয়। সম্ভবত ভাঙা দেয়াল পুনর্নির্মাণের ব্যবস্থাও করে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে আমার মনে হয়েছে আমাদের সব পক্ষের ঐতিহ্য সচেতনতা প্রকাশের পাশাপাশি আরো একটু ইতিহাস স্পষ্ট করে নেওয়া জরুরি। এরপর প্রয়োজন প্রত্নস্থল সংরক্ষণ আইন আরেকটু ভালোভাবে অনুধাবন করা। আজ এই লেখায় শুধু লালবাগ দুর্গের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি ফেরাব।
বাংলাদেশে মোগল পর্বে দুই ধরনের দুর্গ তৈরি হয়েছে। একটি জলদুর্গ আর অন্যটি প্রাসাদ দুর্গ। জলদুর্গ নিয়ে ‘ইতিহাসের খেরোখাতায়’ এর আগে আলোচনা করা হয়েছে। প্রাসাদ দুর্গ রয়েছে দুটো। বুড়িগঙ্গার দুই পাড়ে দুই দুর্গের অবস্থান।
একটি লালবাগ দুর্গ আর অন্যটি জিঞ্জিরা দুর্গ। লালবাগ দুর্গ মোগল সুবেদারি শাসন যুগেই আজকের পুরান ঢাকার লালবাগে নির্মাণ করা হয়। আর জিঞ্জিরা দুর্গটি নির্মিত হয় মুর্শিদাবাদের নবাবদের সময়।
ভারত সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনকালে নির্মিত হয়েছিল বলে সম্রাটের নামে দুর্গটির নামকরণ করা হয়েছিল আওরঙ্গাবাদ দুর্গ। তবে নামটি জনপ্রিয়তা পায়নি। স্থান নামকে ধারণ করে লালবাগ দুর্গ নামেই মানুষের মুখে মুখে তা প্রচারিত হয়। মোগল পর্বে বাংলাদেশ আড়াইশ বছরের স্বাধীনতা হারিয়ে দিল্লি নিয়ন্ত্রিত প্রদেশের মর্যাদা পেয়েছিল। মোগল আমলের বাংলা সম্রাটদের চোখে যে অতিরিক্ত গুরুত্ব পায়নি তা লালবাগ দুর্গের দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়। দিল্লির লাল কেল্লা বা আগ্রা দুর্গের সাথে তুলনা করলে লালবাগ দুর্গকে নিতান্ত দীনহীন মনে হবে। এটি একটি অসম্পূর্ণ দুর্গ। দুর্গের দক্ষিণ-পশ্চিমে বয়ে চলা বুড়িগঙ্গা নদী একসময় দুর্গ দেয়ালের গা ঘেঁষে প্রবাহিত হতো। এখন নদী অনেকটা সরে গেছে। লালবাগ দুর্গটি আয়তাকার আকৃতির। পূর্ব-পশ্চিমে এর বিস্তার।
লালবাগ দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে। এ সময় সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহজাদা আজম বাংলার সুবাদার ছিলেন। এ বছরেই সম্রাট শাহজাদাকে দিল্লিতে ডেকে পাঠালে তিনি দুর্গ নির্মাণ অসমাপ্ত রেখেই বাংলা ছাড়েন। নতুন সুবাদার শায়েস্তা খান ঢাকায় আসেন ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে। তিনি এবার দুর্গ নির্মাণ সমাপ্ত করার দায়িত্ব নেন। কিন্তু এ সময়ের একটি ঘটনা শায়েস্তা খানের মনে পরিবর্তন এনে দেয়। তাঁর আদরের কন্যা বিবি পরী এই দুর্গের ভেতরেই মারা যান। অত্যন্ত ভেঙে পড়েন শায়েস্তা খান। তাঁর কাছে মনে হয় দুর্গটিই অপয়া। তাই বন্ধ করে দিলেন দুর্গ নির্মাণের কাজ। এভাবে অসমাপ্ত রয়ে গেল লালবাগ দুর্গ নির্মাণ।
এরমধ্যে দুর্গের ভেতর বেশ কয়েকটি ইমারত নির্মিত হয়েছে। যে কটি ইমারত আমাদের সামনে দৃশ্যমান তার বাইরেও আরো কয়েকটি ইমারত হয়তো প্রথম দিকে নির্মাণ করা হয়েছিল। যা পরে ধ্বংস হয়ে গেছে। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করতে গিয়ে ১৮ একরের দুর্গ সীমার মধ্যে বেশ কয়েকটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ইমারত পেয়েছে। এ ছাড়া পাওয়া গেছে ড্রেনেজ সিস্টেম, পানি সরবরাহের ব্যবস্থা, ছাদে তৈরি বাগানের নমুনা।
লালবাগ দুর্গে টিকে থাকা ইমারতের মধ্যে রয়েছে মসজিদ, পরী বিবি পরীর সমাধিসৌধ, হাম্মাম বা দরবার ঘর এবং সম্ভবত একটি প্রশাসনিক ভবন। সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় যে এই প্রাসাদ দুর্গের ভেতর কোনো প্রাসাদ নেই। সুবাদাররা তাঁদের বসবাসের জন্য কোনো প্রাসাদ তৈরি করেননি দুর্গের ভেতর। মোগল প্রাসাদ দুর্গে সাধারণত এমন অসঙ্গতি থাকে না। পরাধীন ঢাকার প্রতি কেন্দ্রীয় শাসকদের যে তেমন দৃষ্টি ছিল না এটি তার অন্যতম প্রমাণ। সুবাদাররাও এই বন্যা বৃষ্টির দেশে বেশি দিন থাকতে চাননি। বদলি হয়ে চলে যাওয়ার ইচ্ছেটাই ছিল প্রবল। তাই হয়তো প্রাসাদ নির্মাণের ব্যাপারে তাঁদের কৌতূহল ছিল না। সুবাদারদের কেউ ছোট কাটরায়, কেউ দুর্গের ভেতর তাবু খাটিয়ে আবার কেউ বুড়িগঙ্গায় বজরার মধ্যেই বসবাস করে শাসনকাল কাটিয়ে দিয়েছেন।
লালবাগ দুর্গে তিনটি প্রবেশ পথ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি হচ্ছে দক্ষিণ দিকে। এটি দ্বিতল ভবনের মতো। উপরে মিনারের মতো রয়েছে। এক সময় চারকোণে এ রকম চারটি মিনার ছিল। সবচেয়ে ছোট প্রবেশ পথটি রয়েছে উত্তর-পূর্ব দিকে। এটি অনেকটা সাদামাটাভাবে তৈরি। উত্তর দিকে সীমানা প্রচীরের মাঝামাঝি রয়েছে তৃতীয় তোরণটি। এটি সম্পূর্ণ করে যাননি শায়েস্তা খান। এ যুগের নির্মাণ শিল্পীরা তা সম্পন্ন করেন।
প্রত্নতাত্ত্বিক খননে স্পষ্ট হয়েছে মোগল সুবাদাররা দুর্গ বানানোর আগেও সুলতানি বা প্রাচীন বাংলার সেন শাসন যুগে এখানে মানব বসতি ছিল। কারণ দুর্গের ভেতরে মটির নিচে অন্তরীণ থাকা প্রাচীন ইট, পোড়ামাটির নানা দ্রব্যসামগ্রী উন্মোচিত হয়েছে।
পুরান ঢাকার যে অংশটিতে লালবাগ দুর্গ অবস্থিত প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্রে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গেছে এখানে প্রাচীন কাল থেকেই মানব বসতি গড়ে উঠেছিল। আর বর্তমান পুরান ঢাকার অনেকটা এলাকাজুড়েই নাগরিক জীবনের বিকাশ ঘটেছিল সে যুগে। প্রত্নতাত্ত্বিক সূত্র পাওয়া এবং এর আলোকে বিশ্লেষণ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে মাত্র দুই দশক থেকে। তাই এর আগের অসমর্থিত সূত্রের আলোকে আমাদের ইতিহাস গ্রন্থগুলোতে যে ধারণা দেওয়া হয়েছিল তার অনেকটাই এখন সংশোধিত হচ্ছে। ইতিহাস পুনর্গঠনের সাথে যাঁরা যুক্ত হতে পারেননি তাঁরা এখনো পুরান পাঠ থেকেই মনে করছেন মোগলরাই ঢাকা নগরীর নির্মাতা। এই শহরের নানা স্থাপনা মোগল যুগেই নির্মিত হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় এক সময় লালবাগ দুর্গ নির্মিত হয়। ইতিহাসের এই অস্পষ্টতা থেকে এখন একটু একটু বেরিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে। মোগল-পূর্ব যুগে সুলতানি শাসন আমলে পনের শতকে ঢাকায় নাগরিক জীবন প্রতিষ্ঠার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। আফগান শাসনকালে এবং বারোভুঁইয়াদের সময়ও ঢাকা গুরুত্বপূর্ণ নগর ছিল। মোগল সেনাপতি মির্জা নাথানের বাহারিস্তান-ই-গায়বি গ্রন্থে লেখকের চাক্ষুস বিবরণীতে বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় ঢাকা দুর্গ নামে একটি দুর্গ থাকার কথা বলা হয়েছে। ১৯৮৭ সালের গোড়ার দিকে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর লালবাগ দুর্গে পানি ব্যবস্থাপনার প্রকৃতি নির্ণয়ের জন্য উঁচু ঢিবির পশ্চিম-উত্তর কোণে উৎখনন করেছিল। এ সময় সেখানে মোগল নিদর্শনের নিচের স্তর থেকে প্রাচীন ইট, কয়েকটি পোড়ামাটির মূর্তি, ছোট ছোট খেলনা পুতুল ইত্যাদি পাওয়া গিয়েছিল। এ থেকে অনুমান করা যায় লালবাগ দুর্গ নির্মাণের আগে এখানে বসতি ছিল।
দুর্গের দক্ষিণ দেয়াল ঘেঁষে এক সময় বুড়িগঙ্গা প্রবাহিত ছিল। আর নদী সে যুগে ছিল যোগাযোগ, যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের প্রধান বাহন। এ কারণে দুর্গে প্রবেশের প্রধান তোরণটি ছিল দক্ষিণে। লালবাগ দুর্গের তিনটি তোরণের মধ্যে এটিই সর্ববৃহৎ ও আলাদা নির্মাণ শৈলীতে নির্মিত। পূর্ব দিকের সীমানা প্রাচীর নির্মাণ সমাপ্ত করে যাননি সুবাদার শায়েস্তা খান। তাই এই সীমানা প্রাচীরও আধুনিককালে নির্মিত। মনে রাখতে হবে উত্তর-পূর্ব সীমানা প্রাচীর যা গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ভাঙা হয়েছিল তা কোনো বিবেচনায়ই প্রত্নস্থাপনা নয়। তবে দেয়াল ভেঙে প্রত্নস্থলের সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে কি না বা এই অংশে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা বিধেয় কি না- তা নিয়ে ভিন্ন বিতর্ক হতেই পারে।
প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকে অনুমান করা হয়- এককালে দক্ষিণের প্রাচীরের পরে প্রশাসনিক ভবন, আস্তাবল, জলাশয় ইত্যাদি ছিল আর পশ্চিম দেয়ালের কাছাকাছি ছিল কর্মকর্তাদের আবাসিক ভবন।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।