নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেসি, মোবাইল কোর্ট ও মাঠ প্রশাসন

মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯-এর সংশাধনী মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন হওয়ার পর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় নির্বাহী বিভাগ বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই এই সংশোধনীকে মাসদার হোসেন মামলার পরিপন্থী এবং সংবিধানের মূল ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মত দিয়েছেন।
রাষ্ট্রের দৈনন্দিন প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার সুবিধার্থে নির্বাহী বিভাগের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এই সংশোধনী করা হয়েছে। মাঠ প্রশাসনে জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), সহকারী কমিশনাররা (ভূমি) সরকারের নির্দেশনা পালন করতে গিয়ে যে সমস্যার সম্মুখীন হন, সেগুলোর মোকাবিলায় এই ক্ষমতার দরকার আছে বৈকি।
ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের প্রশাসনিক ও বিচারিক কাঠামো অনেকটা একই। ভারতের বিচার বিভাগ স্বাধীন কিন্তু সেখানকার জেলা শাসক জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। যেমন : আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জননিরাপত্তা বিধান এবং নাগরিকের অধিকার রক্ষায় The Code of Criminal Procedure, 1898-এর preventive ধারাগুলো প্রয়োগ করেন এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে জেলা পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করেন।
পাকিস্তানে সরকার প্রশাসনিক সংস্কারের নামে ২০০১ সালে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ আলাদা করে। মাঠপর্যায়ের জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার বিলুপ্ত করে DCO বা District Co-Ordination Officer পদের প্রবর্তন করা হয়। এই ব্যবস্থায় তারা এতটাই প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় যে, ২০১৩ সালে The Code of Criminal Procedure 1898 সংশোধন করে পুনরায় জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং বিভাগীয় কমিশনার পদ প্রবর্তন করে।
জেলা প্রশাসকের জেলার প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে অন্যান্য সব বিভাগকে সমন্বয় সাধন করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জননিরাপত্তা বিধান ও অপরাধ প্রতিরোধে বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োজন। ম্যাজিস্ট্রেসি না থাকলে সমন্বয় যে সম্ভব নয়, তার প্রমাণ তো ভারত ও পাকিস্তান। ম্যাজিস্ট্রেসি ছাড়াই সমন্বয় সম্ভব হলে পাকিস্তানে DCO থেকে DC বা DM-এ প্রত্যাবর্তন করত না।
বিচারিক এই ক্ষমতার মাধ্যমে অপরাপর বিভাগের সঙ্গে জেলা প্রশাসকের যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছে। প্রশাসনিকভাবেও যোগসূত্র আছে তা অত্যন্ত ক্ষীণ। যেমন : জেলা প্রশাসক জেলায় সকল কমিটির সভাপতি। সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধান ওই কমিটির সদস্য সচিব।
জেলায় জেলা প্রশাসকই সরকার বা সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে জবাবদিহিতা করে থাকেন। যেমন : জেলার কোথাও অবাধে বৃক্ষ নিধন করা হয়েছে, এর পরিপ্রেক্ষিতে জনস্বার্থে কেউ রিট করলে জেলাপর্যায়ে প্রথম বিবাদী জেলা প্রশাসক, বন বিভাগ নয়। কারণ, জেলায় জেলা প্রশাসক সরকার বা সরকারের প্রতিনিধি বা জেলা বন ও পরিবেশ কমিটির সভাপতি। কিন্তু সভাপতি হিসেবে তিনি এমন অবহেলাজনিত কর্মকাণ্ডের জন্য জেলা বন কর্মকর্তাকে কোনো জবাবদিহিতার আওতায় নিতে পারেন না, শুধু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ বা স্থানীয় মিটিংয়ে অনুরোধ করা ছাড়া কিন্তু বন আইন, ১৯২৭ মোবাইল কোর্টের তফশিলভুক্ত হওয়ায় বন ও বনজ সম্পদ রক্ষায় বন বিভাগকে জেলা প্রশাসকের ওপর নির্ভর করতে হয়। এভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইনের মাধ্যমে ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ, পাবলিক পরীক্ষা আইনের মাধ্যমে শিক্ষা বিভাগ, মহাসড়ক আইনের মাধ্যমে সড়ক ও জনপথ বিভাগ, মাদক আইনের মাধ্যমে মাদক বিভাগ, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে মহিলা বিভাগ, তথ্য আইনের মাধ্যমে তথ্য বিভাগ, স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইনের মাধ্যমে নির্বাচন অফিস, ভোক্তা অধিকার আইনের মাধ্যমে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, মৎস্য আইনের মাধ্যমে মৎস্য বিভাগ, পুলিশ আইন ১৮৬১ এবং The Code of Criminal Procedure, 1898-এর মাধ্যমে পুলিশের সঙ্গে জেলা প্রশাসকের যোগসূত্র স্থাপিত। সংশ্লিষ্ট আইনের বাস্তবায়ন জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে করতে হয় বিধায় ওই সব বিভাগের ওপর জেলা প্রশাসকের সাধারণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের এই ক্ষমতা জেলা ম্যাজিস্ট্র্রেটের না থাকলে সরকারি কাজে বাধা দান করলে তাৎক্ষণিক প্রতিকার দিতে পারবেন না, অবৈধভাবে খাল ভরাট করলে তিনি প্রতিরোধ করতে পারবেন না। চোরাচালান প্রতিরোধ করতে পারবেন না। ব্যবসায়ীদের বে-আইনি সিন্ডিকেট দমন করতে পারবেন না, জাটকা ইলিশের বাজারজাত ঠেকাতে পারবেন না, অবৈধভাবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ চুরি ও তার ব্যবহার রোধ করতে পারবেন না, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে পারবেন না, বিশেষ পরিস্থিতিতে Mob নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, পরিবেশ রক্ষা করতে পারবেন না, প্রটোকল ব্যবস্থাপনায় আইনগত কর্তৃত্ব হারাবেন, সরকারি প্রয়োজনে গাড়ি রিকুইজিশন করতে পারবেন না। এ রকম আরো হাজারো কাজে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আইনগত এখতিয়ার হারাবেন।
সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বিজ্ঞ বিচারিক হাকিমের মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এতে একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেলার প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে অপরাপর বিভাগের সঙ্গে শুধু সাধারণ প্রশাসনিক যোগসূত্রই হারাবেন না, বরং বিচার বিভাগের ক্ষেত্র তৈরি হবে নির্বাহী বিভাগে অবাধ অনুপ্রবেশের, যা মাসদার হোসেন মামলার পরিপন্থী।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, জননিরাপত্তা বিধান, অপরাধ প্রতিরোধ জেলা প্রশাসকের সাধারণ দায়িত্ব। ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা ছাড়া তিনি কীভাবে অপরাধ প্রতিরোধ করবেন। কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কীভাবে পুলিশকে নির্দেশ দেবেন। জরিমানা ও কারাদণ্ড বলতেই যদি বিচার বিভাগের এখতিয়ারকে বোঝায় তাহলে নির্বাহী বিভাগের কার্যপরিধির পুনর্বিন্যাস করতে হবে।
রেলওয়ে আইন ১৮৯০-এর ১২৯ ধারা এবং ১৩০ ক ধারায় রেলওয়ের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মচারীকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার ও তল্লাশি করার ক্ষমতা দেওয়া আছে। মোটরযান অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর ১৫৯, ১৬০ ও ১৬১ ধারায় পুলিশ কর্মকর্তাকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া আছে। এ ছাড়া মেট্রোপলিটন আইনে পুলিশ কমিশনারের বিচারিক ক্ষমতা, RPO-তে নির্বাচনকালীন প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ম্যাজিস্ট্রেসি, The Registration Act, 1908-এ সাব-রেজিস্ট্রারের বিচারিক ক্ষমতা, ট্যাক্স আইনে ট্যাক্স কর্মকর্তাদের দণ্ড দেওয়ার ক্ষমতা রহিত করতে হবে।
সে ক্ষেত্রে সাবরেজিস্টারকে হতে হবে বিচারিক হাকিম। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে থাকতে হবে বিচারিক হাকিম, ট্যাক্স ও রেল বিভাগে বিচারিক হাকিম পদায়ন করতে হবে, বিদ্যুৎ, পরিবেশ, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, ভোক্তা অধিকার, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর, র্যাবেও বিচারিক হাকিম নিয়োগ দিতে হবে। সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা পরিচালনার জন্য শিক্ষা বিভাগেও বিচারিক হাকিম থাকতে হবে, নির্বাহী এসব প্রতিষ্ঠানে বিচারিক হাকিম পদায়ন হলে মাসদার হোসেন মামলার ১২ দফার নির্দেশনার যে চেতনা তা কি রক্ষা হবে?
দণ্ড বলতেই যদি বিচারিক হাকিমের ক্ষমতা বোঝায়, তাহলে তো প্রশাসন বলতেই Administrative Service-এর কর্মকর্তা পদায়ন করতে হবে। যেমন- বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, কলেজের অধ্যক্ষ, বিভিন্ন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, কারণ এগুলো সবই প্রশাসনিক পদ। শিক্ষকের কাজ শিক্ষা দেওয়া, চিকিৎসকের কাজ চিকিৎসা করা, অধিদপ্তরে শিক্ষাদান কিংবা চিকিৎসা করা জাতীয় কোনো কাজ নেই। তাহলে তাদের সেখানে কেন পদায়ন করা হয়?
ক্ষমতার নিরঙ্কুশ বিভাজন সম্ভব নয় বিধায় আন্তবিভাগ সমন্বয়ের স্বার্থে সরকারের অনেক বিভাগকে এ ধরনের ক্ষমতা দেওয়া আছে। আর তা ছাড়া জেলা প্রশাসক তো The Code of Criminal Procedure 1898-এর ১০ (১) ধারা অনুসারে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। মাঠপর্যায়ে Law and Order Maintain কাজের মনিটরিং, সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা গ্রহণ, অবাধ নির্বাচন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ, খাসজমি রক্ষা, সার ও খাদ্য সরবরাহ ঠিক রাখা, নারী নির্যাতনসহ ইভটিজিং প্রতিরোধ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ, ন্যায্যমূল্যে ভেজালমুক্ত প্রোডাক্ট ও সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, জুয়া প্রতিরোধ, মৎস্যসম্পদ রক্ষা, পরিকল্পিত নগরায়ন, মাংসের মান নিয়ন্ত্রণ, সরকারি জমি রক্ষা, নোটবই প্রতিরোধ, ভেজার ওষুধ ও ভুয়া চিকিৎসক প্রতিরোধ, ওজনে কম দেওয়া প্রতিরোধ, সরকারি প্রয়োজনে ভূমি হুকুম দখল, নিরাপদ পানি সরবরাহ, ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ, এসিড নিয়ন্ত্রণ, ধূমপান প্রতিরোধ, সুষ্ঠু সার ব্যবস্থাপনা, কৃষিজমি রক্ষা, শিশুশ্রম প্রতিরোধ, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ, রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন, জনগণের সেবক সরকারি অফিসের কর্মকর্তারা চার্টার অনুযায়ী সেবা দিতে সঠিক দায়িত্ব পালন করছেন কি না তার দায়বদ্ধতা, অসাধু ব্যক্তি সরকারি কাজে বাধা দিচ্ছে কি না, সুষ্ঠু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় অন্য কেউ অনিয়ম করলেও তার জন্য দায়ী থাকা ইত্যাদি নির্বাহী বিভাগের কাজের জন্য Accountable ও Responsible প্রশাসকদের (AC (Land), UNO, DC/DM) প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্থে বিচারিক ক্ষমতা থাকা বাঞ্ছনীয়। জনস্বার্থেই প্রশাসকদের এই ক্ষমতায়ন প্রয়োজন।
এ ছাড়া আমলাদের হাতে আইন প্রয়োগের এই সুযোগ না থাকলে ভবিষ্যতে আইনের খসড়া প্রণয়ন, আইন অনুসারে মন্ত্রণালয় বা বিভাগগুলোর কর্মকাণ্ড পরিচালনায়ও সমস্যা হবে। তা ছাড়া ম্যাজিস্ট্রেসির সঙ্গে সম্পত্তি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলেই সিটি করপোরেশনগুলোতে ম্যাজিস্ট্রেট পদায়ন করা হয়। আর যে জেলা প্রশাসক জেলায় সরকারের হাজার, হাজার একর সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা ও বিলিবণ্টন করেন ম্যাজিস্ট্রেসি ছাড়া সেই জেলা প্রশাসকের পদ অবাস্তব এবং অকল্পনীয়।
বিচারিক ক্ষমতা ছাড়া জেলা প্রশাসক বা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পদ অবাস্তব। বিচার বিভাগ পৃথককরণের পর মাঠ প্রশাসনে যে অস্থিরতা, সমন্বয়হীনতার কথা পত্রিকায় যতবার এসেছে, পৃথককরণের আগে এ রকম সমন্বয়হীনতার কথা শোনা যায়নি। বিচারিক এই ক্ষমতা না থাকার কারণে সরকারি সম্পদ রক্ষা, সরকারি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে গিয়ে মাঠ প্রশাসন (AC/Land), UNO বারবার লাঞ্চিত হয়েছেন। এমনকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত হতে দেখা গেছে।
ভিশন ২০২১-এর সুষ্ঠু ও পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন তথা সোনার বাংলা বিনির্মাণে, সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিতকরণে, সরকারি সম্পদ রক্ষা, জননিরাপত্তা বিধানে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্ণাঙ্গ বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োজন।
লেখক : সিনিয়র সহকারী সচিব ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট